কারাগারে হচ্ছে যৌন নির্যাতন, আদালতেও সম্ভ্রমহানি
আইনের বলে বিচারপ্রার্থী ধর্ষিত নারীকে আদালতে আসামির প্রকাশ্যে জেরা করে পুনরায় লাঞ্ছিত বা সম্ভ্রমহানি করা হয় বলে মনে করেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এস কে) সিনহা। তিনি এ ধরনের আইনের প্রতি সবার সোচ্চার হওয়ার প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করে আরো জানান, শিশু-কিশোর সংশোধনাগারে অবস্থান করা অনেক কিশোরী যৌন নির্যাতনের শিকার হয়।
urgentPhoto
আজ মঙ্গলবার বিকেলে সুপ্রিম কোর্ট মিলনায়তনে ‘নারীর প্রতি সহিংসতাবিষয়ক যুগান্তকারী রায় : বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান’ শীর্ষক বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধান বিচারপতি এসব কথা বলেন।
বিদ্যমান সাক্ষ্য আইন সংশোধনের কথা উল্লেখ করে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘সাক্ষ্য আইন অনুযায়ী, একজন নারী ধর্ষণের শিকার হওয়ার পর আদালতে জেরার মাধ্যমে আবারও তাঁর সম্ভ্রম নষ্ট করা হয়। এ আইনের ১৫৫ ধারায় জেরা করার সময় নির্যাতিত নারীর চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। তাই ব্রিটিশ আমলে করা এই আইন সংশোধন করতে হবে।’
প্রধান বিচারপতি তাঁর গাজীপুর সংশোধনাগার পরিদর্শনের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে বলেন, ‘সেখানে গিয়ে জানতে পারলাম, দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে অনেক শিশু-কিশোরীকে গ্রেপ্তার করে সংশোধনাগারে আনা হলেও তাদের আদালতে হাজির করা হয়নি। এতে করে বিনা বিচারে বছরের পর বছর তারা সেখানে অবস্থান করছে। এ ছাড়া ওই সংশোধনাগারের ভেতরে অনেক শিশু-কিশোরীকে যৌন নিযাতনের করা হয় এমন অভিযোগও আমি পেয়েছি।’
নির্যাতিতদের তালিকা করে নিজে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সভাপতি ড. মিজানুর রহমানকে দিয়েছিলেন উল্লেখ করে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘তবে এতে কোনো আশানুরূপ ফল পাওয়া যায়নি।’
এস কে সিনহা আরো বলেন, ‘ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের জেল সুপারের সঙ্গে কথা বলেও জানতে পারলাম, অনেক নারী আসামি রয়েছেন যাঁদের পক্ষে আইনি লড়াই করার মতো কেউ নেই। বিনা বিচারে তাঁরা দীর্ঘদিন ধরে কারাগারে রয়েছেন। অনেক নিরপরাধ আসামি রয়েছেন, যাঁরা দীর্ঘদিন বিনা বিচারে কারাগারে থাকায় অস্বাভাবিক আচরণ করছে।’ এদের উদ্ধারে মানবাধিকার সংগঠনগুলোকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।
উদ্যোগের অভাবে ফিরছে না পাচার হওয়া নারীরা
বাংলাদেশ থেকে ভারতে পাচার হওয়া প্রায় সাড়ে তিন হাজার নারীকে সে দেশের বিভিন্ন হোটেলে অসামাজিক কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে বলেও জানান প্রধান বিচারপতি। তিনি বলেন, ‘এদের অধিকাংশই শিশু ও তরুণী। এসব নারী দেশে ফিরে আসতে চাইলেও উদ্যোগের অভাবে তাদের সীমান্ত থেকে দেশে আনা যাচ্ছে না। সরকারের পাশাপাশি মানবাধিকার সংগঠনগুলোকে উদ্যোগী হয়ে এসব নারীদের উদ্বার করতে হবে।’
প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আমি কয়েক মাস আগে একটি সেমিনারে অংশ নিতে ভারতের মুম্বাই শহরে গিয়েছিলাম। সেখানে গিয়ে জানতে পারলাম বাংলাদেশের প্রায় সাড়ে তিন হাজার নারীকে ভারতে পাচার করে সেখানকার বিভিন্ন হোটেল ও বাসাবাড়িতে অসামাজিক কাজ করানো হচ্ছে। তাদের দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য চেষ্টা করা হলেও সরকারের উদ্যোগের অভাবে সীমান্ত থেকে তাদের এ দেশে ফিরিয়ে আনা যাচ্ছে না। তাই দেশের মানবাধিকার সংগঠনগুলোকে পাচার হওয়া এসব মেয়েকে দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করতে হবে।’
এ বিষয়ে ওই সব দেশের অনেক মানবাধিকার সংগঠনের সঙ্গে কথা বলে প্রধান বিচারপতি জানতে পারেন, বাংলাদেশের অনেক মেয়েকে দেশে ফেরত পাঠাতে সীমান্তে আনা হলেও বাংলাদেশের উদ্যোগের অভাবে তাদের দেশে প্রবেশ করানো যায় না। আবার ওই নারীদের পরিবারও অনেক সময় তাদের কাজের কথা শুনলে বাড়িতে ফিরিয়ে আনতে আগ্রহী হয় না। এটা খুবই দুঃখজনক বলে অভিহিত করেন তিনি।
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে আপিল বিভাগের বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা বলেন, ‘দেশে নারী নির্যাতন আইন রয়েছে। এসব আইনে মামলাও হচ্ছে। কিন্তু বিচার না হওয়ায় অপরাধের প্রবণতা বেড়ে চলেছে। আইনের শাসন বাস্তবায়ন হলে এসব অপরাধ কমে আসবে।’
বিচারপতি মোহাম্মদ ইমান আলী বলেন, ‘আমাদের দেশের মেয়েদের বিয়ের জন্য ১৮ বছর নির্ধারিত রয়েছে। কিন্তু সরকার বর্তমানে ১৬ বছর নির্ধারণ করার চেষ্টা করছে, যা খুবই দুঃখজনক।’
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন অ্যাডভোকেট সিগমা হুদাসহ বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের নেতারা।
অনুষ্ঠানে প্রধান বিচারপতি ‘নারীর প্রতি সহিংসতা : যুগান্তকারী রায়ের সংকলন’ বইটির মোড়ক উন্মোচন করেন।