রাজশাহী অঞ্চলে রেকর্ড আম উৎপাদনের আশা
রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা প্রশাসন অপরিপক্ব আমের বাজারজাত ঠেকাতে এ বছর গাছ থেকে আম নামানোর তারিখ নির্ধারণ করে দিয়েছিল। কিন্তু সেই তারিখ অনুযায়ী এবার আম পাকেনি। রাজশাহীতে গোপালভোগ আম নামানোর তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছিল ২০ মে, আর চাঁপাইনবাবগঞ্জে ২৫ মে। এক সপ্তাহেরও বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও অন্যান্য বছর এই সময়ে যেভাবে গোপালভোগ আমে একাকার হয়ে যায় রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের বাজার, এ বছর তা হয়নি। এখনো গোপালভোগ আমের পর্যাপ্ত সরবরাহ নেই এ দুটি জেলার আম বাজারে।
আমচাষি ও ব্যবসায়ীরা জানায়, আম পাকে প্রকৃতির নিয়মে। প্রশাসনের নির্ধারিত সময়সীমা মানতে তো সে বাধ্য নয়। প্রশাসন সময় বেঁধে দিলেও গাছে আম পরিপক্ব না হওয়ায় গাছ থেকে পর্যাপ্ত আম পাড়তে পারছেন না আম বিক্রেতারা।
এ বছর আম পাকতে দেরি হওয়ার কারণ কী, জানতে চাইলে রাজশাহী ফল গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. আলীম উদ্দিন জানান, রাজশাহীতে অন্যান্য বছরের চেয়ে এ বছর গরম অপেক্ষাকৃত কম। রাজশাহীতে বছরের সবচেয়ে উষ্ণ মাস থাকে এপ্রিল মাস। অথচ এ বছর এপ্রিল মাসেও রাতে রাজশাহীবাসীকে হালকা কাঁথা গায়ে দিয়ে থাকতে হয়েছে। মে মাসেও অন্যান্য বছরের মতো গরম পড়েনি। তিনি বলেন, যে বছর যত তাড়াতাড়ি গরম পড়ে, সে বছর আম তত আগে পাকে। আম পাকার সঙ্গে আবহাওয়ার সম্পর্ক অঙ্গা-অঙ্গিভাবে জড়িত। এ ছাড়া এ বছর আমের মুকুলও এসেছিল স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে কিছুটা দেরিতে। আম দেরিতে পাকার এটিও একটি কারণ বলে জানান ড. মো. আলীম উদ্দিন।
এ বছর শুরু থেকে এ পর্যন্ত প্রকৃতি আম চাষের অনুকুলে থাকায় আমের রেকর্ড পরিমাণ ফলনের আশা করছেন কৃষিবিদ ও আমচাষীরা। এ বছর রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় ৪ লাখ ৬১ হাজার ৭৫০ মে. টন আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে কৃষি বিভাগ। তবে এর চেয়েও বেশি আম উৎপাদিত হবে বলে আশা করছেন ফল গবেষণা ও কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের কর্মকর্তারা।
রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের বাগানগুলোতে এখন আম ঝুলছে থোকায় থোকায়। আমের ভারে নুইয়ে পড়েছে প্রতিটি গাছের ডাল। তা দেখে মুগ্ধ চাষি। মহানন্দা পাড়ের চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও পদ্মাপাড়ের রাজশাহীর জনপদের চারদিকে এখন আনন্দ বিরাজ করছে আমকে ঘিরে। আমচাষের মৌসুম শুরু হলেই বাগান মালিক, ব্যবসায়ী ও শ্রমিকসহ পুরো এলাকার মানুষের মধ্যেই আনন্দ খেলে যায়। এ আনন্দের কারণ, আমকে ঘিরে ধীরে ধীরে দেশের নানা প্রান্ত থেকে পর্যটক ও ব্যবসায়ীর আগমন বাড়তে শুরু করেছে রাজশাহী অঞ্চলে।
