ভ্যাপসা গরমে ওষ্ঠাগত রাজশাহীর জনজীবন, তাপমাত্রার রেকর্ড
রাজশাহীতে ভারী বৃষ্টি তো দূরের কথা, মাটি ভেজার মতো বৃষ্টির দেখা নেই অনেকদিন। কাঠফাটা রোদ আর ভ্যাপসা গরমে ওষ্ঠাগত জনজীবন। আকাশে মেঘেরও দেখা নেই। বৈশাখী খরতাপে পুড়ছে রাজশাহী। দীর্ঘ আট বছর পর শুক্রবার দুপুরে রাজশাহীতে সর্বোচ্চ ৪১ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করেছে স্থানীয় আবহাওয়া অফিস।
এর আগে ২০১৪ সালের ২৫ এপ্রিল একই তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছিল এখানে। দীর্ঘদিন ধরে বৃষ্টি না হওয়ায় এবং রোদের তীব্রতা বাড়ায় কৃষকের বোরো ধান চাষের সেচ খরচ বাড়ছে। খরতাপে শুকিয়ে যাচ্ছে আম ও লিচুর গুটি। গরমের তীব্রতায় মানুষসহ পশু-পাখিরাও হাঁসফাঁস করছে। ঘরে বাইরে কোথাও এতটুকু যেন স্বস্তি নেই। নেই কোনো বাতাস। সবখানেই শুধু গরম আর গরম। একটু শীতল ছোয়া পেতে ব্যাকুল হয়ে উঠেছে মানুষ।
গত কয়েকদিন ধরে রাজশাহী অঞ্চলের ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে তাপপ্রবাহ। মার্চের মধ্যভাগ থেকেই তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে রাজশাহীতে। এর মধ্যে গত ৪ এপ্রিল শূন্য দশমিক ৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়, যা দিয়ে রাস্তার ধুলোই ভেজেনি। এর আগে ও পরে দেশের বিভিন্ন স্থানে হালকা ও ভারী বৃষ্টি হলেও খরাপ্রবণ এলাকা রাজশাহীতে তার দেখা নেই।
রাজশাহী আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের জ্যেষ্ঠ আবহাওয়া পর্যবেক্ষক রেজওয়ানুল হক জানান, গত কয়েকদিন ধরে রাজশাহীর তাপমাত্রা বেড়েই চলেছে। শুক্রবার বেলা তিনটায় রাজশাহীর সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৪১ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সাধারণত তাপমাত্রা ৩৬ থেকে ৩৮ হলে মৃদু তাপপ্রবাহ, ৩৮ থেকে ৪০ হলে মাঝারি তাপপ্রবাহ এবং ৪০ থেকে ৪২ হলে তীব্র তাপপ্রবাহ বলে ধরা হয়। এছাড়া সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে উঠলে তাকে অতি তীব্র তাপপ্রবাহ হিসেবে ধরা হয়। ফলে রাজশাহীর ওপর দিয়ে এখন তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে।
রাজশাহীর আকাশে মেঘের ঘনঘটা না থাকায় তীব্র এই গরমে দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে এখানকার স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। হাঁসফাঁস গরম থেকে সহসা মুক্তির সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না। সকাল থেকে শুরু করে সন্ধ্যার আগ পর্যন্ত সমানে তাপ বিকিরণ করছে সূর্য। এতে অস্থির হয়ে পড়ছে রাজশাহীবাসী। বিশেষ করে, নগরবাসী ঘরে-বাইরে কোথাও স্বস্তি পাচ্ছে না। বৃষ্টিবিহীন আবহাওয়ায় ঘরের চেয়ে বাইরের অবস্থা বেশি ভয়াবহ। প্রতিদিনই বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে তাপমাত্রা। তাপমাত্রার দাপটে মানুষের পাশাপাশি পশু-পাখিরাও গরমে কষ্ট পাচ্ছে। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে হিটস্ট্রোক ও ডায়রিয়াসহ গরমজনিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে মানুষজনের ভর্তি হওয়া সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। কখন বৃষ্টি ঝরবে, সেই অপেক্ষার প্রহর গুণছে গরমে নাস্তানাবুদ মানুষ। রুক্ষ এই আবহাওয়ার প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়ছে রাজশাহীর কৃষিতে।
বিরূপ এই আবহাওয়ার প্রভাব থেকে লিচুর গুটি বাঁচাতে পবা উপজেলার হরিপুর এলাকায় গাছের গোড়ায় বালতি বালতি পানি ঢালছিলেন মকসেদ আলী। তিনি বললেন, ‘এইবার লম্বা সময় বৃষ্টি নেই। এ রকম হলে চলে কী করে? সূর্যের তাপে মনে হচ্ছে গাছের পাতা কুকড়ে যাচ্ছে, লিচু টিকবে কী করে? তাই গাছের গোড়ায় পানি ঢালছি। যদি উপকার হয়।’
গোদাগাড়ী উপজেলার চাপাল গ্রামের আমচাষি সাইফুল ইসলাম জানান, খরায় তার আমের কড়ালি (গুটি) ঝরে পড়ছে। বৃষ্টি হলে আমগুলো রক্ষা পেত। সকাল-বিকেল সাধ্যমতো গাছের গোড়ায় পানি দিচ্ছি। কিন্তু আবহাওয়া এতো গরম যে ওপরের কড়ালির লাভ তেমন একটা হচ্ছে না। আমের জন্য এই মুহূর্তে একটা ভালো বৃষ্টি দরকার।
তানোর উপজেলার মুণ্ডুমালা এলাকার কৃষক জাহিদুল ইসলাম বলেন, তাদের এলাকায় সেচ সংকট। বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) একটি গভীর নলকূপ যে পরিমাণ বোরো ধানের জমিতে সেচের চাহিদা পূরণ করতে পারে, তার চেয়েও অনেক বেশি জমিতে বোরো ধান চাষ হয়। তাই মাঠে বোরো ধান থাকা পর্যন্ত তারা বৃষ্টির জন্য আকাশের দিকে চেয়ে থাকেন। কিন্তু এবার মাঠে বোরো ধান লাগানোর পর একবারও বৃষ্টি হয়নি। ফলে জমি সেচ সংকটে পড়ছে। আবার গভীর নলকূপ থেকে সেচের চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে বাড়ছে আবাদের খরচ।
রাজশাহীর এই তাপমাত্রা নিয়ে বিপাকে পড়েছেন শ্রমজীবী মানুষ। যারা নানা কাজের সন্ধানে রাস্তায় বের হচ্ছেন, তারা হাঁসফাঁস করছেন গরমে। শুক্রবার দুপুরে নগর ভবনের সামনে রিকশা নিয়ে বসেছিলেন জুলমত আলী। তিনি বলেন, এতো বেশি সূর্যের তাপ যে মনে হচ্ছে রাস্তার পিচ তেঁতে উঠছে। রাস্তায় চলাচল করা কঠিন। দিনের বেলায় দূরে থাক, রাতেও গাছের পাতা নড়ছে না। একটু ঠাণ্ডার পরশ পেতে রাস্তার পাশে ট্যাপ খুললে বের হচ্ছে যেন ফুটন্ত পানি।