শরীয়তপুরে পদ্মার পারে কান্না আর আহাজারি
পদ্মার ভয়াবহ ভাঙনে শরীয়তপুরের নড়িয়া-সুরেশ্বর সড়কের মূলফৎগঞ্জ বাজার সংলগ্ন এলাকার প্রায় দুইশ মিটার পাকা সড়ক নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এ সড়কটির বাঁশতলা থেকে দুই কিলোমিটার এলাকা জুড়ে আরো অন্তত ২৫ থেকে ৩০টি স্থানে ফাটল দেখা দিয়েছে। এতে সড়ক যোগাযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।
অব্যাহত পদ্মার ভাঙনে গত এক মাসে নড়িয়া উপজেলার প্রায় দেড় হাজার বসতবাড়ি, বাড়িঘর, স্কুল, মসজিদ-মাদ্রাসাসহ মূল্যবান অনেক স্থাপনা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। প্রতিদিন নতুন নতুন এলাকা নদীর করাল গ্রাসে হারিয়ে যাচ্ছে। পদ্মার পারে চলছে কান্না আর আহাজারি।
শনিবার রাত ৯টার দিকে পদ্মায় বিলীন হয়ে যায় একটি পাকা মসজিদ, একটি চারতলা ভবনসহ আরো চারটি দালান ঘর। সব কিছু হারিয়ে দিশেহারা হয়ে ছুটছে মানুষ।
এ দিকে নড়িয়া বাজার থেকে মাত্র ২০০ গজ দূরে এবং মূলফৎগঞ্জ বাজার থেকে মাত্র ৫০ গজ দূরে রয়েছে পদ্মানদী। মারাত্মক ঝুঁকিতে রয়েছে মূলফৎগঞ্জ বাজার, নড়িয়া বাজার ও নড়িয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স।
রোববার সকাল থেকে বিকেল সাড়ে ৩টা পর্যন্ত নড়িয়া উপজেলার পূর্ব নড়িয়া, বাঁশতলা, কেদারপুর ভাঙনকবলিত এলাকায় অবস্থান করে দেখা যায়, প্রবল বেগে পদ্মার পানি প্রবাহিত হচ্ছে। একটু পরে পরে প্রায় ৫০ থেকে ১০০ মিটার এলাকা নিয়ে পদ্মা নদীতে দেবে যাচ্ছে। স্থানীয়রা আশ্রয়ের সন্ধানে দিগ্বিদিক ছোটাছুটা করছে। স্থাপনা অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছেন তারা। কেউ কেউ জায়গা না পেয়ে কোনো রকম করে টিনের ঘরগুলো সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। চোখের সামনেই পূর্ব পুরুষের ভিটেমাটি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যেতে দেখে অনেকেই কান্নায় ভেঙে পড়ছেন।
চর জুজিরা গ্রামের মনোয়ারা বেগম (৬০) একটি রান্নাঘরে বসে দুটি শিশুকে নিয়ে খাবার খাচ্ছিলেন। পদ্মা কেড়ে নিয়ে তাঁর ঘরবাড়ি। কথা হয় তাঁর সঙ্গে। মনোয়ারা বেগম জানান, কোথাও আশ্রয়ের জায়গা খুঁজে না পেয়ে এখনো পদ্মার পারেই অবস্থান করছেন। তাঁর দুই নাতনিকে নিয়ে বসে আছেন। ছেলের বউ নারগিছ আক্তার আশ্রয় নেওয়ার জন্য ভাড়ায় জমিন খুঁজতে গেছেন। আজ এই বেলার মধ্যেই অন্য কোথাও আশ্রয় নিতে হবে তাঁকে।
মনোয়ারা বেগমের স্বামী আবদুর রব হাওলাদার ৩০ বছর আগেই মারা গেছেন। ছেলে নুরুল হক হাওলাদারও মারা গেছেন পাঁচ বছর আগে। তিন নাতনি আর ছেলের বউকে নিয়ে স্বামীর রেখে যাওয়া ভিটে বাড়িটুকুই ছিল তাঁর শেষ আশ্রয়স্থল। এখন তাও পদ্মায় কেড়ে নিয়েছে। কথাগুলো বলতে বলতে হাউ মাউ করে কেঁদে ওঠেন মনোরয়ারা বেগম।
পূর্ব নড়িয়া গ্রামে গিয়ে দেখা যায়,পদ্মা নদীর পারে বসে আছেন মহসিন বেপারী (৩০)। অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন পদ্মার দিকে। দুই চোখ থেকে গাল গরিয়ে পানি ঝরছে তাঁর। চাপা কণ্ঠে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছেন মহসিন। কথা হয় তাঁর সঙ্গে।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে মহসিন বলেন, ১৫ দিন আগে তাদের বসতবাড়িটি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। পাঁচ বিঘা জমি নিয়ে বাড়িটি ছিল তাঁদের। ওই জমি বন্ধক রেখে ব্যাংক থেকে ১২ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে ব্যবসা করছেন তাঁরা। বাড়িটি এখন নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। একটি ভাড়া ঘরে আশ্রয় নিয়েছেন তাঁরা। সব হারালেও ব্যাংক ঋণ পরিশোধের জন্য চাপ দিচ্ছে বলে জানান তিনি।
