অবশেষে ‘ডানহাত’ গ্রেপ্তার
নিজেকে সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকুর ডানহাত বলে পরিচয় দিতেন তিনি। পাবনাসহ বিভিন্ন এলাকায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ব্যবসা করতেন। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের অনুমোদন না থাকলেও তিনি নিজেকে ‘শেখ রাসেল বিশ্ববিদ্যালয়’ নামের এক বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ারম্যান দাবি করতেন। ২২টি সাইনবোর্ড-সর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের নামে প্রায় অর্ধশত কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ আছে তাঁর নামে। ওই ব্যক্তির নাম মোল্লা মো. কফিল।
আয়বহির্ভূত সম্পদ থাকার অভিযোগে আজ রোববার মোল্লা মো. কফিলকে (৪৫) গ্রেপ্তার করেছেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কর্মকর্তারা। কফিলের বিরুদ্ধে দুটি মামলা করেছে দুদক। দুদকের উপপরিচালক মামুন ইসলাম ও সহকারী পরিচালক রবীন্দ্রনাথ চাকীর নেতৃত্বে দুদক সদস্যরা আজ রোববার দুপুরে পাবনা শহরের চাঁদাখার বাঁশতলা এলাকা থেকে কফিলকে গ্রেপ্তার করেন।
পরে পাবনা সদর থানার মাধ্যমে কফিলকে আদালতে পাঠানো হয়। পাবনার আমলি আদালতের বিচারক মো. কামরুল হাসান খান কফিলকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
দুদকের সহকারী পরিচালক রবীন্দ্রনাথ চাকী জানান, কফিল পাবনার বেড়া উপজেলার বাসিন্দা। তিনি তাঁর নামের আগে ডক্টরেট বসান। কোন স্থান থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি পেয়েছেন তাও কেউ জানেন না। এ ছাড়া মোল্লা কফিল বিভিন্ন সময় বিভিন্ন স্বনামখ্যাত ব্যক্তির নাম-পরিচয় ব্যবহার করে দীর্ঘদিন ধরে প্রতারণা করে আসছিলেন। সাবেক মন্ত্রী ও জামায়াতে ইসলামীর আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর হাত ধরে তাঁর উত্থান ঘটে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট শামসুল হক টুকুর নাম ব্যবহার করেন। এর পর থেকেই বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ার নামে চুটিয়ে ব্যবসা করে আসছিলেন। তিনি পাবনা শহরের সিংগায় প্যারামেডিকেল কলেজ, বিএড কলেজ, এমএড কলেজ, টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, নার্সিং ট্রেনিং ইনস্টিটিউট কলেজ, সাঁথিয়া উপজেলার বিষ্ণুপুরে কথিত শেখ রাসেল বিশ্ববিদ্যালয় এবং মুসলিম কমিউনিটি মেডিকেল কলেজ, নাটোর টেকনিক্যাল কলেজসহ বিভিন্ন কথিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সিরাজগঞ্জ, বেড়া, সাঁথিয়াসহ নানা স্থানে অসংখ্য নাম ও প্যাডস্বর্বস্ব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তৈরির কথা বলে মানুষজনের সঙ্গে প্রতারণা করে আসছিলেন। এভাবে মোল্লা কফিল শিক্ষার্থী ও বিভিন্ন উদ্যোক্তার কাছ থেকে প্রায় অর্ধশত কোটি টাকা হাতিয়ে নেন। সাঁথিয়া উপজেলার বিষ্ণুপুরে একসময়ের বিখ্যাত সমতা অফিস ভাড়া নিয়ে পরে ওই ভবন এবং সমস্ত জমি নিজের বলে দাবি করে বসেন, এমনকি সমতার চেয়ারম্যান হিসেবে নিজেকে ঘোষণা দেন।
রবীন্দ্রনাথ চাকী আরো জানান, পাবনা শহরের সিংগা এলাকায় মুজিব প্যালেস নামের একটি ভবন ভাড়া নিয়ে নানা অপকর্ম করতে থাকেন মোল্লা কফিল। এসব বিষয়ে দুদকে লিখিত অভিযোগ এলে দুদক প্রাথমিক অনুসন্ধানে অভিযোগের সত্যতা পায়। পরে এ ব্যাপারে পাবনা সদর থানায় মোল্লা কফিলের বিরুদ্ধে একটি এবং স্ত্রী মাহমুদুন্নাহারসহ আরেকটি মামলা করা হয়। এ মামলা দুটিতে দুদক তাঁকে গ্রেপ্তার করে।
রবীন্দ্রনাথ চাকি জানান, সম্পদের হিসাব চাইলে মোল্লা কফিল এক লাখ টাকার সম্পদ আছে বলে দুদকে হিসাব দাখিল করেন। কিন্তু দুদক কফিলের ৩৫ লাখ টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদের সন্ধান পায়। কফিলের স্ত্রী মাহমুদুন্নাহারের সম্পদের হিসাব চাইলে কফিল ৩৫ লাখ টাকার সম্পদের হিসাব দেখান। কিন্তু অনুসন্ধানে দেখা গেছে, মোল্লা কফিলের স্ত্রীর জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ রয়েছে ৪৩ লাখ টাকার।
কফিলের বিরুদ্ধে নানা রকম আর্থিক অনিয়মের অভিযোগে সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশনের উচ্চপর্যায়ের তদন্ত দল তদন্ত করে এবং তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদও করে।
এদিকে আওয়ামী লীগের একাধিক নেতাসহ বিভিন্ন সূত্র জানায়, মোল্লা কফিল নিজেকে সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকুর ডানহাত হিসেবে পরিচয় দিতেন। তাঁর নাম ব্যবহার করে উচ্চশিক্ষার নামে প্রতারণামূলক ব্যবসা করে বিপুল অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেন কফিল। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের অনুমোদন না থাকলেও ‘শেখ রাসেল বিশ্ববিদ্যালয়’ নামের এক প্রতিষ্ঠানের স্বঘোষিত চেয়ারম্যান হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিতেন। উপাচার্য নিয়োগ দেওয়ার ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির থাকলেও পাবনার এডওয়ার্ড বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আবদুস সালামকে ওই প্রতিষ্ঠানের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেন।
পাবনা আদালতের দায়িত্বে নিয়োজিত উপপরিদর্শক (সিএসআই) মো. আব্দুল আওয়াল জানান, দুদক সদস্যরা মোল্লা কফিলকে গ্রেপ্তার করে পাবনা থানার মাধ্যমে আদালতে নিয়ে এলে বিচারক কামরুল হাসান খান কফিলকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।