মিয়ানমারে বেপরোয়া মাদক সাম্রাজ্য বিপদ বাড়াচ্ছে বাংলাদেশের
জান্তা ও বিদ্রোহী গোষ্ঠীর মধ্যকার তিন বছরের বেশি সময় ধরে চলা গৃহযুদ্ধের সুযোগ কাজে লাগিয়ে মিয়ানমারের সবচেয়ে বড় প্রদেশ শান রাজ্য হয়ে উঠেছে মাদক কারবারিদের তীর্থভূমি। আর তাদের কর্মচঞ্চল্যে সবচেয়ে বড় ঝুঁকিতে রয়েছে প্রতিবেশী বাংলাদেশ।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশে ইয়াবার সবচেয়ে বড় চালান আসে শান রাজ্য থেকে। ইয়াবার পাশাপাশি ওই রাজ্যে একরকম বিনা বাধায় উৎপাদিত হচ্ছে ভয়ঙ্কর মাদক ক্রিস্টাল মেথ (আইস) ও হেরোইন। এতদিন বাংলাদেশে আইসের মতো মাদকের বিস্তৃতি না থাকলেও সম্প্রতি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে প্রায়ই জব্দ হচ্ছে সিনথেটিক এ মাদকের চালান।
সর্বশেষ গত বছরের নভেম্বরে টেকনাফের শাহপরীরদ্বীপ থেকে পাঁচ কোটি টাকা মূল্যের এক কেজি আইস জব্দ করে কোস্টগার্ড। তার আগে আগস্টে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) অভিযানে টেকনাফ ও বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্ত থেকে ২১ কোটি টাকা মূল্যের আইস ও ইয়াবার বড় চালান জব্দ হয়।
২০২৩ সালের পর ২০২৪ সালেও জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধ বিষয়ক সংস্থা ইউএনওডিসির প্রতিবেদনে আফিম উৎপাদনে শীর্ষ দেশ হিসেবে মিয়ানমারের নাম দেখা যায়। শান রাজ্যের পাহাড়ি ঢালে চাষ হয় পপি, যার আঞ্চলিক নাম পিস ফ্লাওয়ার বা শান্তির ফুল। এই পপি ফুল থেকেই নানা প্রক্রিয়ায় প্রস্তুত হয় হেরোইন। হেরোইনের পাশাপাশি এই রাজ্যে গড়ে উঠেছে অর্ধশতাধিক ইয়াবা ও আইস কারখানা। এতদিন মিয়ানমারে ইয়াবা তৈরির ৩৭টি কারখানার খোঁজ পাওয়া গেলেও গৃহযুদ্ধের সুযোগ কাজে লাগিয়ে গত কয়েক বছরে এই সংখ্যা পঞ্চাশ ছাড়িয়েছে।
ভৌগলিকভাবে শান রাজ্যের সীমান্তবর্তী দেশ চীন, থাইল্যান্ড ও লাওস। ইয়াবা তৈরির প্রধান কাঁচামাল মেথামফেটামিন ও ক্যাফেইনের বড় জোগান আসে গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেলে অবস্থিত থাইল্যান্ড ও লাওস থেকে। এ ছাড়া আইস তৈরির আরেক কাঁচামাল এফিড্রিনের বড় সরবরাহক চীনের মাদক কারবারিরা। অনেক সময় ভারত থেকেও আসে কাঁচামালের চালান। সব মিলিয়ে প্রস্তুতকারক হিসেবে শান রাজ্যের কারখানাগুলোতে চলে মাদকের রমরমা উৎপাদন।
মার্কিন সংবাদমাধ্যম দ্য নিউইয়র্ক টাইমসের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে শান রাজ্যকে যুদ্ধবাজ নেতা, চোরাকারবারি ও মাদকব্যবসায়ীদের সবচেয়ে বড় কেন্দ্র বলে উল্লেখ করা হয়েছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মাদকের কেন্দ্রভূমি এ রাজ্যটিতে এতদিন সরকারের চোখ ফাঁকি দিয়ে এবং নানা সময়ে স্থানীয়, এমনকি দেশটির কেন্দ্রীয় পর্যায়ের নেতাদের উৎকোচ প্রদানের মাধ্যমে ব্যবসা পরিচালনা করতেন মাদক কারবারিরা। তবে বর্তমানে সরাসরি বিদ্রোহী গোষ্ঠীর পৃষ্ঠপোষকতায় উৎপন্ন হচ্ছে ভয়ঙ্কর এসব নেশাদ্রব্য।
সংবাদমাধ্যমটিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মাদক কারবারিরা জানান, বর্তমানে এখানকার (মিয়ানমারের) সরকার ব্যবস্থা একরকম ভেঙে পড়েছে। শান রাজ্যে একাধিক বিদ্রোহী সশস্ত্র সংগঠনের যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পর্যাপ্ত অর্থের প্রয়োজন। সশস্ত্র গোষ্ঠীর অর্থের মূল জোগান আসছে মাদক থেকে। তাদের তথ্য অনুসারে, ব্যবসা রমরমা হওয়ায় বেড়েছে প্রতিযোগিতা। এতে করে উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে ইয়াবা, আইস ও হেরোইনের দাম। যেখানে দেশটিতে এক ক্যান বিয়ারের দাম ১০ ডলার, সেখানে প্রতি পিস ইয়াবা বিক্রি হচ্ছে মাত্র ২৫ সেন্টে।
বাংলাদেশে বিস্তার
