চিংড়ি ঘেরে সাতক্ষীরায় জলাবদ্ধতার আশঙ্কা
চিংড়ি চাষের জন্য সাতক্ষীরার মাছখোলার দোফসলি ডাইয়ের বিল ছোট-বড় বেড়িবাঁধ দিয়ে ঘিরে ফেলেছেন কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তি। দখল হয়ে যাচ্ছে সরকারি খাস খালটিও। কৃষিজমিতে নোনা পানি ঢুকিয়ে চিংড়ি চাষে সরকারের নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও এই ঘেরে বিলের চারধারের পাঁচটি ইউনিয়নের ৩০টি গ্রামের তিন লাখ মানুষ এখন জলাবদ্ধতার আশঙ্কায় রয়েছেন। তাঁরা জেলা প্রশাসকের কাছে এর প্রতিবাদ জানিয়ে গতকাল বুধবার একটি স্মারকলিপি দিয়েছেন।
গ্রামবাসীর দেওয়া স্মারকলিপিতে বলা হয়েছে, ‘অচিরেই এই বেড়িবাঁধ অপসারণ না করা হলে সাতক্ষীরা পৌরসভাসহ ধূলিহর, লাবসা, বল্লী ও ব্রহ্মরাজপুর ইউনিয়নের তিন লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়বেন।’
সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান নারী নেত্রী অ্যাডভোকেট শাহনাজ পারভীন মিলি বলেন, ‘চিংড়ি চাষের নীতিমালা না মেনেই এই বেড়িবাঁধ দেওয়া হয়েছে। এতে কিছু মানুষ চিংড়িসম্পদ নিয়ে ঘরে উঠবেন আর হাজার হাজার মানুষ অবর্ণনীয় কষ্টের মধ্যে থাকবেন। তাঁরা হারাবেন বার্ষিক দুটি ফসল।’ তিনি আরো বলেন, ‘চারপাশে বেড়িবাঁধ দিয়ে নোনা পানি ঢুকিয়ে চিংড়ি চাষ শুরু হয়েছে। বেড়িবাঁধের কারণে বহু কালভার্ট অকেজো হয়ে পড়েছে। হাজার হাজার কৃষক হয়ে পড়েছেন কর্মহীন।’
শাহনাজ পারভীন মিলির নেতৃত্বেই স্মারকলিপিটি জেলা প্রশাসকের কাছে দেওয়া হয়েছে।
এলাকাবাসী জানান, মাছখোলার আবদুর রহমান, রাজারবাগানের সিরাজুল, জাহাঙ্গীর, আনসার আলী ও নূর আলী, বদ্দিপুরের বাবু, ঘুড্ডের ডাঙ্গির আইয়ুবসহ বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তি পরিকল্পিতভাবে মাত্র এক মাসের মধ্যে ছয় হাজার বিঘার এই বিল বেড়িবাঁধ দিয়ে ঘিরে ফেলেছে। সামান্য বৃষ্টি হলেই কিছু কিছু এলাকায় পানি জমে। চলতি বর্ষা মৌসুমে জলমগ্নতার সংকট কীভাবে কাটিয়ে উঠবেন, তা নিয়ে এখনই ভাবনায় পড়েছেন তাঁরা।
বিনা অনুমতিতে বেড়িবাঁধ দিয়ে পানিনিষ্কাশন বন্ধ করে চিংড়ি চাষ করা যায় কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে বেড়িবাঁধ স্থাপনকারীরা বলেন, ‘এ ব্যাপারে আমরা প্রশাসনকে ম্যানেজ করে নিয়েছি। এতে কারো কিছু বলার সুযোগ নেই।’
কৃষিজমিতে নোনা পানি ঢুকিয়ে চিংড়ি চাষে সরকারের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এমনকি চিংড়ি চাষ করতে হলে ৮০ শতাংশ জমির মালিকের সম্মতি, পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমতি, জেলা মৎস্য বিভাগ, প্রাণিসম্পদ বিভাগের রিপোর্টসহ কয়েকটি জরুরি রিপোর্ট প্রয়োজন। তা ছাড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার, জেলা প্রশাসক এবং বিভাগীয় কমিশনারের অনুমতিও নিতে হয়। কোনোটিই তাঁদের নেই।
এদিকে, বেড়িবাঁধ দিয়ে নোনা পানি ঢুকিয়ে চিংড়ি চাষ করায় এলাকার বৃক্ষসম্পদ হুমকির মুখে পড়েছে। গো-খাদ্যের অভাবে গবাদিপশু গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি পালনও বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। দেখা দিয়েছে গরুর দুধের সংকট। এলাকায় পরিবেশগত ভারসাম্যও বিনষ্ট হয়ে পড়েছে।
৩০ গ্রামের পানি সরানোর পথ বন্ধ হয়ে গেছে। আর এসব ব্যাপারে প্রশাসনের একশ্রেণির দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশ রয়েছে বলে জেলা প্রশাসককে দেওয়া স্মারকলিপিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
ভুক্তভোগী গ্রামবাসী আরো জানান, জলাভূমিকে জলাশয় দেখিয়ে বন্দোবস্ত দেওয়ার তৎপরতা চলছে। এতে সাতক্ষীরা জেলা জলাবদ্ধ হয়ে পড়তে পারে—এমন আশঙ্কা দিন দিন প্রকট হচ্ছে।
বেড়িবাঁধ দেওয়ার প্রতিবাদ জানিয়ে গ্রামবাসী সাতক্ষীরা সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কাছেও একটি লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। স্থানীয় তহশিলদার রফিকুল ইসলাম জানান, তিনি ইউএনওর নির্দেশে সরেজমিনে তদন্ত করে অভিযোগের সত্যতা পেয়েছেন। সরকারি খালটিও দখল করে নেওয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে তিনি ইউএনও বরাবর লিখিত প্রতিবেদন পেশ করেছেন বলে জানিয়েছেন।
সাতক্ষীরা জেলা নাগরিক কমিটির এক সমাবেশে এই ঘেরের প্রতিবাদ জানানো হয়। নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক বীর মুক্তিযোদ্ধা কাজী রিয়াজের সভাপতিত্বে স্থানীয় ‘স্বদেশ’ কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সমাবেশে বক্তারা বেড়ি অপসারণের দাবি জানিয়ে বলেন, ‘অন্যথায় জেলায় এর বিরুদ্ধে গণআন্দোলন গড়ে তোলা হবে।’ তাঁরা এ ব্যাপারে আগ্রহী ঘের মালিক ও প্রশাসনের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের চিহ্ণিত করে তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানান।
এদিকে, স্মারকলিপি পেয়ে জেলা প্রশাসক মো. নাজমুল আহসান বলেন, ‘এ ব্যাপারে আরো তদন্ত করে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ আগামী রোববার তিনি এ ব্যাপারে গ্রামবাসী ও বেড়িবাঁধ নির্মাণকারীদের সঙ্গে মতবিনিময় করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন বলে জানিয়েছেন।