রুম্পার কবরের পাশে অঝোরে কাঁদছেন মা-বাবা
রাজধানীর স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী রুবাইয়াত শারমিন রুম্পার কবরের পাশে অঝোরে কাঁদছেন পুলিশ কর্মকর্তা বাবা মো. রোকন উদ্দিন। মেয়ের শোকে বারবার মূর্চ্ছা যাচ্ছেন মা নাহিদা আক্তার পারুল। স্বজনরা সান্ত্বনা দিয়েও কান্না থামাতে পারছেন না। দুদিন ধরে কিছুই খাননি তিনি। শারীরিকভাবেও অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।
চিৎকার করতে করতে রুম্পার মা বলছেন, ‘জরুরি কাজের কথা বলে গেল, ফিরল লাশ হয়ে। আমার মেয়েকে কত কষ্ট দিয়ে ওরা মেরেছে। মরার সময় মেয়েটি কতবার জানি মা-মা বলে চিৎকার করেছে।’
রুম্পার গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহ সদর উপজেলার চরনিলক্ষীয়া ইউনিয়নের বিজয়নগরে। তাঁর বাবা রোকন উদ্দিন হবিগঞ্জ পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক হিসেবে কর্মরত। মা নাহিদা আক্তার পারুল গৃহিণী। এক ভাই ও এক বোনের মধ্যে রুম্পা বড়।
রাজধানীর শান্তিবাগে একটি ফ্ল্যাটে মায়ের সঙ্গে থেকে পড়াশোনা করতেন রুম্পা ও তাঁর ছোট ভাই আশরাফুল। পড়াশোনার পাশাপাশি টিউশনি করাতেন রুম্পা। আর আশরাফুল ন্যাশনাল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকে পড়াশোনা করে।
গত বুধবার টিউশনি শেষে বাসায় ফেরার কিছুক্ষণ পর রুম্পা আবারও ‘কাজ আছে’ বলে বাইরে বের হন। কিন্তু এরপর রাতে আর বাসায় ফেরেননি। স্বজনরা বিভিন্ন স্থানে খোঁজ করেও তাঁর সন্ধান পাননি।
রুম্পার মা নাহিদা আক্তার পারুল আর্তনাদ করতে করতে বলেন, ‘বুধবার সকালে ডিম ভাজি করে নিজ হাতে খাইয়ে দিয়েছি। এটাই যে শেষ খাওয়া কে জানত? সন্ধ্যায় তার চাচাতো ভাই শুভর কাছে ব্যাগ-মোবাইল দিয়ে চলে যায়। বাসার দ্বিতীয় তলায়ও ওঠেনি রুম্পা। এমন কী জরুরি কাজ ছিল, যার জন্য এত দ্রুত ছুটে যায়? দিন-রাত অপেক্ষায় ছিলাম—এই তো মেয়ে ফিরবে, ফিরে আসবে। এলো লাশ হয়ে। আমার মেয়েকে কেন মেরে ফেলল? আমি এ হত্যাকাণ্ডের কঠিন বিচার চাই।’
গত বুধবার রাতে রাজধানীর ইনার সার্কুলার রোড থেকে রুম্পার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ওই স্থানের আয়েশা শপিং কমপ্লেক্সের পেছনের একটি বাড়ির ছাদ থেকে তাঁকে ফেলে হত্যা করা হয়েছে বলে অভিযোগ ওঠে। এ ঘটনায় রমনা থানায় একটি হত্যা মামলা করা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার রুম্পার মা ও স্বজনরা রমনা থানায় গিয়ে লাশের ছবি দেখে তাঁকে শনাক্ত করেন।
এরপর ময়নাতদন্ত শেষে শুক্রবার ভোর ৫টায় রুম্পার লাশ গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহের চরনিলক্ষীয়া ইউনিয়নের বিজয়নগরে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে সকাল ১০টায় জানাজা শেষে পরিবারিক গোরস্থানে দাদি রুবিলা খাতুনের কবরের পাশে তাঁকে দাফন করা হয়।
রুম্পার মৃত্যুকে হত্যাকাণ্ড বলে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান স্বজনরা।
রুম্পার মা পারুল জানান, ইউনিভার্সিটিতে ছাত্রছাত্রীদের শিফট আলাদা হওয়ায় দুদিন ধরে মন খারাপ ছিল রুম্পার। তাঁর সঙ্গে কারো বিরোধ ছিল কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘তা বলতে পারছি না।’
রুম্পা ২০১৪ সালে রাজধানীর রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স স্কুল থেকে এসএসসিতে জিপিএ ৫ এবং ২০১৬ সালে ভিকারুননিসা নুন স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এইচএসসিতে জিপিএ ৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হন। এরপর তিনি স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির সিদ্ধেশরী ক্যাম্পাসে ইংরেজি বিভাগে পড়াশোনা শুরু করেন।
