৩৮২ ক্যামেরার ফুটেজ দেখে গ্রেপ্তার করা হয় নাঈমকে
পর্বতারোহী ও স্কুলশিক্ষক রেশমা নাহার রত্নাকে (৩২) গাড়িচাপা দেওয়া মাইক্রোবাসচালক নাঈমকে (২৭) গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তবে এ জন্য পুলিশকে ৩৮২টি ক্লোজসার্কিট (সিসিটিভি) ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ ও পর্যালোচনা করতে হয়েছে। কাজ করতে হয়েছে ১১২টি মাইক্রোবাস নিয়ে। এরপরই ঘটনার ১১ দিন পর গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর ইব্রাহিমপুর থেকে কালো রঙের মাইক্রোবাসসহ নাঈমকে গ্রেপ্তার করা হয়।
বিষয়টি এনটিভি অনলাইনকে নিশ্চিত করেছেন শেরেবাংলা নগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জানে আলম মুন্সী। তিনি জানান, আজ বুধবার আসামিকে আদালতে পাঠানো হবে। তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পাঁচ দিনের রিমান্ডের আবেদন করা হবে।
গত ৭ আগস্ট সকাল ৯টার দিকে রাজধানীর চন্দ্রিমা উদ্যানের পাশে লেক রোডে বাইসাইকেল আরোহী রেশমা নাহার রত্নাকে একটি মাইক্রোবাস ধাক্কা দিলে তাঁর মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় তাঁর এক স্বজন মামলা করেন।
রেশমা নাহার রত্না রাজধানীর আইয়ুব আলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন। তিনি রাজধানীর মিরপুরের পাইকপাড়ায় সরকারি কোয়ার্টারে থাকতেন। তিনি নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার বীরবিক্রম খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা আফজাল হোসেনের সন্তান। লোহাগড়া আদর্শ কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। এরপর ইডেন কলেজ থেকে গণিতে স্নাতক পাস করেন। পর্বতারোহণের ওপর তিনি ভারতের উত্তরাখন্ডের উত্তরকাশিতে অবস্থিত নেহরু ইনস্টিটিউট অব মাউন্টেনিয়ারিং থেকে বি.এমসি কোর্সে পড়াশোনা করেন।
রত্না দীর্ঘদিন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের পাঠচক্রের সঙ্গে সংযুক্ত ছিলেন। দেশে-বিদেশে বেশ কটি হাফ-ম্যারাথন দৌড়ানোর পর নিজেকে ফুল ম্যারাথনে দৌড়ানোর জন্য প্রস্তুত করছিলেন। তাঁর স্বপ্ন ছিল এভারেস্ট জয়ের। কিন্তু তার আগেই নাঈমের গাড়িচাপায় শেষ হয়ে যায় সেই স্বপ্ন।
এ ঘটনার পর ট্রাভেলার, সাইক্লিস্টসহ বিভিন্ন মহল মাইক্রোবাস চালককে গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়ে মানববন্ধনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে।
মাইক্রোবাসচালক নাঈমকে গ্রেপ্তার প্রসঙ্গে শেরেবাংলা নগর থানার ওসি জানে আলম মুন্সী বলেন, নাঈমের বাড়ি কিশোরগঞ্জে। তিনি প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ঘটনার সঙ্গে জড়িত বলে স্বীকার করেছেন। মাইক্রোবাসটি ব্যক্তিমালিকানাধীন। একটি কোম্পানিকে সেটা ভাড়া দেওয়া হয়। নাঈম ওই কোম্পানির হয়েই গাড়ি চালাচ্ছিলেন। রাজধানীর ইব্রাহিমপুরের ভাড়া বাসা থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গাড়ির নম্বর ঢাকা মেট্রো চ ১৫৩৬৮৫।
ওসি বলেন, ‘নাঈমকে গ্রেপ্তার করতে আমাদের ৩৮২টি সিসি ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণ করতে হয়েছে। ১০ থেকে ১২টি সিসি ক্যামেরা থেকে এই গাড়ির ছবি পেয়েছি। নম্বর বের করতে আমাদের এত দিন সময় লেগেছে। কোনোভাবেই আমরা নম্বর বুঝতে পারছিলাম না। পরে নিজেরা গ্যারেজে গ্যারেজে গিয়ে নজরদারি করি। একপর্যায়ে আমরা চারটা গাড়িকে চিহ্নিত করি। যার মধ্যে একটি গণমাধ্যমের, একটি সূত্রাপুরের, একটি সাভারের এবং আরেকটি ইব্রাহিমপুরের। পরে বিভিন্ন মাধ্যমে আমরা নিশ্চিত হয়েছি নাঈমের চালানো গাড়িই সেই গাড়ি। পরে জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছেন এই গাড়িই তিনি চালাচ্ছিলেন।’
নাঈম যেভাবে গ্রেপ্তার
