ফজলে হাসান আবেদের মৃত্যুতে অপূরণীয় ক্ষতি হলো
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা ও ইমেরিটাস চেয়ার স্যার ফজলে হাসান আবেদের রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। এ ছাড়া বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন, তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীসহ সমাজের বিশিষ্টজনরা শোক প্রকাশ করেছেন। তাঁরা মরহুমের আত্মার মাগফেরাত কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।
স্যার ফজলে হাসান আবেদ গতকাল শুক্রবার রাত ৮টা ২৮ মিনিটে রাজধানীর এ্যাপোলো হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৩ বছর। তিনি স্ত্রী, এক মেয়ে, এক ছেলে এবং তিন নাতি-নাতনিসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন।
এর আগে গত ২৮ নভেম্বর সন্ধ্যায় অসুস্থ হয়ে পড়ায় ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা ফজলে হাসান আবেদকে এ্যাপোলো হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ব্রেন টিউমারে আক্রান্ত অবস্থায় এরপর থেকে সেখানেই চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি। বৃহস্পতিবার থেকে হঠাৎ তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটে। পরে শুক্রবার রাতে মারা যান স্যার ফজলে হাসান আবেদ।
রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রীর শোক
বঙ্গভবনের উপপ্রেসসচিব আবুল কালাম আজাদের মাধ্যমে পাঠানো শোকবার্তায় রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ বলেন, ফজলে হাসান আবেদ ব্র্যাক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে বিপুল অবদান রেখেছেন। তিনি আরো বলেন, দেশের উন্নয়নে তাঁর অবদান জাতি শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে।
রাষ্ট্রপতি মরহুমের আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শোকবার্তায় বলেন, ১৯৭১ সালে ফজলে হাসান আবেদ ইংল্যান্ড থেকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সমর্থন আদায়, তহবিল সংগ্রহ ও জনমত গঠন করেন। সদ্যস্বাধীন যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠনেও তিনি কাজ করেন। তিনি আরো বলেন, তাঁর মতো মানবতাবাদী মানুষের মৃত্যুতে দেশ ও জাতির এক অপূরণীয় ক্ষতি হলো। প্রধানমন্ত্রী তাঁর আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।
বিএনপি মহাসচিবের শোক
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর তাঁর শোকবার্তায় বলেন, ‘ফজলে হোসেন আবেদ সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে দেশ ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অনন্য সাধারণ অবদান রেখেছেন। স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসেবে তিনি দেশ মাতৃকার মুক্তির জন্য, যে ভূমিকা পালন করেছেন তা দেশবাসীর কাছে চীর স্মরণীয় হয়ে থাকবে। স্বাপ্নিক দূরদৃষ্টি, উদ্যমী কর্মতৎপরতা এবং গতিশীল নেতৃত্বে মরহুম ফজলে হোসেন আবেদ ব্র্যাককে পরিণত করেন বিশ্বের সর্ববৃহৎ বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায়।
দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের এক দুর্জয় সেনাপতি ড. ফজলে হোসেন আবেদ দেশের পিছিয়ে পড়া প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে আত্মনির্ভরশীল করতে নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। চার দশক ধরে তাঁর অভূতপূর্ব নেতৃত্বের মাধ্যমে গ্রামাঞ্চলে দরিদ্র মানুষের জীবনমান উন্নয়নে দীর্ঘ মেয়াদি নানা কর্মসূচি গ্রহণ করে তা বাস্তবায়ন করেছেন। বিশ্ব জনস্বাস্থ্য ক্ষেত্রে তাঁর বিশেষ অবদান সারা বিশ্বে সুনাম অর্জন করেছে। ড. ফজলে হোসেন আবেদের মতো গুণী, সজ্জন, মৃদুভাষী, সুশিক্ষিত ও উদ্যমী মানুষের এই মুহূর্তে পৃথিবী থেকে চলে যাওয়ায় দেশে এক বিরাট শূন্যতার সৃষ্টি হলো। এ শূন্যতা সহজে পূরণ হওয়ার নয়।
