বহু সাংবাদিক পিটিয়েছেন, মেজর-টেজরের ধার ধারেন না ওসি প্রদীপ
কক্সবাজারে ইউটিউব চ্যানেলের জন্য প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করতে গিয়ে টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাশের অপকর্মের কথা জানতে পারেন মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খান। এ বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করা শুরু করলে ওসি প্রদীপ হুমকি দিয়ে বলেন, তিনি মেজর-টেজরের ধার ধারেন না। তিনি বহু সাংবাদিককে পিটিয়েছেন, জেলে পাঠিয়েছেন। তিনি তাদেরকে ভয়ভীতি দেখান ও হুমকি দেন এবং কক্সবাজার জেলা ছেড়ে যেতে বলেন।
২০২০ সালের ১৩ ডিসেম্বর কক্সবাজারের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট তামান্না ফারাহর আদালতে দাখিল করা অভিযোগপত্রে সাবেক ওসি প্রদীপ, তাঁর সহযোগী এবং সিনহা মো. রাশেদ হত্যাকাণ্ড নিয়ে এভাবেই উল্লেখ করা হয়েছে।
অভিযোগপত্রের ১২ পাতার দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে বলা হয়, সিনহা মো. রাশেদ দেশীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরার লক্ষ্যে ‘জাস্ট গো’ (JUST GO) নামে একটি ইউটিউব চ্যানেল প্রতিষ্ঠা করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এই চ্যানেলের ডকুমেন্টরি কনটেন্ট তৈরি করার লক্ষ্যে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্ত ঘুরে তথ্য সংগ্রহের জন্য তিনি ভিডিওচিত্র ধারণ করেন। এ সময় তাঁরা বাংলাদেশের পর্যটনশিল্পকে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরার জন্য নিরলস কাজ করছিলেন। এজন্য তিনি গ্রাম বাংলার আনাচে-কানাচে ঘুরে ভ্রমণ-পিপাসুদের জন্য বিভিন্ন স্থানের প্রামাণ্যচিত্র ধারণ করেন। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি তার সহযোগীদের নিয়ে ২০২০ সালের ৭ জুলাই কক্সবাজারের রামু থানাধীন হিমছড়ি নীলিমা রিসোর্টের একটি কটেজে উঠেন। সেখানে তিনি আশপাশের চিত্র ধারণসহ বিভিন্ন পেশার মানুষের জীবিকার তথ্যাদি সংগ্রহ ও ভিডিও ধারণ শুরু করেন।
এরপর সিনহা মো. রাশেদ টেকনাফেও একই কাজ করেন। তখন লোকমুখে এবং বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের জীবন-জীবিকার তথ্য সংগ্রহ করার সময় ওসি প্রদীপের মাদক নির্মূলের নামে টেকনাফ থানার নিরীহ মানুষের ওপর অবর্ণনীয় নির্যাতন-নিপীড়নের কাহিনী জানতে পারেন। অনেক ভিকটিম পরিবারের সদস্য সিনহা ও তাঁর দলের কাছে প্রদীপের অত্যাচার-নীপিড়নের কাহিনির বর্ণনা দেন। তখন তাঁরা ওসি প্রদীপ, পরিদর্শক মো. লিয়াকত আলী ও তাঁদের পেটুয়া বাহিনীর নাম সংগ্রহের চেষ্টা করেন।
প্রামাণচিত্র ধারণের এক পর্যায়ে ওসি প্রদীপের সঙ্গে সিনহা মো. রাশেদ খান, শিপ্রা দেবনাথ ও সাহেদুল ইসলাম সিফাতদের দেখা হয়। তাঁদের সঙ্গে ক্যামেরাসহ ভিডিও ধারণের সরঞ্জাম ছিল। তাঁরা ওসি প্রদীপের সঙ্গে এসব বিষয় নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করেন। তখন প্রদীপ তাঁদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন এবং তাঁদেরকে এসব কাজ থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেন। ওসি প্রদীপ বলেন, তিনি মেজর-টেজরের ধার ধারেন না। তিনি বহু সাংবাদিককে পিটিয়েছেন, জেলে পাঠিয়েছেন। তিনি তাঁদেরকে ভয়ভীতি দেখান ও হুমকি দেন এবং কক্সবাজার জেলা ছেড়ে যেতে বলেন। ওসি এও বলেন, ইন্টারভিউ, ভিডিওচিত্র বানিয়ে ইউটিউবে প্রচার করে তাঁর কাজে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করলে এবং কর্তৃপক্ষকে জানালে মেজর সাহেব ও তাঁদেরকে ধ্বংস করে দেবেন বলে হুমকি দেন। এরপর ওসি প্রদীপ তাঁর থানা এলাকায় নিয়োজিত সব সোর্সের সঙ্গে কথা বলেন এবং গোপন বৈঠক করেন। এরই ধারাবাহিকতায় খুন হন সিনহা মো. রাশেদ।
