মামলা আর হুমকি-ধমকিতে গ্রামছাড়া ৬০ পরিবার
ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সাবেক ও বর্তমান চেয়ারম্যান সমর্থিত দুই গ্রুপের মধ্যে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে শুরু হয় হামলা-পাল্টাহামলা। এরপর পেরিয়েছে ছয় মাস। অথচ গ্রামছাড়া নারী-পুরুষ ও স্কুলগামী শিশুসহ অন্তত ৬০ পরিবারের দুই শতাধিক লোকজন। মামলা ও হুমকি-ধমকির কারণে ঘরে ফিরতে পারছে না তারা। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, গণ্যমান্যরা উভয় পক্ষকে নিয়ে পুলিশ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে দফায় দফায় আপস-মীমাংসার চেষ্টা করলেও তা অনেকটাই ব্যর্থ। এদিকে, গ্রামে ফিরতে না পারায় শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে পড়ছে শিক্ষা থেকে, আর চাষের জমিও থাকছে পতিত বলে দাবি ভুক্তভোগীদের।
অভিযোগ উঠেছে, মাস ছয়েক আগে চরকেওয়ার ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান আক্তারুজ্জামান জীবন সমর্থিত মামুন হাওলাদার পক্ষের লোকজনের সঙ্গে বর্তমান চেয়ারম্যান আফসার উদ্দিন ভুইয়া সমর্থিত আহম্মদ হোসেন পক্ষের লোকজনের সংঘর্ষ হয়।
২০২১ সালের ২৮ নভেম্বরের ইউপি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী ছিলেন আফসার উদ্দিন ভুইয়া। অন্যদিকে, স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেন আক্তারুজ্জামান জীবন। নির্বাচনে জয়-পরাজয়ের জের ধরে এই দুই পক্ষের মধ্যে একাধিকবার সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।
সর্বশেষ ২০২২ সালের ১০ জুলাই ঈদুল আজহার পরের দিন আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে খাসকান্দি ও ছোট মোল্লাকান্দি এলাকায় সংঘর্ষে জড়ায় দুপক্ষ। ঘটনার সময় গুলিবিদ্ধ হয় উভয় পক্ষের অন্তত ১০ জন। এ সময় মামুন পক্ষের খাসকান্দি এলাকার মৃত বাচ্চু মুন্সির ছেলে রবিউল ইসলাম (১৮) বাম পায়ে গুলিবিদ্ধ হন। পরবর্তী সময়ে তার বাম পায়ের নিচের অংশ কেটে ফেলতে হয়।
এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সদর থানায় আহম্মদ পক্ষের ৫১ জনকে আসামি করে মামলা করে মামুন পক্ষের লোকজন। মামলা করে আহম্মদ পক্ষের লোকজনও। মামলার পর থেকে ঘরবাড়ি ছেড়ে পরিবারসহ এলাকা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় এজাহারে থাকা আসামিসহ অন্তত ৬০ জন ও তাদের পরিবারের দুই শতাধিক নারী-পুরুষ ও শিশু। গ্রামছাড়া এই পরিবারগুলো বর্তমানে মুন্সীগঞ্জ শহরের বিভিন্ন এলাকায় ভাড়া বাসায় বসবাস করছে।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, ফেলে আসা ঘরবাড়িতে থাকা টিউবওয়েল, ফার্নিচার, জানালার গ্রিল, মোটর ইত্যাদি খুলে নিয়ে গেছে প্রতিপক্ষের লোকজন। এমনকি, তাদের ফেলে আসা আবাদি জমিও রয়েছে পতিত অবস্থায়।
স্থানীয় হোসেন হাওলাদারের স্ত্রী রোকেয়া বেগম (৩০) বলেন, ‘আগে আমাদের গ্রামে এত ঝগড়াঝাটি ছিল না। গত কয়েক বছর ধরে মারামারিতে এলাকার উভয়পক্ষের লোকজনই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আলু লাগানোর মৌসুম প্রায় শেষপর্যায়ে। আর মাত্র ১০ দিনের মধ্যে আলু না লাগালে এই জমিগুলো এভাবেই পড়ে থাকবে।’
