রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির ১১ বছরেও শেষ হয়নি বিচার
দেশের পোশাক শিল্পের ইতিহাসে ভয়াবহ ট্র্যাজেডি রানা প্লাজা। আজ সেই ২৪ এপ্রিল। দেশের গণ্ডি ছাপিয়ে বিশ্ব মানবতাকে নাড়া দেওয়া সেই ট্র্যাজেডির দিন।
রানা প্লাজা ট্র্যাজেডিতে প্রাণ হারান এক হাজার ১৩৮ শ্রমিক এবং আহত হন দুই হাজার ৪৩৮ জন। আহতদের অনেকেই পঙ্গু হয়ে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন।
দিনটি ঘিরে শ্রমিকদের অধিকার আদায়ে নানা কর্মসূচি নিয়েছে বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন। দীর্ঘ এক দশকেও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি এমনকি বিচার শেষ না হওয়ায় হতাশ হতাহত শ্রমিক পরিবারের সদস্যরা।
স্বজন হারানো শোকার্ত হাজারো মানুষ এখনো সেই ঘটনাস্থল ঘিরে খুঁজে ফেরেন প্রিয় স্বজনের স্মৃতি। একদিকে শোকাবহ পরিবেশ অন্যদিকে বিচার না পাওয়ার বেদনায় মুষড়ে পড়েন অনেকেই। তাদের দীর্ঘশ্বাসে ক্রমেই ভারী হয়ে ওঠছে সেখানকার পরিবেশ।
গত ১০ বছরে পাল্টে গেছে ধসে পড়া রানা প্লাজার দৃশ্যপট। রানা প্লাজা ট্র্যাজেডিতে আহত শ্রমিকদের চিকিৎসাসেবা দিয়ে এমপি, প্রতিমন্ত্রী হয়েছিলেন এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চেয়ারম্যান ডা. মো. এনামুর রহমান।
৭ জানুয়ারির নির্বাচনে শোচনীয় পরাজয়ের পর সাভারে এসেছে নতুন সংসদ সদস্য। ভবনের আশপাশে গড়ে উঠেছে হকার্স মার্কেট। সেই ঘটনাস্থলের সামনে দিয়ে যাওয়া ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের মাঝ বরাবর বিভাজক টেনে দেওয়ায় এখন ঘটনাস্থলে যেতে হলেও দুই কিলোমিটার সড়ক পথ ঘুরে আসতে হয় সেখানে।
অন্যদিকে ভবন মালিক সোহেল রানা বাদে পাঁচ মামলার অন্য সব আসামি জামিন নিয়ে যে যার মতো মুক্ত জীবনযাপন করছেন। কেউ বা সক্রিয় হয়েছেন রাজনীতিতে।
এদের মধ্যে মামলার মূল আসামি তাজরীনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন দীর্ঘদিন ধরে জামিনে আছেন। ২০১৮ সাল থেকেই ঢাকা মহানগর উত্তর মৎস্যজীবী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয় হয়েছেন এবং ২০২২ সালের মে মাসে সংগঠনটির সভাপতিও নির্বাচিত হন তিনি।
রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় ভবনমালিক সোহেল রানা, তার পরিবার, সাভার পৌরসভার তৎকালীন মেয়র আলহাজ্ব রেফাত উল্লাহসহ বিভিন্ন জনের নামে মোট পাঁচটি মামলা হয়। এর মধ্যে পুলিশ বাদী হয়ে একটি, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) একটি এবং দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তিনটি মামলা করে।
উচ্চ আদালতের আদেশে প্রায় ছয় বছর স্থগিত থাকার পর ২০২২ সালে মূল মামলার বিচার শুরু হয়। এরপর বিচারে কিছুটা গতি এলেও মামলার মূল আসামি ভবনমালিক সোহেল রানা হাইকোর্ট থেকে জামিন পেয়েছেন। তবে আপিল বিভাগে সেই জামিন স্থগিত থাকায় এখনো তিনি মুক্তি পাননি।
ভবন ধসের ঘটনায় প্রথমে ‘অবহেলা ও ত্রুটিজনিত হত্যা’র অভিযোগে একটি মামলা করেন সাভার থানার তৎকালীন উপ-পরিদর্শক (এসআই) ওয়ালী আশরাফ। ২০১৫ সালের ২৬ এপ্রিল সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার বিজয় কৃষ্ণ কর ভবন মালিক সোহেল রানাসহ ৪১ জনের বিরুদ্ধে এই মামলায় অভিযোগপত্র দাখিল করেন। অভিযোগপত্রে রানার বিরুদ্ধে ৩০২ ধারায় হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ আনা হয়।
