গৃহকর্মীর নামে সৌদি পাঠিয়ে যৌনবৃত্তি!
দালাল বলেছিল, সৌদি আরবে গৃহপরিচারিকার কাজ করলে মাসে পাবে ২০ হাজার টাকা বেতন। বছরে একবার দেশে আসতে পারবে। পাবে দুই ঈদের বোনাস।
কিন্তু সে সব হয়নি। সৌদি আরবে ‘গৃহপরিচারিকা’র কাজে যাওয়া তরুণী দুই মাসের মাথায় ফোন করেন হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ উপজেলার গজনাইপুর ইউনিয়নের গ্রামের বাড়িতে বাবা-মায়ের কাছে। ফোন করেই বলেন, ‘আম্মা, আম্মা গো, আমারে বাঁচাও তাড়াতাড়ি। আমারে বেইজ্জতি থাইকা বাঁচাও। বাবা আমারে বাঁচাও।’
তরুণীর আধা ঘণ্টাব্যাপী মুঠোফোনের কথাবার্তা ও আত্মীয়স্বজন সূত্রে জানা গেছে, দরিদ্র বাবা-মায়ের মুখে হাসি ফোটাতে ওই তরুণী ঢাকার গ্রিন বেঙ্গল ইন্টারন্যাশনাল ট্রাভেল এজেন্সির মাধ্যমে গত ৬ ডিসেম্বর গৃহপরিচারিকার চাকরি নিয়ে সৌদি আরবের দাম্মামে যান। কিন্তু তাঁকে গৃহপরিচারিকার কোনো কাজ দেওয়া হয়নি। হবিগঞ্জ জেলার বিভিন্ন স্থানের ১৯ নারীর সঙ্গে তাঁকেও বন্দি করে রাখা হয়। সেখানকার দালাল তাদের তিন-চারদিনের জন্য একেকজন সৌদি নাগরিকের কাছে ভাড়া দেয়। এরপর শুরু হয় তাঁদের ওপর শারীরিক ও পাশবিক নির্যাতন। সেখানে তাদের উপার্জিত অর্থও দালালরা নিয়ে যায়। কেউ কোনো প্রতিবাদ জানালে তাঁকে কিল-ঘুষি-লাথি মেরে আঘাত করা হয়।
তরুণী বিষয়টি মুঠোফোনে তাঁর বাবা-মাকে জানিয়ে তাঁর উদ্ধার করার আকুতি জানান। পাশাপাশি স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যানসহ রাজনৈতিক নেতাদের কাছে যাওয়ারও পরামর্শ দেন তিনি। এরপর তরুণীর দরিদ্র বাবা-মা নেতাদের কাছে মুঠোফোনের কর্তাবার্তার আধা ঘণ্টার রেকর্ড নিয়ে দৌড়ালে তাঁরা তাঁদের মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে মামলা করতে বলেন। দেশীয় দালালদের কাছ থেকে খবর পেয়ে সৌদি আরবের দালালরা ওই তরুণীর কাছ থেকে মুঠোফোন নিয়ে যায়। পরে কোনো উপায় না পেয়ে তরুণীর বাবা-মা ও আত্মীয়স্বজন ছুটে যান হবিগঞ্জ ও সিলেট জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত সংরক্ষিত নারী সংসদ সদস্য (এমপি) অ্যাডভোকেট আমাতুল কিবরিয়া কেয়া চৌধুরীর কাছে।
এমপি কেয়া চৌধুরীর প্রচেষ্টায় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সদস্যরা আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে ঢাকা থেকে গ্রিন বেঙ্গল ইন্টারন্যাশনাল ট্র্যাভেল এজেন্সি থেকে দালাল চক্রের তিন সদস্যকে আটক করেন। আটক ব্যক্তিরা হলেন ওই ট্র্যাভেল এজেন্সির পরিচালক আবু তাহের, মো. শাহজানুর রহমান ও এরশাদ উল্লাহ। তাঁদের মধ্যে আবু তাহেরের বাড়ি হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জ পৌর এলাকায়। শাহজানুর রহমানের বাড়ি ফেনী জেলায়, এরশাদ উল্লাহর বাড়ি কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলায়।