এদিকে মাইক্রোবাসচালক নাঈমকে গ্রেপ্তারের বিষয়টি জানিয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের ‘ডিসি তেজগাঁও-ডিএমপি’র ফেসবুক পেজে বিস্তারিত বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, গত ৭ আগস্ট শুক্রবার সকাল ৯টার দিকে শেরেবাংলা নগর থানাধীন লেক রোডে এক সড়ক দুর্ঘটনায় নারী পর্বতারোহী ও আইয়ুব কলোনি সরকারি প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষিকা রেশমা আক্তার রত্না গুরুতর আহত হন। প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায় জানা যায়, লেক রোডে সাইক্লিংরত অবস্থায় রত্নার সাইকেলের সঙ্গে একটি কালো মাইক্রোবাসের ধাক্কায় রত্না ঘটনাস্থলেই ছিটকে পড়ে গুরুতর আঘাতপ্রাপ্ত হন। তৎক্ষণাৎ তাঁকে শেরেবাংলা নগর থানা পুলিশ শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।
ঘটনার পরপর শেরেবাংলা নগর থানা পুলিশ কালো মাইক্রোবাসটি শনাক্ত ও অভিযুক্ত ড্রাইভারকে গ্রেপ্তারে অভিযান শুরু করে। পরে নিহতের আত্মীয় মো. মনিরুজ্জামান থানায় এসে একটি মামলা করেন (শেরেবাংলা নগর থানার মামলা নম্বর ৬, তারিখ : ৭ আগস্ট, ২০২০; ধারা : সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮-এর ৯৮, ১০৫)। মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তা হিসেবে শেরেবাংলা নগর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মো. মোবারক আলী নিযুক্ত হন।
তেজগাঁও বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ হারুন-অর-রশীদের নির্দেশে, তেজগাঁও জোনের অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার রুবাইয়াত জামানের তত্ত্বাবধানে ও তেজগাঁও জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার মো. মাহমুদ খাঁনের তদারকিতে শেরেবাংলা নগর থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) মুহাম্মদ আবুল কালাম আজাদের নেতৃত্বে ঢাকা মহানগরের বিভিন্ন এলাকার প্রয়োজনীয় সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহে জন্য তিনটি পৃথক টিম গঠন করা হয়।
কালো মাইক্রোবাসটির সম্ভাব্য যাত্রাপথ ধরে মাইক্রোবাসটির অবস্থান শনাক্তে কাজ শুরু করা হয়। প্রাথমিকভাবে মূল সড়ক, অন্যান্য সড়ক, বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ও আবাসিক স্থাপনার প্রবেশপথে থাকা ৩৮২টি সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ ও পর্যালোচনা করে ঘটনার কিছু সময় পূর্ব ও পরে মাইক্রোবাসটির যাত্রাপথ শনাক্তে সক্ষম হয় শেরেবাংলা নগর থানা পুলিশ। এসব সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করে কালো হায়েস মডেলের মাইক্রোবাসটির বেশ কিছু অস্পষ্ট ডিজিটাল নম্বর প্লেটের ছবি পাওয়া যায়। প্রাপ্ত নম্বরগুলো কিছুটা স্পষ্টীকরণপূর্বক প্রাথমিকভাবে ১১২টি মাইক্রোবাসের বিষয়ে কাজ শুরু হয়। চারটি আলাদা টিম গঠন করে বিআরটিএসহ বিভিন্ন মাধ্যম থেকে এসব মাইক্রোবাসের মালিকানা, রং, সিটের সংখ্যা ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহের বিষয়ে দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ শুরু করে শেরেবাংলা নগর থানা পুলিশ। পুলিশের বুদ্ধিমত্তা, ধৈর্যের সমন্বয়ে সর্বোপরি নিবিড়ভাবে পরিচালিত অভিযানে আসে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য।
ডিসি তেজগাঁও-ডিএমপির ফেসবুক পেজে আরো বলা হয়, ১৮ আগস্ট রাজধানীর কাফরুল থানাধীন ইব্রাহীমপুর থেকে জব্দ করা হয় কালো রঙের ১২ সিটের হায়েস মাইক্রোবাসটি। গ্রেপ্তার করা হয় মাইক্রোবাসের চালক মো. নাঈমকে (২৭), যে দুর্ঘটনার সময় মাইক্রোবাসটি চালাচ্ছিলেন। মাইক্রোবাসটির মালিক একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে মাইক্রোবাসটি মাসিক ভিত্তিতে ভাড়া দিয়েছেন। ঘটনার দিন ওই প্রতিষ্ঠানের নাইট শিফটে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিভিন্ন গন্তব্যে নামিয়ে দেওয়ার সময় ঘটনাটি ঘটেছে বলে প্রাথমিকভাবে জানা যায়।
অভিযুক্ত আসামিকে আদালতে সোপর্দপূর্বক পাঁচ দিনের রিমান্ড প্রার্থনা করা হবে। মামলার তদন্ত চলমান এবং প্রয়োজনীয় কার্যক্রম শেষে আদালতে মামলার অভিযোগপত্র দাখিল করা হবে বলে ডিসি তেজগাঁওয়ের ফেসবুক পেজে বলা হয়েছে।