চাঁপাইনবাবঞ্জ সদর উপজেলার মহানন্দার পাড়ে কয়েক বিঘা আম বাগান পাঁচ বছরের জন্য ইজারা নিয়েছেন মতিন মিয়া। তিনি জানান, আম ব্যবসাটা পুরোটাই প্রকৃতিনির্ভর। টানা শৈত্যপ্রবাহ, অতি খরা, অতিবৃষ্টি কিংবা শিলাবৃষ্টি না হলে আমের ফলন ভালো হয়। বৈরী প্রকৃতির কারণে গত তিন বছর বাগান থেকে তার লাভ তেমন হয়নি। এ বছরের প্রকৃতি আমের জন্য আশীর্বাদ হয়ে এসেছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এ বছর আমের বাম্পার ফলন হবে। আশা করছি, গত তিন বছরের লোকসান কাটিয়ে উঠা সম্ভব হবে এবার।’
চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদরে ৩৩ একর জমিতে আম বাগান রয়েছে বদিউজ্জামান বদু মিয়ার। তিনি জানান, জানুয়ারি মাস থেকে শুরু হয় আমচাষিদের ব্যস্ততা, চলে আগস্ট পর্যন্ত। আমের গুটি থেকে আম ভাঙা পর্যন্ত কর্মব্যস্ত সময় কাটাতে হয় বাগানে। বছরের আট মাস আমবাগানে কাজ করে সংসারের চাকা সচল রাখতে হয় চাষিদের।
বদু মিয়া জানান, বেশি খরা হলে আমের মুকুল ঝরে যাওয়ার চিন্তা, আবার ঝড়বৃষ্টি হলে পড়ে যায় আম। তাই গাছে যখন আমের মুকুল ধরে, তখন থেকেই ব্যস্ততা বাড়তে থাকে। জানুয়ারি মাসের দিকে গাছের মুকুলে ওষুধ ছিটানো হয়, আম পাকার আগ পর্যন্ত বেশি খরা হলে গাছের গোড়ায় পানি দিয়ে রক্ষা করতে হয়। জানুয়ারি থেকে আগস্ট, এই আট মাস গ্রামে থেকেই পরবাসী চাষিরা। তখন আর বাড়িতে যাওয়া হয় না। আম ভাঙার সময় এলে রাতে পাহারা দিতে হয়। এক কথায় মুকুল আসার পর থেকে আম পরিপক্ব হওয়া পর্যন্ত প্রতিটি পর্যায়ে নিতে হয় যথাযথ পরিচর্যা। যার ওপর নির্ভর করে সুস্বাদু আমের।
পাঁচ বছরের জন্য ৩৫ লাখ টাকায় ১০০ বিঘা বাগান লিজ নিয়েছেন আবদুল বারি। দুই বছরে ২০ লাখ টাকা উঠলেও তৃতীয় বছর ২০১৮ তে ফলন ভালো হওয়ায় পুরো খরচ উঠে আসবে বলে আশা করছেন ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে আম চাষের সঙ্গে জড়িত এ চাষি। তিনি জানান, গাছ থেকে আম পাড়ার পরও পরিচর্যার ব্যাপার আছে। আম প্রথমে গাছের নিচেই রাখা হয়। এ সময় পাটি বিছিয়ে দিয়ে তার উপর আম রাখা হয়, যতক্ষণ পর্যন্ত না এর বোঁটার রস ঝরে। কারণ, এ রস আমের গায়ে পড়লে তা বাইরের আবরণ নষ্ট করে ফেলে। গায়ে পরে কালো দাগ। অনেকে পাখার বাতাস দিয়ে রস শুকিয়ে নেন। তবে গাছ থেকে আম পাড়ার পর লক্ষ্য থাকে দ্রুত আম বাজারজাত করার। এজন্য বিভিন্ন আকারের ঝুড়িতে কাগজ দিয়ে তাতে আম ভরা হয়।
রাজশাহীর সবচেয়ে বড় আমের বাজার পুঠিয়া উপজেলার বানেশ্বর। এ বাজারের ইজারাদার মন্টু সরকার জানান, বাজারে আম আসতে শুরু করেছে। বিভিন্ন এলাকার আম চাষিরা প্রত্যেক দিনই গাছ থেকে আম নামিয়ে বাজারে নিয়ে আসছে। তবে এক সপ্তাহের মধ্যে বাজার আমে জমজমাট হবে।
বানেশ্বর বাজারের পাইকারি আম ব্যবসায়ী ফরমান আলী জানান, এখন গোপালভোগ বিক্রি হচ্ছে মানভেদে এক হাজার থেকে এক হাজার ৭০০ টাকা পর্যন্ত। আর স্থানীয় গুটি জাতের সব আম ৬০০ থেকে শুরু করে এক হাজার ৫০০ টাকা পর্যন্ত মণ বিক্রি হচ্ছে। তিনি জানান, আর সাত-আটদিন পরই ব্যাপকভাবে জমবে আমের বেচাকেনা।
আরেক বিক্রেতা খাদেমুল জানান, বাজারে এখন গুটি জাতের আম পর্যাপ্ত রয়েছে। এই সপ্তাহ গেলেই আরো বিভিন্ন জাতের আম উঠতে শুরু করবে। এখন গোপালভোগ, ক্ষীরসাপাত, গুটি জাতের আম পাওয়া যাচ্ছে।
রাজশাহীর নগরীর সাহেবজার এলাকার আম ব্যবসায়ী এমদাদুল হক মিলন বলেন, বাজারে গোপালভোগ আম এসেছে। প্রতি মণ আম ২০০০ টাকায় বিক্রি করছি। বাজার দেখভাল করার জন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে নজরদারি রয়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ রাজশাহী অঞ্চল অফিস সূত্রে জানা গেছে, এবার চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় ২৬ হাজার ১৫০ হেক্টর জমিতে আমের আবাদ হয়েছে। এ জেলায় আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২ লাখ ৪৪ হাজার মেট্রিক টন। গত বছর রাজশাহী জেলায় ১৬ হাজার ৯৬১ হেক্টর জমিতে আমবাগান ছিল। এবার তা বেড়ে হয়েছে ১৭ হাজার ৪৬৩ হেক্টর আম বাগান। রাজশাহীতে এবার দুই লাখ ১৭ হাজার ৭৫০ মেট্রিক টন আম উৎপাদনের আশা করা হচ্ছে। এ ছাড়া, নওগাঁ জেলায় ১২ হাজার ৬৭১ হেক্টর জমিতে এক লাখ ৬১ হাজার ২৪২ মেট্রিক টন এবং নাটোরে চার হাজার ৮২৩ হেক্টর জমিতে ৫৬ হাজার ২১ মেট্রিক টন আমের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে এবার।
রাজশাহী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক দেব দুলাল ঢালী বলেন, আর কয়েকদিন আবহাওয়া ভালো থাকলে আম নিয়ে চাষিরা এবার ভালো লাভ করবেন। এবার বাঘা উপজেলার ১৪ জন চাষির সঙ্গে আম রপ্তানিকারকরা চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন। চাষিরা ২৬টি শর্ত মেনে আম উৎপাদনে রাজি হয়েছেন। এবার ১০০ টন আম বিদেশে পাঠানোর লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে।
রাজশাহীর জেলা প্রশাসক এস এম আব্দুল কাদের বলেন, ভেজালমুক্ত আম বিক্রি নিশ্চিত করতে বাজার মনিটরিং করা হচ্ছে। এ জন্য প্রতিটি উপজেলার নির্বাহী অফিসার, উপজেলা চেয়ারম্যান ও কৃষি কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে মনিটরিং কমিটি গঠন করা হয়েছে। জেলা প্রশাসন থেকে তিনজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দিনে আট ঘণ্টা করে ২৪ ঘণ্টা জেলার সবচেয়ে বড় আমের বাজার পুঠিয়ার বানেশ্বরে দায়িত্ব পালন করছেন।