তিনজনকে আটকের সময় গ্রিন বেঙ্গল ইন্টারন্যাশনাল ট্র্যাভেল এজেন্সির কার্যালয় থেকে হবিগঞ্জের চুনারুঘাটের এক কিশোরীকে উদ্ধার করা হয়। তিনজনকে আটকের পর তাঁদের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী সিআইডি পুলিশ আজ সৌদি আরবে বাংলাদেশ দূতাবাসের মাধ্যমে ‘গৃহপরিচারিকা’র কাজের উদ্দেশে যাওয়া ওই তরুণীকে উদ্ধার করে। এ সময় সৌদি আরবে এক দালালকেও আটক করা হয়।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ঢাকার গ্রিন বেঙ্গল ইন্টারন্যাশনাল ট্র্যাভেল এজেন্সির কর্ণধার জাকির হোসেন পাটোয়ারী। তিনি দালালদের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে তরুণীদের সৌদি আরবে গৃহপরিচারিকার চাকরি দেওয়ার কথা বলে সেখানে পাঠান। এরপর তাঁদের জোর করে যৌন ব্যবসায় নিযুক্ত করেন। নবীগঞ্জ উপজেলার গজনাইপুর ইউনিয়নের ওই তরুণীকে সৌদি আরবে যাওয়ার প্রলোভন দিয়েছিলেন পাশের গ্রামের শেকুল আহমেদ। তিনি মাসে ২০ হাজার টাকা বেতন, বছরে একবার দেশে আসার সুযোগ ও দুই ঈদ বোনাসের প্রলোভন দেন তরুণীর পরিবারকে। প্রলোভনে রাজি হলে দালাল শেকুল আহমেদ ওই তরুণীর পাসপোর্ট করে তাঁকে ঢাকায় এক মাসের প্রশিক্ষণ দিয়ে সৌদি আরবে পাঠান।
এমপি আমাতুল কিবরিয়া কেয়া চৌধুরী এনটিভি অনলাইনকে জানান, গত ১৩ ফেব্রুয়ারি রাতে ওই তরুণীর মা-বাবা তাঁর কাছে আসেন। টেলিফোনে রেকর্ড হওয়া কথা শুনে তিনি আঁতকে ওঠেন। তিনি তাদের মামলা করার পরামর্শ দিলে ১৪ ফেব্রুয়ারি নবীগঞ্জ থানায় মামলা করে তরুণীর পরিবার। পরে তিনি সেই অডিও টেপ নেন নিজের মোবাইলে। বিষয়টি নিয়ে কথা বলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও পরিকল্পনা মন্ত্রীর সঙ্গে। পরে হবিগঞ্জের পুলিশ সুপার জয়দেব কুমার ভদ্রের পরামর্শে ঢাকায় সিআইডির সঙ্গে যোগাযোগ করলে সিআইডির কর্মকর্তা শাহ আলম বৃহস্পতিবার দুপুরে তিন দালালকে গ্রেপ্তার করেন। এ সময় পাচারের অপেক্ষায় থাকা চুনারুঘাটের ১৩ বছরের এক কিশোরীকে উদ্ধার করা হয়। জব্দ করা হয় ২৫টি পাসপোর্ট, রেজিস্ট্রার খাতা ও মোবাইল নম্বর। পাশাপাশি সৌদি আরবের বাংলাদেশ দূতাবাসের সহায়তায় ওই তরুণীকে উদ্ধার এবং সেখানকার এক দালালকেও আটক করা হয়।
কেয়া চৌধুরী আরো জানান, সৌদি আরবে এ ধরনের পাচার হওয়া তরুণী ও কিশোরীদের সন্ধান চালাচ্ছে সিআইডি।
হবিগঞ্জ সিআইডির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুর রাজ্জাক জানান, ঢাকা থেকে সিআইডির একটি টিম এই অভিযান পরিচালনা করেছে। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় গ্রেপ্তার হওয়া তিনজনকে হবিগঞ্জ আদালতে হাজির করা হয়। জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম নিশাত সুলতানা তাঁদের কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।