পাথরের লোভে নদী ‘হত্যা’ চলছেই!
পঞ্চগড়ে একাধিক নদীর স্বাভাবিক গতিপ্রবাহ বন্ধ করে চলছে পাথর উত্তোলন। এভাবে জেলার নদীগুলোকে হত্যা করছেন একাধিক অসাধু ব্যবসায়ী।
স্থানীয়রা বলছেন, পাথর ও বালু তোলার কারণে ভবিষ্যতে মানচিত্র থেকে চিরদিনের জন্য হারিয়ে যাবে জেলার নদীগুলো। এরই মধ্যে যার প্রভাব পড়ছে কৃষিজমিতে। ব্যাহত হচ্ছে হাজার হাজার কৃষিজমির ফসল উৎপাদন। নদী ভরাট করায় খরা মৌসুমে প্লাবিত হচ্ছে উজানের এলাকা।
অসাধু কিছু পাথর ব্যবসায়ী স্থানীয় ভূমিসহ সংশ্লিষ্ট অফিসের কর্মকর্তা ও প্রশাসনের লোকজনদের ‘সহযোগিতা’ নিয়ে এভাবে নদী হত্যা করছে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, পঞ্চগড় সদর, তেঁতুলিয়া ও বোদা উপজেলার চিলকা, ভেরসা, চাওয়াই, করতোয়া, ডাহুকসহ কয়েকটি নদীর গতিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত করা হয়েছে। নদীর বুকে বালু ফেলে তোলা হচ্ছে পাথর।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, সদর উপজেলার চিলকা নদী হত্যা করে মাঝিপাড়া এলাকায় পাথর তুলছেন আমিনুর রহমান ও আমিনার রহমান নামের স্থানীয় দুই পাথর ব্যবসায়ী। নদীটির শুরু সদর উপজেলার খাসমহল এলাকায়। প্রায় ২০ কিলোমিটার প্রবাহিত হয়েছে নদীটি। পরে তেঁতুলিয়া উপজেলার মাঝিপাড়া এলাকার চাওয়াই নদীতে গিয়ে তা মিলিত হয়েছে।
ওই মিলনস্থলে চাওয়াই নদী ভরাট করে পাথর তুলছেন এলাকার রুবেল ইসলাম, ফেরদৌস আলী ও ফারুক হোসেন নামের কয়েকজন পাথর ব্যবসায়ী। এই নদীর গতি বালুর বাঁধ দিয়ে আটকে দেওয়া হয়েছে। ফলে মরতে বসেছে নদীটি।
এ বিষয়ে আমিনুর রহমান বলেন, ‘আমার ৫০০ বিঘা জমির ওপর দিয়ে চিলকা নদী প্রবাহিত হয়েছে। আমার নিজের জমিতে নদীটি। তাই আমার জমিতে যা ইচ্ছা তাই করব। এতে কারো ক্ষতি হওয়ার কিছু নেই। ’
এদিকে, তেঁতুলিয়া উপজেলার বুড়াবুড়ি ইউনিয়নের কাটাপাড়া এলাকায় ভেরসা নদীর গতিপ্রবাহ বন্ধ করে পাথর তুলছেন মনসুর আলী, ইসমাইল হোসেন, এনতাজুল হক, বোরহানউদ্দিন, নজরুল ইসলাম ও আসিরউদ্দিন। এসব পাথর ব্যবসায়ী নদী ও নদীর পাশের সরকারি মালিকানাধীন একাধিক জমি থেকেও অবৈধভাবে পাথর তুলছেন। এই নদীর গতিপ্রবাহকে বন্ধ করায় উজানে প্লাবিত হচ্ছে হাজার হাজার একর জমি।
নদী হত্যা ও পাথর উত্তোলন বন্ধে ব্যবস্থা নিতে তেঁতুলিয়ার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কাছে স্থানীয়দের গণস্বাক্ষর নেওয়া একটি অভিযোগও জমা দেওয়া হয়েছে। তবে এতে কোনো কাজ হয়নি।
তেঁতুলিয়া উপজেলার কাটাপাড়া গ্রামের আলিম উদ্দিন, মোহাম্মদ আলী, মোস্তফা কামাল, রবিউল ইসলামসহ স্থানীয় কয়েকজন জানান, পাথর তোলার কারণে বালু দিয়ে ভেরসা নদী হত্যা করা হচ্ছে। এ নদী মরে গেলে এলাকার অনেক কৃষকই পড়বেন ক্ষতির মুখে।
তেঁতুলিয়ার ইউএনও মো. সানিউল ফেরদৌস বলেন, ‘নদী থেকে পাথর ও বালু তোলার বিষয়ে অভিযোগ পেয়েছি। তদন্তও চলছে। খুব দ্রুতই দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
জেলার বোদা উপজেলার মাড়েয়া ইউনিয়নেও চলছে অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন। করতোয়া নদী থেকে ড্রেজার মেশিন দিয়ে তোলা হচ্ছে পাথর ও বালু। এসব অসাধু ব্যবসায়ী স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী ও ক্ষমতাসীন দলের হওয়ায় কেউ এর প্রতিবাদ করতে পারছেন না। নদী থেকে প্রতিদিন শত শত ট্রাকে করে বালু ও পাথর বিক্রি করছে ওই চক্র।
পঞ্চগড় পরিবেশ পরিষদের সভাপতি তৌহিদুল বারী বাবু জানান, অবৈধভাবে নদী থেকে পাথর উত্তোলন করায় নদী ভরাট হয়ে যাচ্ছে। এতে করে ক্ষতির মুখে পড়ছেন কৃষকরা। নদীর স্বাভাবিক গতি নষ্ট হলে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের আশঙ্কাও করছেন তিনি।
পঞ্চগড়ের জেলা প্রশাসক (ডিসি) অমল কৃষ্ণ মণ্ডল বলেন, ‘এই জেলার মাটিতে প্রচুর নুড়ি পাথর আছে। তাই মাটি খনন করে অনেকেই পাথর তুলছেন। তবে নদী দখল বা ভরাট করে পাথর তোলা বেআইনি। আমি বিষয়টি সম্পর্কে জানি না। যারা বেআইনিভাবে পাথর তুলছেন আমরা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব।’