খাসকান্দি এলাকার কোহিনুর বেগম বলেন, ‘আমার নাতি সাঈদ ইসলাম সিয়াম (১২) স্থানীয় কদমতলি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে। সে এই দুই পক্ষের মারামারির ফলে পরিবারসহ এলাকাছাড়া হওয়ায় ছয় মাস ধরে স্কুলে যেতে পারছে না। বর্তমানে তার লেখাপড়া বন্ধ রয়েছে।’
ছোট মোল্লাকান্দি এলাকার হাজি সৈয়দ আহম্মেদ খা (৬৮) বলেন, ‘আমি প্রতিবছর সাড়ে তিন কানি জমিতে আলু রোপণ করি। এ বছর মামুন হাওলাদার ও তার লোকজনের বাধার কারণে জমি চাষ করতে পারিনি। আমিসহ স্থানীয় আরও ৫০টি পরিবার বাড়িছাড়া। ২০০ থেকে ৩০০ মানুষ গ্রামছাড়া। মামুনের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ করা হলেও পুলিশ তা নেয় না। অথচ আমরা ঘটনাস্থলে না থাকলেও পুলিশ হুকুমের আসামি করে।’
সৈয়দ আহম্মেদ খা অভিযোগ করে বলেন, ‘স্থানীয় ইউপি সদস্য নজরুল ইসলাম হাওলাদারের কাছে এ বিষয়ে সহযোগিতা চাইলেও তিনি কখনোই এসব নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি। প্রশাসনের কাছে তাঁর প্রত্যাশা তারা নিরপেক্ষ ভূমিকা রাখবে। তিনি পুরো পরিবার নিয়ে এখন শহরের ইসলামপুর এলাকায় ভাড়া থাকেন।’
খাসকান্দি এলাকার মজিবুর রহমান বেপারি (৫৮) বলেন, ‘এলাকায় আমার চৌচালা ঘর ছিল। মামলার পর থেকে আমি গ্রামছাড়া। জানতে পেরেছি, আমার বাড়ির টিউবওয়েল তারা তুলে নিয়ে গেছে। বিল্ডিংয়ের থাই গ্লাস ভেঙে ফেলেছে। নির্বিচারে তারা বাড়ি থেকে বিভিন্ন দ্রব্যাদি লুটপাট করে নিয়ে গেছে।’
স্থানীয় ইউপি সদস্য নজরুল ইসলাম হাওলাদার বলেন, ‘সর্বশেষ চরকেওয়ার ইউপি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিরোধের শুরু হয়। এরপর আমি দুই গ্রুপকে মিলেমিশে থাকার জন্য বারবার বলি। কিন্তু কেউ-ই তা শোনেনি। সম্প্রতি আমরা উভয়পক্ষের লোকজনসহ পুলিশের উপস্থিতিতে বসি। সেখানে মামুন গ্রুপের পক্ষ থেকে গুলিবিদ্ধ রবিউলসহ আহতদের চিকিৎসা বাবদ ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা বলা হয়। কিন্তু পরে আর এ নিয়ে আপস-মীমাংসা হয়নি।’
স্থানীয় আওয়ামী লীগনেতা আহম্মদ হোসেন বলেন, ‘দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষের সময় আমি এলাকায় ছিলাম না। তার পরও আমার বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হয়েছে। সংঘর্ষের ঘটনায় আমাদের পক্ষেরও চারজনের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। আমরাও মামুন হাওলাদারের পক্ষের লোকজনের বিরুদ্ধে একটি মামলা করি। এ নিয়ে কয়েক দফায় আপস-মীমাংসার চেষ্টা করা হলেও তা হয়নি। মামুনের লোকজন আমাদের এলাকায় যেতে বাধা দিচ্ছে। তারা আমাদের জমিতে চাষাবাদ করতে দিচ্ছে না। ফলে আলুর মৌসুম শেষ হতে চললেও আমরা আমাদের জমিতে আলু চাষ করতে পারছি না।’
