পোড়া স্বপ্ন জোড়া লাগাতে ব্যস্ত তাঁরা
শাহিদা সুলতানা (৬৫) ৩২ বছর ধরে মিরপুরের রূপনগরের শিয়ালবাড়ী বস্তিতে থাকেন। শাহিদা ১০ ছেলেমেয়ে ও তাঁদের পরিবার নিয়ে থাকেন সেখানে। পরিবারের লোকজন এখানে মোট ১৬টি ঘর নিয়ে থাকত; তার সবই পুড়ে ছাই হয়ে গেছে গতকাল বুধবার সকালের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে।
শাহিদার পরিবারে অন্তত ৩৫ জন সদস্য। এই বস্তি ছাড়া তাঁদের থাকার কোনো জায়গা নেই। তাই গত রাতে পুড়ে যাওয়া ঘরের পোড়া টিন সরিয়ে খোলা আকাশের নিচেই ঘুমিয়েছিলেন পুরো পরিবার। আজ বৃহস্পতিবার দুপুর থেকে শাহিদা সুলতানা শুরু করেছেন তাবু টাঙানো। আপাতত দুই-তিনটা তাবু টাঙিয়ে সবাই মিলে থাকবেন তাঁরা।
শাহিদার পরিবারের শুধু ১৬টি ঘরই পুড়েনি, পুড়েছে ঘরগুলোতে থাকা সব আসবাবপত্র। পুড়েছে ঘরে থাকা টাকাসহ বই-খাতা। বাচ্চাদের কিছু কিনে খাওয়ানোরও উপায় নেই শাহিদার। তিনি বলছিলেন, ‘সকালে বাচ্চাগুলো খাওয়ার জন্য কেমন করছিল। পরে নব-নির্বাচিত কাউন্সিলরের পক্ষ থেকে দেওয়া খিচুড়ি খাইছি সবাই। তারপর থেকে আর কিছু খাইনি কেউ।’
শাহিদা সুলতানা বলেন, ‘সব পোড়া টিন পাঁচ টাকা কেজি দরে বিক্রি করছি। এই টাকা দিয়ে আগে খেয়ে বাঁচি। পরে টিন কিনে ঘর বানাব। এখন টাকা নেই বলে শুধু তাবু টাঙাব। তাবুর নিচেই থাকব ৩৫ জন। বালিশ-খেতাও নেই। সব পুইড়া গেছে। আমার নাতি-নাতনিদের সব বই পুড়ে গেছে। সরকার যদি আমাদের কিছু টাকা দিত।’
আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে শিয়ালবাড়ি বস্তিতে গিয়ে দেখা যায়, শাহিদা সুলতানা তাঁর জামাতা মো. সবুজকে (৫২) নিয়ে তাবু টাঙাচ্ছেন। সে সময় সবুজ বলেন, ‘ছেলেমেয়ে নিয়ে সারারাত এই পোড়া ঘরের মাটিতে শুয়ে ছিলাম। আর কোথাও থাকার জাইগা ছিল না। এখন তাই তাবু টাঙ্গাই। আমাদের দুঃখ দেখার মতো কেউ নাই।’
পাশে ছিলেন শাহিদার বড় মেয়ে মর্জিনা। তিনি বলেন, ‘রান্না করে খাওয়ার টাকাও আমাদের কাছে নাই। আমার মেয়ের বই পুড়ে গেছে। সে খুব কান্না করছিল। আবার কবে ঘর উঠবে আল্লাহ জানে।’
শাহিদার থেকে একটু দূরে পোড়া টিন সরিয়ে ঘরের জায়গা পরিষ্কার করছিলেন সালাউদ্দিন আহম্মেদ। তিনি ৪৭ বছর ধরে শিয়ালবাড়ী বস্তি এলাকার বাসিন্দা। ১৫ বছর ধরে তিনি এই বস্তিতে থাকেন। বস্তিতে আসার আগে তিনি একটি ফ্লাটে ভাড়া থাকতেন। বস্তিতে তাঁর ১০টি ঘর ছিল। একেকটি ঘর ভাড়া দিতেন আড়াই হাজার টাকা করে। জায়গা পরিষ্কার করতে করতে সালাউদ্দিন বলছিলেন, ‘পোড়া টিনগুলো সব বিক্রি করে দিয়েছি। এখন জায়গা পরিষ্কার করছি। কাল থেকে ঘর তুলি আর না তুলি থাকার জায়গা তৈরি করতে হবে। কারণ, থাকার আর কোনো স্থান নেই।’
বস্তিতে পোড়া টিন বিক্রির হিড়িক
আজ শিয়ালবাড়ি বস্তিতে গিয়ে দেখা যায়, পোড়া টিন বিক্রির হিড়িক পড়েছে সেখানে। কেজিপ্রতি পাঁচ থেকে সাত টাকা পর্যন্ত টিন ক্রয় করছেন ক্রেতারা। কেউ আবার গড়পড়তা ক্রয় করছেন। টিন বিক্রেতারা সবাই পুড়ে যাওয়া ঘরগুলোর মালিক।
আনোয়ার হোসেন নামের এক ক্রেতা কয়েকমণ পোড়া টিন কিনেছেন কেজিপ্রতি পাঁচ টাকা করে। তিনি বলেন, ‘এই টিনের টেম্পার নষ্ট হয়ে গেছে। এই টিন আমরা মিলে দেব। তারপর মিল টিন গলিয়ে আবার তৈরি করবে।’
শরিফ হোসেন নামের আরেক টিন ক্রেতা বলেন, ‘আমি গড়পড়তা কিনছি। সামনে থাকা এই টিনগুলো আমি পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে কিনেছি। গতকাল সন্ধ্যায়ও ১০ হাজার টাকার টিন কিনেছি। শুধু আমি না, এখানে বহু ব্যবসায়ী আসছে টিন কিনতে।’