২০১৬ সালের ১৮ জুলাই ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ এস এম কুদ্দুস জামান আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে বিচার শুরুর আদেশ দেন। রানা প্লাজা ধস হত্যা মামলায় অভিযুক্ত ৪১ আসামির মধ্যে বর্তমানে কারাগারে আছেন কেবল ভবনের মালিক সোহেল রানা। আসামিদের মধ্যে সোহেল রানার বাবা আব্দুল খালেক, আবু বক্কর সিদ্দিক ও আবুল হোসেন মারা যাওয়ায় তারা আসামির তালিকা থেকে বাদ পড়েছেন।
অভিযোগ গঠনের পরপর সাভার পৌরসভার তৎকালীন মেয়র রেফায়েত উল্লাহ এবং তৎকালীন কাউন্সিলর মোহাম্মদ আলী খানসহ আটজন উচ্চ আদালতে মামলা বাতিল চেয়ে আবেদন করেন। তাঁদের পক্ষে মামলার কার্যক্রম স্থগিতসহ রুল ইস্যু করা হয়।
উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশে আটকে যায় মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ প্রক্রিয়া। পরে মোহাম্মদ আলী খান বাদে অন্য আসামিদের স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার হয়। অভিযোগ গঠনের সাড়ে পাঁচ বছর পর ২০২২ সালের ৩১ জানুয়ারি এই মামলায় ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ এ এইচ এম হাবিবুর রহমান ভূঁইয়ার আদালতে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। গত এক বছরে মামলাটিতে অর্ধশতাধিক ব্যক্তির সাক্ষ্যগ্রহণ হলেও এখনও বিচার শেষ হয়নি।
আদালত সূত্রমতে, ওই মামলায় সাক্ষীর সংখ্যা ৫৯৪ জন। স্বাভাবিকভাবে বিচার শেষ করতে ঢেড় সময় লাগবে।
এদিকে রানা প্লাজা ধসের পর ইমারত নির্মাণ আইন না মেনে ভবন নির্মাণ করায় রাজউকের কর্মকর্তা মো. হেলাল উদ্দিন সাভার থানায় একটি মামলা করেন। ২০১৫ সালের ২৬ এপ্রিল সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার বিজয় কৃষ্ণ কর ভবনের মালিক সোহেল রানাসহ ১৮ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। ২০১৬ সালের ১৪ জুন ঢাকার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মোস্তাফিজুর রহমান আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন।
অভিযোগ গঠনের ওই আদেশকে চ্যালেঞ্জ করে কয়েকজন আসামি ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ আদালতে রিভিশন আবেদন করেন। যার মধ্যে নিউ ওয়েব বটমস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বজলুস সামাদ ও সাবেক সহকারী প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমানের রিভিশন আবেদন নামঞ্জুর হয়। অবশ্য মামলার কার্যক্রম চলার মধ্যেই প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমান পালিয়ে চলে যান কানাডায়। সূত্র মতে, বর্তমানে তিনি সেখানেই অবস্থান করছেন।
অন্যদিকে, ফ্যান্টম অ্যাপারেলস লিমিটেডের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আমিনুল ইসলামের রিভিশন মঞ্জুর করে তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
এ ছাড়া ২০২১ সালের ৭ নভেম্বর আসামি রেফাত উল্লাহর পক্ষে উচ্চ আদালত মামলাটির ওপর স্থগিতাদেশ দেন। তাই দীর্ঘদিনেও সেভাবে মামলাটির সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু না করায় মামলাটির বিচার কার্যক্রম আশানুরূপ গতিতে এগোয়নি।
