৯ বছরেও রুল শুনানির উদ্যোগ নেই, ক্ষতিপূরণ পায়নি কেউ
সাভারের রানা প্লাজা ধসের ঘটনার নয় বছরেও ক্ষতিপূরণ পায়নি কেউ। ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দিতে হাইকোর্টের জারি করা রুলের ওপর চূড়ান্ত শুনানি এবং এ রুল নিষ্পত্তিতে কোনো পক্ষেরই উদ্যোগ নেই। ফলে ওই ঘটনায় নিহত ও আহতদের পরিবার ক্ষতিপূরণ থেকে বঞ্চিত রয়েছে।
শুধু তা-ই নয়, ওই ভবন ধসের পর রাজউক ও পুলিশের পক্ষ থেকে দুটি মামলা করলেও সেসব মামলার বিচার সম্পন্ন হয়নি। নিম্ন আদালতে মামলা দুটি এখনও বিচারাধীন। এর মধ্যে হত্যা মামলায় গত ৩১ জানুয়ারি সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়েছে।
এ বিষয়ে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা (অ্যাটর্নি জেনারেল) এ এম আমিন উদ্দিন এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘রুলের বিষয়টি কী অবস্থায় আছে, তা জেনে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’
হাইকোর্ট ২০১৩ সালের ৩০ এপ্রিল এক আদেশে রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানা এবং পাঁচ গার্মেন্ট মালিকের সব স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি হস্তান্তরের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। তাদের ব্যাংক হিসাব থেকে যেন কোনো অর্থ অন্যত্র স্থানান্তর করা না যায়, সেজন্য সব বাণিজ্যিক ব্যাংকের প্রতি সার্কুলার জারি করতে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতি নির্দেশ দেওয়া হয়। তবে বিজিএমইএ’র তত্ত্বাবধানে শ্রমিকদের বেতন-ভাতা দেওয়ার জন্য অর্থ তোলা যাবে বলে আদেশে বলা হয়।
ভবন ধসের পরদিনই হাইকোর্ট স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে রুল জারি করেন। পরে বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট), আইন ও সালিশ কেন্দ্রসহ চারটি প্রতিষ্ঠানও রিট আবেদন করে।
এ রিট আবেদনে আদালত রুল জারি করেন। রুলে ভবন মালিক ও গার্মেন্ট মালিকসহ জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, ক্ষতিগ্রস্তদের পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ দিতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা জানতে চান। এর মধ্যে ভবন মালিকসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা হওয়ায় রুলের একটি অংশ কার্যকারিতা হারায়। তবে, রুলের মূল বিষয় ছিল ক্ষতিপূরণ বিষয়ক। এ মূল বিষয়টি আজও নিষ্পত্তি হয়নি।
আদালতের শুনানিতে তখনকার অ্যাটর্নি জেনারেল প্রয়াত মাহবুবে আলম ক্ষতিগ্রস্তদের (নিহত) প্রত্যেককে এক কোটি টাকা দেওয়ার প্রস্তাব করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, এর অর্ধেক দেবে ভবন মালিক আর বাকি অর্ধেক দেবেন গার্মেন্ট মালিকেরা। পরে ওই বছরের ১৩ মে হাইকোর্টের দেওয়া আদেশে ক্ষতিগ্রস্তদের কাকে কী পরিমাণ ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে, তা নির্ধারণের জন্য নবম পদাতিক ডিভিশনের জিওসি, সরকার ও গার্মেন্ট মালিকদের প্রতিনিধি এবং মেডিসিন, মনোবিদ, অর্থনীতিবীদসহ ১৬ জনের একটি কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটির প্রতিবেদন আদালতে দাখিলও করা হয়। কিন্তু সংশ্লিষ্ট হাইকোর্ট বেঞ্চ ভেঙে দেওয়ায় ওই পর্যন্তই শেষ। এরপর আর রিট আবেদনটির অগ্রগতি নেই। এ অবস্থায় কেটে গেল নয় বছর। এ সুযোগে ওই ঘটনায় যাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, তাঁদের মধ্যে একমাত্র রানা ছাড়া বাকিরা আদালত থেকে জামিনে মুক্তি পেয়েছেন।