হত্যাকাণ্ডের চার দিন পর ৫ আগস্ট সিনহার বড় বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস বাদী হয়ে কক্সবাজার জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিমের আদালতে নয় জনকে আসামি করে হত্যা মামলা করেন। মামলায় প্রধান আসামি করা হয় বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের পরিদর্শক মো. লিয়াকত আলীকে (৩১)। ওসি প্রদীপ কুমার দাশকে (৪৮) ২ নম্বর এবং বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের উপপরিদর্শক (এসআই) নন্দ দুলাল রক্ষিতকে (৩০) ৩ নম্বর আসামি করা হয়। বাকি ছয় আসামি হলেন—উপপরিদর্শক (এসআই) টুটুল, সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) মো. লিটন মিয়া (৩০), কনস্টেবল ছাফানুর করিম (২৫), মো. কামাল হোসাইন আজাদ (২৭), মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন ও মো. মোস্তফা। আদালত মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব দেন কক্সবাজারের র্যাব-১৫-কে। ৭ আগস্ট মামলার সাত আসামি আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। তাঁরা হলেন—লিয়াকত আলী, প্রদীপ কুমার দাশ, নন্দ দুলাল রক্ষিত, মো. লিটন মিয়া, ছাফানুর করিম, মো. কামাল হোসাইন ও মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন। তবে, এসআই টুটুল ও কনস্টেবল মোস্তফা আত্মসমর্পণ করেননি।
র্যাব তদন্তে নেমে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে আরও আট জনের সংশ্লিষ্টতা পায়। তাঁরা হলেন—ওসি প্রদীপের দেহরক্ষী রুবেল শর্মা (৩০), বরখাস্ত কনস্টেবল সাগর দেব, বরখাস্ত এপিবিএনের উপপরিদর্শক (এসআই) মো. শাহজাহান আলী (৪৭), বরখাস্ত কনস্টেবল মো. রাজীব হোসেন (২৩) ও আবদুল্লাহ আল মাহমুদ (২০), স্থানীয় বাসিন্দা টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুরের মারিশবুনিয়া গ্রামের মো. নুরুল আমিন (২২), মো. নিজাম উদ্দিন (৪৫) ও মোহাম্মদ আইয়াজ (৪৫)। তাঁদের মধ্যে সাগর দেব বাদে সবাইকে গ্রেপ্তার করা হয়।
হত্যাকাণ্ডের পর চার মাসেরও বেশি সময় ধরে তদন্তের পর ২০২০ সালের ১৩ ডিসেম্বর র্যাব ১৫-এর সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার মোহাম্মদ খায়রুল ইসলাম ১৫ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোপত্র দাখিল করেন। অভিযোগপত্রে এজাহারভুক্ত নয় আসামির মধ্য থেকে এসআই টুটুল ও কনস্টেবল মো. মোস্তফাকে বাদ দেওয়া হয়। অভিযুক্ত বাকি পলাতক আসামি কনস্টেবল সাগর দেব ২০২১ সালের ২৪ জুন আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। এর মাধ্যমে অভিযুক্ত ১৫ আসামি গ্রেপ্তার ও আত্মসমর্পণের মাধ্যমে আইনের আওতায় আসেন।
অভিযোগপত্রে সিনহা হত্যাকাণ্ডকে একটি ‘পরিকল্পিত ঘটনা’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এ মামলায় মোট ৮৩ জনকে সাক্ষী করা হয়। ২০২১ সালের ৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৬৫ জন ব্যক্তি আদালতে সাক্ষ্য দেন। সাক্ষ্যগ্রহণ ও জেরা শেষ হওয়ার পর ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৪২ ধারায় আত্মপক্ষ সমর্থনে আসামিদের বক্তব্য গ্রহণ করা হয়। এরপর চলতি বছরের ৯ জানুয়ারি থেকে ১২ জানুয়ারি পর্যন্ত যুক্তিতর্ক উপস্থাপন অনুষ্ঠিত হয়। এরপর আদালত আগামীকাল ৩১ জানুয়ারি রায়ের জন্য দিন ধার্য করেন।