ভবনমালিক সোহেল রানাকে গ্রেপ্তারের পর তাঁর ও পরিবারের সদস্যদের নামে তিনটি মামলা করে দুদক। এর মধ্যে সম্পদের হিসাব দাখিল না করা সংক্রান্ত নন-সাবমিশন মামলায় ২০১৭ সালের ২৯ আগস্ট রানার তিন বছর কারাদণ্ড হয়। এ মামলায় তাঁকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও তিন মাসের কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়।
এদিকে জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জন ও মিথ্যা তথ্য দেওয়ার অভিযোগে দুদকের করা মামলায় ২০১৮ সালের ২৯ মার্চ রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানার মা মর্জিনা বেগমের ছয় বছরের বিনাশ্রম কারাদণ্ড হয়। কারাদণ্ডের পাশাপাশি তার ছয় কোটি ৬৭ লাখ ৬৬ হাজার ৯৯০ টাকা সম্পদ বাজেয়াপ্ত করেন আদালত।
এ ছাড়া ভবন নির্মাণ সংক্রান্ত দুর্নীতির অভিযোগে দুদকের আরেকটি মামলা রয়েছে।
তবে দীর্ঘদিন কারাগারে থাকায় সোহেল রানা ইতোমধ্যে রায় হওয়া নন-সাবমিশন মামলার সাজা ভোগ করেও মুক্তির অপেক্ষায় প্রহর গুণছেন।
২০১৩ সালের ২৩ এপ্রিল সাভারের রানা প্লাজা ভবনের তৃতীয় তলার পিলার ও দেয়ালে ফাটল দেখা দেয়। পরেদিন (২৪ এপ্রিল) শ্রমিকদের কাজে যোগ দিতে বাধ্য করেন মালিকপক্ষ। এর সঙ্গে যোগ দেন রানা প্লাজা ভবনের মালিক খালেক ও তাঁর ছেলে সোহেল রানা। সোহেল রানা সেদিন দম্ভ করে বলেছিলেন, ‘আগামী ১০০ বছরেও রানা প্লাজা ভেঙে পড়বে না।’
রানা প্লাজা তৈরিতে ধাপে ধাপে অনিয়ম ও জালিয়াতির আশ্রয় নেয়ায় শেষ পর্যন্ত গোটা ভবনটিকে পরিণত করে একটি মৃত্যুকূপে।
রানা প্লাজা ট্রাজেডিতে এখনো নিখোঁজ ছেলেকে খুঁজে ফেরেন জয়পুরহাটের ষাটোর্ধ ফেরদৌসী বেগম। গত ১০ বছর ধরে ছেলের সন্ধান করেছেন তিনি।"আমার ছেলে মাহিদুল ইসলাম কাজ করত রানা প্লাজার ৫ম তলায়।আমি কি আমার হারানো মানিককে কোন দিন পাব না’’- বলেই ঢুকরে কেঁদে ওঠেন তিনি।
রানা প্লাজা ধসে ভাগ্যের জেরে প্রাণ ফিরে পাওয়া রূপালী আক্তার বলেন, 'রুদ্ধশ্বাস ১৭ ঘণ্টা, কীভাবে বেঁচে ফিরেছি জানি না। যখন আমাকে উদ্ধার করা হয়, তখনও বিশ্বাস করিনি বেঁচে ফিরব। দু:সহ সেই দিনের ভয় আর আতঙ্ক আজও তাড়া করে বেড়ায় তাকে।
কথা হয় গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতির সভাপ্রধান তাসলিমা আখতারের সঙ্গে। তিনি জানান,দিন যায় বছর ঘুরে ২৪ এপ্রিল আসে। কিন্তু বিচার আমরা পাই না। তিনি জানান, 'পোশাক শিল্পের ইতিহাসে অন্যতম এই ট্রাজেডির ১১ বছর পার হয়ে গেলেও এখনও শ্রমিকরা তাদের বিচার পায়নি। তাদের নায্য দাবী পূরণ হয়নি- এটা আমাদের জন্যে কষ্টের।
প্রতি বছরের মতো 'রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির দিনটিকে ঘিরে জড়িতদের শাস্তি নিশ্চিত করা, ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিক ও শ্রমিক পরিবারদের পূনর্বাসন করাসহ, হতাহত পোশাক শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণের আইন পরিবর্তনসহ অন্যান্য দাবি নিয়ে নানা কর্মসূচি ঘোষণা করেছি বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন।
ঘটনাস্থলে হতাহত শ্রমিকদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন, প্রতিবাদ র্যালি,শিশুদের চিত্রাঙ্কন, আলোচনা সভার মাধ্যমে দিনটি পালনের কর্মসূচি নিয়েছে বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন।