‘বাচ্চা দুটিকেও লাথি দিয়েছে, আমি বাপ ডাকলেও ছাড়েননি’
মধ্যরাতে ভ্রাম্যমাণ আদালতের নামে কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসনের সদ্য সাবেক আরডিসি নাজিম উদ্দিনের অপকর্মের নানা কাহিনী এখন একে একে বেরিয়ে আসছে।
সাংবাদিক আরিফুল ইসলামের মতোই একই কায়দায় রাতে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে নির্যাতন ও হয়রানি করে আসছিলেন নাজিমউদ্দীন। সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনায় দেশব্যাপী সমালোচনার ঝড় উঠলে ভুক্তভোগীরা তাঁর বিরুদ্ধে মুখ খুলতে শুরু করেছেন।
গত শুক্রবার (১৩ মার্চ) মধ্যরাতে বাংলা ট্রিবিউনের কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি সাংবাদিক আরিফুল ইসলামকে মধ্যরাতে বাড়ি থেকে তুলে এনে নির্মম নির্যাতন করেন আরডিসি নাজিম উদ্দিন। এরপর আরিফকে ভ্রাম্যমাণ আদালতে সাজা দেওয়া হয়। একই কায়দায় জেলার বিভিন্ন এলাকায় নিরীহ মানুষকে নানা অজুহাতে ধরে এনে ভ্রাম্যমাণ আদালতে জেল ও পরবর্তীতে টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটিয়েছেন নাজিম উদ্দিন।
ভুক্তভোগী এসব মানুষ তাঁর এসব অপকর্মের শাস্তিসহ নিজেদের প্রতি অবিচার করায় সরকারের কাছে ন্যায়বিচার চান।
সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত ২৬ ফেব্রুয়ারি নাগেশ্বরী উপজেলার ভিতরবন্দ ইউনিয়নের পঞ্চায়েত পাড়ার কৃষক খালেকুজ্জামানের বাড়িতে গভীর রাতে ভ্রাম্যমাণ আদালতের নামে তাণ্ডব চালান নাজিম উদ্দিন। ওই ইউনিয়নের দেবীকুড়া নামক বিল নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে প্রতিপক্ষের যোগসাজসে খালেকুজ্জামানের বাড়িতে ভ্রাম্যমাণ আদালতের নামে দরজা, জানালা ভেঙে তাঁকে টেনে হিঁচড়ে বাইরে বের করে নিয়ে আসেন। এ সময় তাঁদের বাধা দিতে গেলে তাঁর স্ত্রী, সন্তান ও নাতিসহ পাশের অনেককে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করাসহ লাঠিপেটা করেন।
পরে কৃষক খালেকুজ্জামানকে গাড়িতে তুলে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে নেওয়ার পথে দুই লাখ টাকা দাবি করেন। অন্যথায় জেলে দেওয়ার হুমকি দেন। সে টাকা দিতে অপারগতা প্রকাশ করলে মধ্যরাতে জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের নিচ তলায় একটি রুমে বসিয়ে ছয় মাসের জেল প্রদান করেন। বর্তমানে তিনি জামিনে রয়েছেন।
এদিকে ভ্রাম্যমাণ আদালতের নামে আরডিসি নাজিম উদ্দিনের হাতে নির্যাতিত বিশ্বনাথের স্ত্রী, সন্তান ও তাঁর ভাইসহ পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা জেলা প্রেসক্লাবে এসে নির্যাতনের বর্ণনা দেন। কিছুদিন আগে ভিতরবন্দ ইউনিয়নের একটি জলমহাল ইজারার ঘটনায় মৎস্যজীবী বিশ্বনাথকে একই কায়দায় মধ্যরাতে বাড়িতে গিয়ে ঘর থেকে বের করে কিল ঘুষি মেরে শারীরিকভাবে নির্যাতন করেন। পরে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে নিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করেন। টাকা দিতে না পারায় তাঁকে দুই বছরের জেল দেওয়া হয়। বিশ্বনাথ জেলে থাকলেও এখন পর্যন্ত সে মামলার কোনো কপি হাতে পাননি তাঁর পরিবার।
এ ব্যাপারে খালেকুজ্জামান মজনু বলেন, “২৬ ফেব্রুয়ারি রাত ১২টা থেকে সাড়ে ১২টা সময় হঠাৎ করে বাড়ির দরজায় লাথি মেরে দরজা ভেঙে আমাকে ঘর থেকে বের করে আনে। আমি আরডিসি নাজিম উদ্দিনের কাছে জানতে চাই এতো পুলিশ নিয়ে এসেছেন আমার কী অপরাধ। কিন্তু কোনো উত্তর না দিয়ে বলে ‘একে অ্যারেস্ট কর’।”
“তারপর দুইজন বিজিবি আমার দুই হাত দুই দিকে ধরে গাড়িতে তোলে। গাড়িতে তোলার পর আমার মাথায় যে টুপি ছিল সে টুপিটা খুলে ফেলে দেয়। এরপর অর্ধেক রাস্তা যাওয়ার পর আমাকে বলে তোমার কাছে দুই লাখ টাকা আছে। যদি টাকা থাকে দাও তোমাকে ছেড়ে দিয়ে চলে যাব। তখন টাকা দিতে অপারগতা প্রকাশ করলে এরপর ডিসি অফিসের নিচ তলায় আমাকে নিয়ে একটি রুমে বসিয়ে বলা হয়, ‘তোমাকে ছয় মাসের জেল দেওয়া হয়েছে। কোন প্রধানমন্ত্রী তোমাকে বাঁচায় দেখা যাবে’। আমি সরকারের কাছে এর ন্যায়বিচার চাই।” বলে আকুতি জানান খালেকুজ্জামান মজনু।