আমি মরহুম ফজলে হোসেন আবেদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারে ও শুভানুধ্যায়ীদের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করছি।’
কাল রোববার জানাজা ও দাফন
এদিকে ব্র্যাকের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে স্যার ফজলে হাসান আবেদের মৃত্যুর বিষয়টি জানিয়ে বলা হয়, যে কোনো কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে শান্ত থাকা ও এগিয়ে যাওয়ার শিক্ষাই স্যার ফজলে হাসান আবেদ সবসময় আমাদের দিয়েছেন। জীবনভর যে সাহস আর ধৈর্যের প্রতিচ্ছবি আমরা তাঁর মাঝে দেখেছি, সেই শক্তি নিয়েই আমরা তাঁর স্মৃতির প্রতি যথাযথ সম্মান জানাব।
ওই সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, আগামীকাল রোববার সকাল সাড়ে ১০টা থেকে দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত স্যার ফজলে হাসান আবেদের মরদেহ ঢাকার আর্মি স্টেডিয়ামে সর্বসাধারণের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য রাখা হবে। দুপুর সাড়ে ১২টায় আর্মি স্টেডিয়ামেই জানাজা সম্পন্ন হবে। জানাজার পর ঢাকার বনানী কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হবে।
ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক আসিফ সালেহ বলেন, ‘আমরা শোকে স্তব্ধ, কিন্তু তিনি আমাদেরকে যেমনটা বলতেন। শোকে স্তব্ধ হলেও কাজ চালিয়ে যেতে হবে। তাঁর কথা মতো আমরা কাজ চালিয়ে যাব।’
বটবৃক্ষের মতো ছিলেন
এদিকে স্যার ফজলে হাসান আবেদের মৃত্যুর খবরে হাসপাতালে ছুটে যান রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে সমাজের বিশিষ্টজনেরা। মানবতাবাদি এই মানুষের চলে যাওয়া দেশের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি বলে জানান তারা।
হাসপাতাল লবিতে উপস্থিত পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন বলেন, ‘আবেদ ভাইকে আমরা সারাজীবন চিনেছি আমার বড় ভাইয়ের মতো, একজন আদর্শ পুরুষ হিসেবে, যিনি তাঁর সারাটা জীবন দরিদ্র মানুষের জন্য সেবা করে গেছেন। লাখ লাখ দরিদ্র মানুষকে তিনি দারিদ্র্য সীমার ঊর্ধ্বে আনার চেষ্টা করেছেন।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘উনার (স্যার ফজলে হাসান আবেদ) কাজের পরিধি এতো বিশাল, যেটা অনেকের জানাও নেই। অনেকের কাছে পৌঁছেওনি, কারণ উনি পাবলিসিটি মাইন্ডেড ছিলেন না। তাঁর চলে যাওয়া সারাবিশ্বের জন্য একটি বড় ধরনের ক্ষতি। সাধারণ মানুষের কাছে বেসরকারিভাবে সেবা নিয়ে যাওয়া, একজনমে এত কিছু করাটা কিন্তু খুবই কঠিন। সেটা করে দেখিয়েছেন।’
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, ‘তিনি (স্যার ফজলে হাসান আবেদ) বটবৃক্ষ যাকে বলে, বটবৃক্ষের মতো ছিলেন উনি। বিশেষ করে উন্নয়নকর্মীদের কাছে, কতো প্রতিষ্ঠান যে তিনি তৈরি করেছেন, জানেও না অনেকে, কতো কাজের মানুষকে নেতৃত্বকে প্রস্তুত করেছেন সেটাও অনেক মানুষ জানে না। আমরা যারা জানি তাঁর কাজ সম্পর্কে, তারা জানি কী হারালাম।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘আমাদের আশা থাকবে, তাঁর যে চিন্তাভাবনা, তাঁর যে কর্মকাণ্ড, এখন যারা ব্র্যাকের কর্ণধার হবেন তারা এগিয়ে নিয়ে যাবেন।’
১৯৩৬ সালে জন্মগ্রহণ করা ফজলে হাসান আবেদ মাত্র ৩৬ বছর বয়সে ১৯৭২ সালে ব্র্যাক প্রতিষ্ঠা করেন। ২০০১ সাল পর্যন্ত সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ওই সময় তাঁর বয়স ৬৫ হয়ে গেলে তিনি নির্বাহী পরিচালকের দায়িত্ব ছেড়ে দেন। এরপর তাঁকে চেয়ারপারসন নির্বাচিত করেন ব্র্যাকের তৎকালীন পরিচালনা পর্ষদ। পরবর্তীতে তিনি ব্র্যাক ইন্টারন্যাশনালের তত্ত্বাবধায়ক পর্ষদেরও চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন। ২০১০ সালে দারিদ্র বিমোচনে অসাধারণ অবদানের জন্য ব্রিটেনের নাইট উপাধি দেওয়া হয় তাঁকে।