২০০৬ সালে বাংলাদেশের বাজারে প্রতি পিস ইয়াবা বিক্রি হতো ১ হাজার ২০০ টাকার ওপরে। সহজলভ্য হওয়ায় ২০২৩ সালে এর দাম নেমে আসে ৩০০ টাকায়। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বর্তমানে কক্সবাজারে মাদক ব্যবসায়ীরা প্রতি পিস ইয়াবা বিক্রি করেন ১০০ থেকে ১২০ টাকায়। রাজধানীতে তা বিক্রি হচ্ছে ২০০ থেকে ২৫০ টাকায়।
মিয়ানমার হয়ে বাংলাদেশের বাজারে আসা এসব ইয়াবার চালান নিয়ন্ত্রণে রীতিমতো বেগ পেতে হচ্ছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে। অধিদপ্তরের মহাপরিচালক খোন্দকার মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বাংলাদেশে ইয়াবার প্রায় পুরো চালান আসে মিয়ানমার থেকে। টেকনাফ হয়ে তা দেশের বিভিন্ন শহরে ছড়িয়ে পড়ে। ইয়াবার সঙ্গে সঙ্গে কারবারিরা আইস ও হেরোইনের চালানও পাঠাচ্ছে। প্রতিনিয়ত এরা মাদক পাচারে অভিনব সব পন্থা ব্যবহার করছে। প্রতি মাসেই পরিবর্তন হচ্ছে মাদক পাচারের রুট।
অধিদপ্তরের গোয়েন্দা তথ্য বলছে, ইয়াবা ও আইসের জন্য রাজধানীতে আলাদা আলাদা হটস্পট আছে। ঢাকার রেল স্টেশন, বাস টার্মিনাল ও লঞ্চঘাট এলাকা ইয়াবা কারবারিদের তৎপরতা বেশি। এর বাইরে মোহাম্মদপুর জেনেভা ক্যাম্প, মিরপুর কালশী, পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকা, কামরাঙ্গীরচর ও কারওয়ানবাজার এলাকায় ডজনখানেক সক্রিয় চক্র ইয়াবা কারবারের সঙ্গে জড়িত।
আইসের দাম বেশি হওয়ায় অভিজাত এলাকাগুলোতে এর বিস্তার বেড়েছে। গুলশান, বনানী ও উত্তরার মতো এলাকায় বর্তমানে কয়েকটি চক্র আইস বিক্রির সঙ্গে জড়িত। এদের অনেকেই নিরাপদ মাধ্যম হিসেবে অনলাইন ক্রয়-বিক্রয়কে বেছে নিয়েছে। অনেকের ধারণা, ইয়াবা ও গাঁজার আধিক্যে দেশে হেরোইনের ব্যবহার কমে গেছে। তবে অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে আবারও নতুন করে হেরোইনের বিস্তার শুরু হয়েছে। বিশেষ করে, মিয়ানমার থেকে প্রতিনিয়ত কমবেশি হেরোইনের চালান দেশে প্রবেশ করছে বলে জানান মোস্তাফিজুর রহমান।
আশির দশকে বাংলাদেশে হেরোইনের বিস্তার ছিল ভয়াবহ। পরবর্তীতে ২০০০ সালের পর ফেনসিডিল এবং ২০১০ এর পর ইয়াবার প্রধান্যে হেরোইনের ব্যবহার অনেকটাই হ্রাস পায়। তবে বিগত চার বছর ধরে দেশের সীমান্তবর্তী এলাকায় নতুন করে হেরোইনের চালান বাড়তে শুরু করেছে।
২০২০ সালে বিভিন্ন সরকারি বাহিনীর অভিযানে উদ্ধারকৃত হেরোইনের পরিমাণ ছিল ২১০ কেজি, যা ২০২৩ সালে বেড়ে ৭০০ কেজি ছাড়ায়। সর্বশেষ হিসাব অনুসারে, ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত দেশে ৩৫৭ কেজির বেশি হেরোইন জব্দ হয়েছে।
মিয়ানমারে আফিম চাষ বেড়ে যাওয়ায় সম্প্রতি বাংলাদেশে হেরোইন প্রবেশের পরিমাণ বেড়েছে বলে ধারণা সংশ্লিষ্টদের। তাদের মতে, শুধু টেকনাফ সীমান্ত ব্যবহার না করে হেরোইন পাচারকারীদের অনেকেই রুট হিসেবে বেছে নিয়েছে ভারতকে।
সমাধান কী?
মাদকের বিস্তার রোধে সরকারের পক্ষ থেকে বারবার ‘জিরো টলারেন্স’ নীতির কথা বললেও আদতে এতটা কঠোর অবস্থানে সরকার নেই বলে মনে করেন অপরাধ বিশ্লেষকরা।
ইউএনওডিসির গবেষণা অনুযায়ী, একটি দেশে যে পরিমাণ মাদক প্রবেশ করে তার ৯০ শতাংশই বাজারে ছড়িয়ে পড়ে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গোচরে আসে মাত্র ১০ শতাংশ। সেই হিসাবে পাশ্ববর্তী দেশ মিয়ানমার হয়ে আসা মাদকে দিনকে দিন নেশাদ্রব্যের ভয়াবহ বিস্তার ঘটছে বাংলাদেশে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, জাতিসংঘ ১০ শতাংশ মাদক জব্দের কথা বললেও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এ পরিমাণ আরও কম। বাংলাদেশে ইয়াবাসহ অন্যান্য মাদক আগের তুলনায় অনেক সহজলভ্য হয়ে উঠেছে। মাদক যখন সহজলভ্য হবে তখন এর বিস্তার বাড়বে—এটাই স্বাভাবিক।
মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে যাতে কোনোভাবেই ইয়াবা, আইস বা হেরোইনের মতো মাদক প্রবেশ করতে না পারে, সেজন্য সীমান্তে সর্বোচ্চ সতর্কতা জারি করার ওপর জোর দেন এ বিশেষজ্ঞ।