কুড়িগ্রাম প্রেসক্লাবে নির্যাতিত বিশ্বনাথের স্ত্রী পারো বালা দাস বলেন, ‘আমার স্বামীকে বাড়ি থেকে ধরে মারপিট করে জেলে দিয়েছে। আমার দুটি ছোট সন্তান পা ধরলেও তারা ছেড়ে দেননি। এমনকি আমার ছোট ছোট বাচ্চা দুটিকেও লাথি দিয়ে ফেলে দিয়েছে এই ম্যাজিস্ট্রেট (নাজিম উদ্দিন)। আমাকে গালি দিয়ে ঘরের দরজা ভেঙে ফেলেছে। আমি তাঁকে বাপ ডাকলেও তিনি আমার স্বামীকে ছাড়েননি। তখন আমাকে বুট জুতা দিয়ে লাথি মারেন। এরপর প্রতিবেশীরা এগিয়ে এলে তাদেরকেও মারধর করা হয়।’
স্বামীকে কারাগার থেকে ছেড়ে দেওয়ার দাবি জানিয়ে পারো বালা দাস বলেন, ‘আমি গরিব মানুষ কোথায় যাব? আমার স্বামীকে ছেড়ে না দিলে বাচ্চা দুটিকে নিয়ে কী খাব? আমার স্বামীকে ছেড়ে দেওয়া হোক।’
এ ব্যাপারে ভিতরবন্দ ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সাবেক চেয়ারম্যান শফিউল আলম শফি জানান, ভ্রাম্যমাণ আদালতের নামে ভিতরবন্দ ইউনিয়নে অনেক সাধারণ মানুষকে আরডিসি নাজিম উদ্দিন এভাবে হয়রানি করেছেন। এসব ঘটনার সঠিক বিচার দাবি করেন তিনি।
জেলা প্রশাসন অফিস সূত্রে জানা গেছে, সিনিয়র সহকারী কমিশনার (আরডিসি) নাজিম উদ্দিন কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে যোগ দেন ২০১৯ সালের ২৭ নভেম্বর। রাজস্ব, এলএ, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং আরএম শাখার দায়িত্ব পালন করেন করেন তিনি। যোগদানের পর থেকেই জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীনের নির্দেশে ভ্রাম্যমাণ আদালতের নামে বিভিন্ন অপকর্ম শুরু করেন আরডিসি নাজিম উদ্দিন।
এ ছাড়া কক্সবাজার সদর উপজেলা ভূমি কমিশনার থাকাকালীন নানা অপকর্মে জড়িত থাকায় তাঁকে সেখান থেকে স্ট্যান্ড রিলিজ করা হয়েছিল। সে সময় তিনি কক্সবাজার শহরের কলাতলি এলাকার মোহাম্মদ আলী ওরফে নকু মাঝি (৬২) নামের এক বৃদ্ধকে নির্যাতন করার ভিডিও গণমাধ্যমসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়।
অন্যদিকে শুধু প্রত্যাহার নয় জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীনসহ সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনায় জড়িতদের বিচারের আওতায় এনে শাস্তির দাবিতে কুড়িগ্রামে মানববন্ধন করেছে ছাত্র, যুব সমাজ, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন সংগঠন। গতকাল সোমবার কুড়িগ্রাম প্রেসক্লাবের সামনে এসব মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়।
এ সময় বক্তারা বলেন, শুধু ডিসি বা আরডিসিসহ জড়িতদের প্রত্যাহার নয় মধ্যরাতে নিরপরাধ সাংবাদিককে তুলে এনে নির্যাতন ও মাদকের মামলা দিয়ে জেলে পাঠানোর ঘটনায় সুষ্ঠ তদন্ত করে তাদের বিচারের আওতায় আনতে হবে।
গত শুক্রবার দিবাগত রাত ১২টার পর জেলা প্রশাসনের আরডিসি নাজিম উদ্দিনের নেতৃত্বে কয়েকজন ম্যাজিস্ট্রেট আনসার সদস্যদের নিয়ে সাংবাদিক আরিফুল ইসলামের শহরের চড়ুয়া পাড়ার বাড়িতে যায়। একপর্যায়ে জোরপূর্বক দরজা ভেঙে তাঁর ঘরে প্রবেশ করে স্ত্রী সন্তানের সামনেই তাঁকে মারধর করে ধরে নিয়ে যায়। পরে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে নিয়ে নির্যাতনের পর তাঁর বাসায় আধা বোতল মদ ও দেড়শ গ্রাম গাঁজা রাখার অভিযোগ এনে তাঁকে এক বছরের কারাদণ্ড দেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও সহকারী কমিশনার রিন্টু বিকাশ চাকমা। এ ঘটনার একদিন পর জামিন পেয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে অমানুষিক ও বর্বর নির্যাতনের বর্ণনা দেন নির্যাতিত সাংবাদিক আরিফুল ইসলাম।
এদিকে সাংবাদিক আরিফুল ইসলামকে নির্যাতনের ঘটনায় সোমবার আরডিসি নাজিম উদ্দিন ও দুই সহকারী কমিশনারকে প্রত্যাহার করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে সংযুক্ত করা হয়েছে। জেলা প্রশাসক মোছা. সুলতানা পারভীনকে প্রত্যাহার করে নতুন প্রশাসক হিসেবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মোহাম্মদ রেজাউল করিমকে নতুন জেলা প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে নাজিম উদ্দিনকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তাঁর ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।