অভিযোগের বিষয়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগনেতা মামুন হাওলাদার বলেন, ‘আমার গ্রামের বাড়ি ছোট মোল্লাকান্দি হলেও আমি ঢাকায় বসবাস করি। বেশ কয়েক বছর ধরেই স্থানীয় দুই পক্ষের লোকজনের মধ্যে সংঘর্ষ চলে আসছে। সংঘর্ষের ঘটনায় অনেকের অঙ্গহানিও ঘটেছে। জমিতে চাষাবাদ যারা করতে পারেনি তারা ভয়ে নিজেরাই এলাকায় আসছে না। তারা কেন আসছে না, তা আমার জানা নেই। যারা জমিতে চাষাবাদ করতে পারেনি, তারা এলে আমি প্রয়োজনে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে তাদের চাষাবাদে সহায়তা করব। মূলত এরা চাষাবাদ করে না। তারা জমি লগ্নি করে। প্রকৃতপক্ষে তাদের অনাবাদি জমির পরিমাণ এত হবে না, যতটা তারা দাবি করছে।’
চরকেওয়ার ইউপি চেয়ারম্যান আফসার উদ্দিন ভুইয়া বলেন, ‘চরকেওয়ার ইউনিয়নের খাসকান্দি ও ছোট মোল্লাকান্দি এলাকার দীর্ঘদিনের বংশগত বিরোধের জের ধরে এখানে প্রায়ই সহিংস ঘটনা ঘটে। সর্বশেষ নির্বাচনের সময় এই বিরোধ আরও চরম আকার ধারণ করে। নির্বাচনে আমি নৌকা প্রতীক পেলে আহম্মদরা আমার পক্ষে কাজ করে। অন্যদিকে, মামুনরা স্বতন্ত্র প্রার্থী আক্তারুজ্জামান জীবনের পক্ষ হয়ে নির্বাচন করে। দুই পক্ষই অন্তত ১৫টি করে ৩০টি মামলা রয়েছে। তবে, এই এলাকায় যাই ঘটুক মামুনের বিরুদ্ধে পুলিশ কোনো মামলা নেয় না। সর্বশেষ দুই পক্ষকে নিয়ে জেলা পুলিশ সুপার কার্যালয়ে মীমাংসার জন্য বসা হয়। সেখানে পরবর্তী সিদ্ধান্তের জন্য জীবন ও মামুনকে দায়িত্ব দেওয়া হলেও তাঁরা পরে আর কোনো উদ্যোগ নেননি।’
সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান ও জেলা পরিষদ সদস্য আক্তারুজ্জামান জীবন বলেন, ‘এসব ঘটনার মীমাংসার জন্য আমরা সম্প্রতি জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে উভয়পক্ষকে নিয়ে বসি। সেখানে উভয়পক্ষ আর সহিংসতায় না জড়ানোর প্রতিজ্ঞা করে। এরপর থেকে এলাকায় সহিংসতা বন্ধ রয়েছে। আর তারা যেসব অভিযোগ করেছে তা পুরোপুরি মিথ্যা।’
সদর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার থান্দার খায়রুল হাসান বলেন, ‘মুখের কথা নয়—আমি কাজে বিশ্বাসী। চরাঞ্চলের সব সহিংসতা রোধে আমি কাজ করছি। চরকেওয়ার ইউনিয়নের খাসকান্দি ও ছোট মোল্লাকান্দি এলাকার কিছু লোক গ্রামছাড়া, সেটি আমরা জানি। তারা ভয়ে এলাকায় যাচ্ছে না বলে আমরা শুনেছি। তাদের কেউ মারধর করেনি। ভুক্তভোগীদের পক্ষ হতে এ রকম কোনো অভিযোগও আমরা পাইনি। আগামী এক মাসের মধ্যে চরাঞ্চলের সব সহিংসতা বন্ধ করতে কাজ করছি। যারা গ্রাম ছেড়ে দূরে থাকছে, তাদের শিগগিরই গ্রামে ফেরাতে পারব বলে আশা করছি।’
জেলা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অর্থ ও প্রশাসন) সুমন দেব বলেন, ‘মামুন হাওলাদার কার আত্মীয়, সেটি আমাদের কাছে বিষয় না। বাংলাদেশ পুলিশের কোনো ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাও আমাদের কিছু বলেনি। তিনিও বলেননি যে তিনি কারও আত্মীয়। থানায় তাঁর বিরুদ্ধে কেন মামলা হয় না সেটি এই মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না। তবে তিনি প্রকৃত অপরাধী হয়ে থাকলে তাঁর বিরুদ্ধেও অবশ্যই মামলা নেওয়া হবে।’