৭০ বছর পর কুদ্দুস মুন্সি ফিরে পাচ্ছেন মা
আব্দুল কুদ্দুস মুন্সি এখন ৮০ বছরের বৃদ্ধ। ১০ বছর বয়সে ব্রাক্ষণবাড়িয়া থেকে চাচার সঙ্গে রাজশাহীর বাগমারায় বেড়াতে এসে হারিয়ে গিয়েছিলেন। পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন কুদ্দুস বড় হয়ে স্থায়ীভাবেই বসবাস শুরু করেন বাগমারার বাড়ুইপাড়া গ্রামে। তবে দীর্ঘ ৭০ বছর পর ফেসবুকের কল্যাণে শেকড়ের সন্ধান পেয়েছেন তিনি।
শিশু বয়সে হারিয়ে গেলেও আব্দুল কুদ্দুস মুন্সি ভুলে যাননি তার জন্মস্থানের কথা। রাজশাহীর বাগমারার বাড়ুইপাড়া গ্রামে বসতি গড়ে সংসার শুরু করার পর জীবন সায়াহ্নেও তিনি ভুলতে পারেননি অতীত। তবে বাবা, মা ও জন্মস্থান বাড্ডা গ্রামের নাম ছাড়া আর কিছু মনে নেই তার। হারিয়ে যাওয়ার পর থেকেই প্রতিনিয়ত নিজের পরিবারের সঙ্গে দেখা করার নানা চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন তিনি। শেষে প্রযুক্তির কল্যাণে তিনি খুঁজে পেয়েছেন তার হারানো পরিবার।
গত এপ্রিলে বাড়ুইপাড়া গ্রামের প্রতিবেশী আইয়ুব আলী তাঁর ফেসবুক আইডিতে আব্দুল কুদ্দুস মুন্সির হারিয়ে যাওয়া জীবনের গল্পের ভিডিও আপলোড করেন। সেখানে কুদ্দুস মুন্সি ১০ বছর বয়সে রাজশাহী বেড়াতে এসে নিজের হারিয়ে যাওয়ার কথা বলেন। সেখানে তিনি বাবা কালু মুন্সির নাম ও নিজ গ্রাম বাড্ডার নাম বলতে পেরেছেন। আইয়ুব আলীর ওই ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে দেওয়া পোস্টে নিজের শেষ ইচ্ছা হিসেবে নিজের পরিবারের সঙ্গে একবার হলেও দেখা করার কথা বলেন কুদ্দুস মুন্সি। ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ফেসবুক পোস্টটি দেশের বিভিন্ন গ্রুপ ও পেজে ভাইরাল হয়। দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে থাকা বাড্ডা গ্রামের বাসিন্দারা সাড়া দিতে শুরু করেন। এক পর্যায়ের কুদ্দুস মুন্সির ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এক ভাতিজা সেই পোস্ট দেখে নিজের হারিয়ে যাওয়া চাচার কথা জানান পরিবারের কাছে। এরপর ফেসবুকে তাদের যোগাযোগ ও কথা হয়। এরপর নিজের সবকিছু খুলে বলে শেকড় খুঁজে পান তিনি। এরই মধ্যে মায়ের সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বলেছেন তিনি। সে সময় সৃষ্টি হয় এক আবেগঘন মুহূর্ত।
আব্দুল কুদ্দুস মুন্সির হারিয়ে যাওয়ার ৭০ বছর হলেও দীর্ঘ এই সময়ের প্রতিটি দিন ছেলের পথ চেয়ে কাটিয়েছেন তার মা। অনেক খোঁজাখুঁজির পর ছেলের সন্ধান না পেয়ে আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন তিনি। এখনও কুদ্দুস মুন্সির পরিবারের মা ও এক বোন বেঁচে আছেন। আজ শুক্রবার রাতে কুদ্দুস মুন্সি তার মা ও বোনের সঙ্গে দেখা করতে ব্রাক্ষণবাড়িয়ার উদ্দেশে রাজশাহী ছেড়েছেন। আগামীকাল শনিবার নিজ জন্মস্থান ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পরিবারের সঙ্গে দেখা করবেন তিনি।
কুদ্দুস মুন্সির ছেলে সোহেল জানান, তার বাবা বাগমারায় বেড়াতে এসে হারিয়ে যাওয়ার পর রাস্তায় বসে কান্না করছিলেন। খইমন নামের এক ভিক্ষুক তাকে কাঁদতে দেখে নিজের বাড়িতে নিয়ে যান। এরপর কবিজন ও সুন্দরী নামের নিঃসন্তান দুই বোন তার বাবাকে নিয়ে নিজেদের সন্তানের মতো করে লালন পালন করে বিয়ে দেন। কবিজনকে নিজের মা এবং সুন্দরীকে ছোট মা বলে জানেন কুদ্দুস মুন্সি। নিজের মায়ের নামও তিনি ভুলে গেছেন। বাগমারায় বিয়ে করার পর কবিজন ও সুন্দরি তাকে ১২ বিঘা জমিও লিখে দিয়েছেন। কুদ্দুস মুন্সির এখন তিন ছেলে ও পাঁচ মেয়ে।
আজ শুক্রবার রাতে ব্রাক্ষণবাড়িয়ার উদ্দেশ্যে ট্রেনে রাজশাহী ছাড়ার আগে আত্রাই স্টেশনে কুদ্দুস মুন্সি বলেন, ‘আল্লাহর কাছে অনেক শুকরিয়া। ৭০ বছর পর হলেও আমার ইচ্ছে পূর্ণ হয়েছে। আমার মা ও পরিবারের সঙ্গে কথা হয়েছে। জীবনের সবচেয়ে খুশির মুহূর্ত এটি। আমার মায়ের সঙ্গে দেখা হবে এটার চেয়ে ভালোলাগার কিছু হতে পারে না।
বাড়ুইপাড়া গ্রামের আব্দুল কুদ্দুসের এক প্রতিবেশী বলেন, ‘সেই ছোটবেলা থেকেই নিজের পরিবারের সঙ্গে দেখা করার কথা কুদ্দুস মুন্সি সবাইকে বলতেন। কিন্তু কেউ কোনো খোঁজ দিতে পারেনি। অবশেষে ফেসবুকে লেখার পর তার পরিবারের খোঁজ পাওয়া গেছে। এ ঘটনায় আমরা অনেক খুশি হয়েছি। দীর্ঘদিন পর একটা মানুষ তার একান্ত আপনজনদের খোঁজ পেয়েছেন। এছাড়া তার জন্মস্থানের মানুষ এখন থেকে আমাদের এখানে আসবে। আবার আমরাও নতুন এক জায়গার কিছু মানুষের সঙ্গে নতুন করে আত্মীয়তার সুযোগ পাব।’
এদিকে, আইয়ুব আলী জানান, গত ১২ এপ্রিল আব্দুল কুদ্দুসের ৭০ বছর আগে হারিয়ে যাওয়ার একটি ভিডিও তার ফেসবুক পেজে আপলোড করেছিলেন। আর ফেসবুকের ওই পোস্টের ওপরে লিখেছিলেন যে, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর থানার এ বৃদ্ধ আজ থেকে প্রায় ৭০ বছর আগে হারিয়ে গিয়ে পরিবার থেকে এতগুলো বছর বিচ্ছিন্ন হয়ে আছেন। কেউ যদি তার কথা শুনে চিনতে পারেন তাহলে যোগাযোগ করুন। এরপর বাকিটা ইতিহাস। সাড়া পড়ে যায় এবং পরিবারের খোঁজ মেলে।’