এদিকে, রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির দুর্ঘটনার পর হত্যা মামলায় ৫৯৪ জন সাক্ষীর মধ্যে মাত্র এক জনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়েছে। আর, ইমারত নির্মাণ মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়নি এখনও।
আজ রোববার ট্র্যাজেডির নয় বছর পূর্তির দিনে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছে ওই ঘটনায় আহত শ্রমিক, হতাহতদের পরিবারসহ বিভিন্ন সংগঠন। এখনও বিচার না পেয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে তারা। বিচারের দাবিতে ঘটনাস্থলে প্রতিদিনই ভিড় করছেন শ্রমিকেরা।
দেশের পোশাক শিল্পের ইতিহাসে শোকাবহ দিনটি উপলক্ষ্যে রানা প্লাজার সামনে নিহতদের স্মরণে অস্থায়ী শহীদ বেদীতে শ্রদ্ধা নিবেদন, তাঁদের রুহের মাগফিরাত কামনা করে দোয়াসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে।
এর মধ্যে গতকাল শনিবার রাতে মোমবাতি প্রজ্বালন করে নিহতদের স্মরণ এবং দোষীদের বিচারের দাবি জানানো হয়।
২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল ধসে পড়ে সাভারের আটতলা রানা প্লাজা ভবন। ওই ঘটনায় এক হাজার ১৩৬ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। আহত ও পঙ্গু হন প্রায় দুই হাজার শ্রমিক। জীবিত উদ্ধার করা হয় দুই হাজার ৪৩৮ জনকে। বাংলাদেশ তো বটেই, গোটা বিশ্বকে নাড়িয়ে দেয় এ শিল্প দুর্ঘটনা।
দেশের ইতিহাসে ভয়াবহ এ ট্র্যাজেডিতে স্বজন হারানো ব্যক্তিরা প্রতিদিন বিলাপ করেন বিভিন্ন সংগঠনের উদ্যোগে নির্মিত রানা প্লাজার স্মৃতিস্তম্ভের সামনে। রানা প্লাজা ধসের পর নয় বছর পেরিয়ে গেলেও এখনও দায়ীদের বিচারে কোনো অগ্রগতি নেই। এ ঘটনার মূল মামলার ছয় বছর আগে বিচার শুরু হলেও এখনও কোনো সাক্ষ্যগ্রহণ হয়নি।
রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় এ পর্যন্ত ভবনের মালিক রানা, তার পরিবার, সাভার পৌরসভার তৎকালীন মেয়রসহ বিভিন্ন জনের নামে পাঁচটি মামলা হয়।
সাভার মডেল থানার তৎকালীন উপপরিদর্শক (এসআই) ওয়ালী আশরাফ ভবন নির্মাণে ‘অবহেলা ও ত্রুটিজনিত হত্যার’ অভিযোগ এনে মামলা করেন।
২০১৫ সালের ২৬ এপ্রিল সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার বিজয়কৃষ্ণ কর ভবন মালিক সোহেল রানাসহ ৪১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। অভিযোগপত্রে রানার বিরুদ্ধে ৩০২ ধারায় হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ আনা হয়।
২০১৬ সালের ১৮ জুলাই ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ এসএম কুদ্দুস জামান আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন। এরপর প্রায় ছয় বছর পেরিয়ে গেলেও কোনো সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ হয়নি। থমকে আছে মামলার বিচার কার্যক্রম। রানা প্লাজা ধস হত্যা মামলায় অভিযুক্ত ৪১ আসামির মধ্যে বর্তমানে কারাগারে আছেন কেবল ভবনের মালিক সোহেল রানা। বাকি আসামিদের মধ্যে জামিনে আছেন ৩২ জন, পলাতক ছয় জন ও মারা গেছেন দুজন।
ধ্বংসস্তূপ অপসারণের পর ১৮ শতাংশ জমির ওপর নির্মিত ভয়াল সে ঘটনাস্থলের চারপাশটা কাঁটাতার ও টিনের বেড়া দিয়ে রেখেছে জেলা প্রশাসন। এর সামনেই বিভিন্ন সংগঠন তৈরি করেছে শহীদ বেদী।