সাতক্ষীরায় জামায়াতের সাবেক সাংসদ গ্রেপ্তার
সাতক্ষীরা জেলা জামায়াতের আমির সাবেক সংসদ সদস্য অধ্যক্ষ মাওলানা আবদুল খালেক মণ্ডলকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। আজ মঙ্গলবার ভোরে সদর উপজেলার খলিলনগর মহিলা মাদ্রাসা থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। নাশকতার লক্ষ্যে তিনি সেখানে কয়েকজন সহযোগীকে নিয়ে গোপন বৈঠক করছিলেন বলে পুলিশ দাবি করেছে।
জেলা পুলিশের তথ্য কর্মকর্তা উপপরিদর্শক (এসআই) কামাল হোসেন জানান, মাওলানা আবদুল খালেক নাশকতা সৃষ্টির উদ্দেশে গোপন বৈঠক করছেন এমন খবর পেয়ে পুলিশের একটি দল খলিলনগর মহিলা মাদ্রাসায় যায়। এ সময় পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে আব্দুল খালেকের সহযোগীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে কয়েক রাউন্ড গুলি ছোড়ে। পুলিশও পাল্টা গুলি ছোড়ে। একপর্যায়ে তার সহযোগীরা পালিয়ে গেলেও ঘটনাস্থল থেকে আব্দুল খালেককে গ্রেপ্তার করা হয়। এ সময় তাঁর কাছ থেকে একটি বিদেশি পিস্তল ও দুই রাউন্ড গুলি উদ্ধার করা হয় বলে জানান এসআই।
চলতি বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় খলিলনগর মাদ্রাসায় সহকর্মীদের নিয়ে গোপন বৈঠক চলাকালে গ্রেপ্তার হন মওলানা আবদুল খালেক। তাঁর বিরুদ্ধে ১৫টি মামলা রয়েছে। এসব মামলায় সম্প্রতি তিনি উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়ে বাড়ি ফিরে আসেন এবং আবারও নাশকতা ও সহিংসতার লক্ষ্যে জামায়াত ও শিবিরকর্মীদের সংগঠিত করতে থাকেন বলে জানান এসআই কামাল হোসেন।
জামায়াতের প্রতিবাদ ও দাবি : আবদুল খালেককে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদ ও নিন্দা জানিয়েছে জামায়াত। আজ মঙ্গলবার মাওলানা খালেকের স্ত্রী লাইলি বেগম ও দলের জেলা প্রচার সম্পাদক আজিজুর রহমান এক বিবৃতিতে এই প্রতিবাদ জানিয়ে বলেন, গত ৮ ফেব্রুয়ারি খালেককে গ্রেপ্তারের পর থেকে তিনি যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক ছিলেন। তিনি ১৫টি মামলায় উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়ে শনিবার সন্ধ্যায় জেল গেটের বাইরে আসতেই গোয়েন্দা পুলিশ তাঁকে ফের গ্রেপ্তার করে।
বিবৃতিতে বলা হয়, চারদিন সাতক্ষীরা গোয়েন্দা পুলিশের হেফাজতে গোপনে রাখার পর মঙ্গলবার ভোরে আবদুল খালেককে অস্ত্রসহ গ্রেপ্তারের মিথ্যা নাটক সাজিয়েছে পুলিশ। তাঁরা খালেকের মুক্তি দাবি করেন।
খালেকের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধে হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ : জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, জেলা জামায়াতের শীর্ষ নেতা আবদুল খালেক জামায়াতের কেন্দ্রীয় সুরা সদস্য। সাতক্ষীরায় তাঁর বিরুদ্ধে জঙ্গি সংঠনের অভিযোগ রয়েছে। ১৯৭১ সালে রাজাকার বাহিনীর নেতৃত্ব দিয়ে কয়েকটি হত্যাসহ হিন্দু পরিবারের জমি ও বাড়ি দখল করেন তিনি। ১৯৭১ সালে শিমুলবাড়িয়া গ্রামের রুস্তম আলীসহ পাঁচজনকে হত্যার দায়ে ২০০৯ সালের ২ জুলাই তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের মামলা করেন নজরুল ইসলাম গাজী। মামলাটি এখনো আন্তর্জাতিক মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইবুনালে বিচারাধীন রয়েছে।
এ ছাড়া একাত্তরে কাথন্ডা গ্রামের আবুল হোসেন গাজী, একই এলাকার অহেদ আলী, বলদঘাটার সামসুর রহমান, খলিলনগরের মনসুর সরদার ও ঘোনা বাঁশিয়াপাড়ার তাহের আলীর ছেলেকে হত্যার অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। একই সময়ে সাতজন মুক্তিযোদ্ধাকে নির্মমভাবে নির্যাতনের অভিযোগও আছে। তাঁর নেতৃত্বে সীমান্ত ঘেঁষা গ্রাম বৈকারি, সাতানি, কাথন্ডা ও ভাদড়ায় বহু বাংকার খনন করে হিন্দু নারী পুরুষ ও শিশুদের হত্যা করে মাটিচাপা দেওয়া হয়। ১৯৭১ সালের এপ্রিলে শহরের কাটিয়ায় দীনেশ কর্মকারের বাড়িতে অগণিত শরণার্থীকে হত্যা করে মাটিচাপা দেওয়ার নেতৃত্ব দেওয়ারও অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। বাংকার খুঁড়তে আপত্তি করায় খলিলনগরের ইমান আলীকে তাঁর নির্দেশে হত্যা করা হয় বলেও জানা যায়।
জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মোশাররফ হোসেন মশু জানান, শহরের সুলতানপুরে ডায়মন্ড হোটেল দখল করে মাওলানা খালেক টর্চার সেল গড়ে তোলেন। এরপর থেকে মাওলানা খালেক জল্লাদ খালেক হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। সাতক্ষীরা শহরের একটি হিন্দু পরিবারের বাড়ি ও জমি দখল করে নেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি প্রথম সাতক্ষীরায় দালাল আইনে গ্রেপ্তার হন।
পুলিশ থেকে জানা গেছে, মাওলানা খালেক ১৯৮৮ সালে বৈকারি ইউপি চেয়ারম্যান ও ১৯৯০ সালে সাতক্ষীরা সদর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ১৯৯৪ সালের ২৯ মার্চ জামায়াত নেতা গোলাম আযমের সাতক্ষীরায় প্রথম প্রকাশ্য সফরকালে জনসভার আয়োজনে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন মাওলানা খালেক।
জানা যায়, ১৯৯৭ সালের ১৭ মে মাওলানা খালেকের বাড়িতে জেএমবির প্রথম মসলিসে সুরার বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ২০০১ সালের অষ্টম সংসদীয় নির্বাচনে তিনি সাতক্ষীরা সদর আসনের জামায়াত দলীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট সিরিজ বোমা হামলার নেপথ্য নায়ক হিসেবেও অভিযোগ ওঠে তাঁর নামে।
সাতক্ষীরা সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এমদাদ শেখ জানান, কাদের মোল্লা, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, গোলাম আযম, মীর কাসেম আলী, মতিউর রহমান নিজামীসহ প্রত্যেক যুদ্ধাপরাধীর বিচারের রায় ঘোষণার পর আবদুল খালেক জামায়াতকে সংগঠিত করে সহিংসতা, নাশকতা, হত্যা, বাড়ি-গাড়িতে অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর, গাছকাটা, সড়ক অবরোধ, সড়ক বিচ্ছিন্নকরণ এবং পুলিশের ওপর হামলার সব ঘটনার নেতৃত্ব দেন।
পুলিশ জানায়, সাতক্ষীরা আগরদাঁড়ি মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল হিসেবে সেখানে জামায়াতের দুর্ভেদ্য ঘাঁটি গড়ে তোলেন আব্দুল খালেক। এ কারণে আগরদাঁড়ি কামিল মাদ্রাসা কিছুদিন আগ পর্যন্তও জামায়াতের ক্যান্টনমেন্ট হিসেবে পরিচিত ছিল। পুলিশ, বিজিবি, র্যাব জামায়াত অধ্যুষিত এ এলাকায় কোনো অভিযানে গিয়ে মামলার আসামি ধরে বের হয়ে আসতে পারত না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে মধ্য রাতে মসজিদের মাইকে ডাকাত হিসেবে আখ্যায়িত করে সড়কে গাছের বড় বড় গুঁড়ি ফেলে শত শত মানুষ জোগাড় করে তাদের বহুবার অবরুদ্ধ করে রাখার নেপথ্য নায়কও তিনি ।
পুলিশের তথ্য কর্মকর্তা কামাল হোসেন আরো জানান, ২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে জামায়াতের তাণ্ডবে সিটি কলেজ প্রভাষক মামুনসহ যে ২০ জন নিরীহ মানুষ নির্মম হত্যার শিকার হন তারও নেপথ্যে ছিলেন মাওলানা খালেক । ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম সংসদ নির্বাচন বাধাগ্রস্ত করতে তিনি জামায়াত সমর্থিতদের সংগঠিত করেন এবং কয়েকটি এলাকায় মানুষকে ভোটবর্জন করতে উদ্বুদ্ধ করেন।
সাতক্ষীরা সদর উপজেলার সীমান্তবর্তী গ্রাম বৈকারি ইউনিয়নের খলিলনগর গ্রামের খালেক মণ্ডল ১৯৬৫ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে সাতক্ষীরার আগরদাঁড়ি কামিল মাদ্রাসায় যোগ দেন। ১৯৭০ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে মাওলানা খালেক জামায়াতদলীয় প্রার্থীর পক্ষে কাজ করেন। আগরদাঁড়ি মাদ্রাসায় টানা ৩২ বছর অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালনের পর তিনি অবসরে যান।