গতকাল শুক্রবার ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) রমনা জোনের সিনিয়র সহকারী পুলিশ কমিশনার (এসি) শেখ মোহাম্মদ শামীম এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘রুম্পার মৃত্যুর ঘটনায় অপমৃত্যুর মামলা না করে রমনা থানার এসআই খায়ের বাদী হয়ে একটি হত্যা মামলা করেছেন। আমরাও ধারণা করছি, রুম্পাকে হত্যা করা হয়েছে। এ ঘটনায় কে বা কারা জড়িত, তা খুঁজে বের করার চেষ্টা চলছে।’
রমনা মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘ঘটনাস্থলে তিনটি ভবন আছে। আমরা ধারণা করছি, যেকোনো একটি ভবন থেকে তাঁকে ফেলে দেওয়া হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত আমরা কোনো আসামিকে গ্রেপ্তার করতে পারিনি। হত্যা মামলাও হয়েছে অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিকে আসামি করে। ঘটনাস্থলের পাশের যে ভবনগুলো আছে, এই ভবনের দায়িত্বে থাকা লোকদের আমরা জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেছি। দ্রুতই একটি ফল পাব বলে মনে হয়।’
মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘ঘটনার রাতেই হবিগঞ্জ জেলায় পুলিশ পরিদর্শক রোকন উদ্দিনকে এ ঘটনা জানানো হয়। পরে তিনি ঢাকায় আসেন। এর আগে তাঁর পরিবার লাশ শনাক্ত করে।’
ওসি বলেন, ‘আমরা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে সব ধরনের রিপোর্ট চেয়েছি। হত্যার আগে তাঁকে ধর্ষণ করা হয়েছে কি না, সেটাও আমরা জানতে চেয়েছি।’
গত বৃহস্পতিবার দুপুরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে রুম্পার লাশের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়। কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের প্রধান সহযোগী অধ্যাপক সোহেল মাহমুদ এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘রুম্পাকে হত্যা করে ছাদ থেকে ফেলে দেওয়া হয়েছে বলে আমরা ধারণা করছি। প্রথম যখন আমি লাশটি দেখি, তখন লাশের দুই পা ও হাত ভাঙা দেখেছি। মাথায় আঘাতের চিহ্ন দেখেছি। চোখে-মুখে রক্ত লেগে ছিল। ওপর থেকে পড়লে যেমন হওয়ার কথা, আমরা তেমন লাশই পেয়েছি। তবে হত্যার আগে ওই তরুণী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন কি না, তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য আমরা আলামত সংগ্রহ করেছি। আলামত পরীক্ষাগারে পাঠানো হয়েছে। প্রতিবেদন পেলে আসল ঘটনা জানা যাবে।’
এদিকে পুলিশ পরিদর্শক রোকন উদ্দিনের ভাই নজরুল ইসলাম এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘হত্যার পর রুম্পাকে ছাদ থেকে ফেলে দেওয়া হয়েছে, এটা নিশ্চিত। তদন্ত চলছে, দেখা যাক কী হয়। আমার ভাতিজির সঙ্গে স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির একটি ছেলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল। তাদের ভেতরে ঝামেলা চলছিল বলে আমরা শুনেছি। তবে এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে ওই ছেলের কোনো সম্পর্ক আছে কি না, তা আমরা জানি না। আমি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা বলেছি। কর্তৃপক্ষ ওই ছেলেকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে।’
নজরুল ইসলাম বলেন, “তবে এ ঘটনা নিয়ে আমার ভেতরে একটি প্রশ্ন আছে। আমার ভাতিজি পাশের একটি বাড়িতে টিউশনি করতে গিয়েছিল। সেখান থেকে সন্ধ্যার দিকে নিজ বাসার নিচে যায় রুম্পা। এরপর রুম্পা দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ুয়া তার এক চাচাতো ভাইকে ফোন করে বাসার নিচে ‘স্যান্ডেল আনতে’ বলে। এরপর সে স্যান্ডেল নিয়ে এলে হিল জুতা খুলে স্যান্ডেল পরে রুম্পা। সে কানের দুল, মোবাইল, ঘড়ি, হিল (জুতা) ও টাকাসহ ব্যাগ দিয়ে দেয়। সেগুলো ওপরে নিয়ে যেতে বলে তাকে। একই সঙ্গে মাকে বলতে বলে, তার ‘আসতে দেরি হবে’। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, কেন সে এগুলো রেখে যাবে? আত্মহত্যার পরিকল্পনা? তাহলে তো বাড়ির ছাদ আছে। ওখানে যাবে কেন? নাকি কোনো ঝামেলা ছিল, তাই এগুলো রেখে গিয়েছিল? এসব ভালো করে তদন্ত করতে হবে।”