একই অবস্থা এখন নড়িয়া উপজেলার পদ্মার পার জুড়ে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, নড়িয়ার কেদারপুর মোক্তারের চর এবং জাজিরা উপজেলার বিলাশপুর ও কুন্ডেরচর ইউনিয়নের ব্যাপক এলাকা জুড়ে নদী ভাঙন চলছে। এ বছর পদ্মার ভয়াবহ ভাঙনে পদ্মা নদী তিনশ থেকে চারশ মিটার দক্ষিণে প্রবেশ করেছে। তিন বছর আগে পদ্মা নদী প্রায় তিন কিলোমিটার দক্ষিণ দিকে নড়িয়া-ঢাকা সড়কটির কাছে ছিল। তিন বছর অব্যাহত ভাঙনের কারণে পদ্মা নদী তিন কিলোমিটার দক্ষিণে প্রবেশ করেছে। গত এক সপ্তাহে নড়িয়া উপজেলার বাঁশতলা, মূলফৎগঞ্জ, সাধুর বাজার, ওয়াপদা এলাকার পাঁচ শতাধিক পাকা ঘরবাড়ি, মসজিদসহ বিভিন্ন স্থাপনা, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, ব্রিজ-কালভার্ট নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।
শনিবার দুপুরে নড়িয়ার বাঁশতলা থেকে মূলফৎগঞ্জ সড়কের ১০০ মিটার পদ্মা নদী গর্ভে চলে যায়। রাত ৯টার দিকে একটি পাকা মসজিদ, চারতলা একটি ভবনসহ আরো তিনটি ভবন একসঙ্গে নদীতে বিলীন হয়ে যায়।
এর আগে শুক্রবার ভাঙনের কারণে পদ্মা নদী নড়িয়া-সুরেশ্বর সড়কের কাছে চলে আসায় এবং সড়কটির বিভিন্নস্থানে ফাটল দেখা দেওয়ায় যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। সড়কটির আরো অন্তত ২৫ থেকে ৩০টি স্থানে ফাটল দেখা দিয়েছে। ফলে সড়কটির বাঁশতলা থেকে মূলফৎগঞ্জ বাজার পর্যন্ত যেকোনো মুহুর্তে বিলীন হয়ে যেতে পাড়ে। এ কারণে নড়িয়া-সুরেশ্বর সড়কের সঙ্গে সম্পূর্ণ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। পদ্মাপারের মানুষ প্রতিটি মুহূর্ত ভাঙন আতঙ্কে কাটাচ্ছেন।
নড়িয়ার বাঁশতলা এলাকার মোশারফ শিকারী বলেন, শনিবার দুপুরে নড়িয়া-সুরেশ্বর সড়কের প্রায় একশ থেকে দেড়শ মিটার জায়গা নদীগর্ভে চলে গেছে। রাতে চারতলা একটি ভবনসহ আরো তিনটি ভবন নদীতে বিলীন হয়ে যায়। গত এক মাসের ভাঙনে নদী ৫০০ মিটার দক্ষিণে চলে এসেছে। এখন সড়কের কাছেই নদী, কিছু কিছু স্থানে সড়কের অংশ নদীতে চলে গেছে। এ সড়কটি বন্ধ হওয়ায় আমাদের চরম দুর্ভোগে পড়তে হবে।
নড়িয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সানজিদা ইয়াছমিন বলেন, নড়িয়া-সুরেশ্বর সড়কটির বেশ কিছু স্থানে ফাটল দেখা দিয়েছিল। যানবাহন চলাচল ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় শুক্রবার থেকে ওই সড়কটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। শনিবার দুপুরে সড়কটির একটি অংশ নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। ওই এলাকার মানুষ চার কিলোমিটার ঘুরে বিকল্প সড়ক দিয়ে চলাচল করবে। এই মুহূর্তে ভাঙন রোধ করা দুরুহ ব্যাপার। তারপরও পানি উন্নয়ন বোর্ড বালুভর্তি জিও টেক্সটাইল ব্যাগ ফেলছে।
শরীয়তপুর পানি উন্নয়ন বোডের নির্বাহী প্রকৌশলী শফিকুল ইসলাম বলেন, পদ্মা নদীর নড়িয়া-জাজিরার বেশ কিছু অংশে ভয়াবহ ভাঙন দেখা দিয়েছে। ভাঙন রোধ করার জন্য একটি প্রকল্প অনুমোদন হয়েছে। আগামী অক্টোবর-নভেম্বর মাসে ওই প্রকল্পের কাজ শুরু করা যাবে। এই মুহূর্তে ভাঙন রোধে কিছু স্থানে বালু ভর্তি জিওটেক্সটাই ব্যাগ ফেলা হচ্ছে। এ পর্যন্ত এক লাখ জিওব্যাগ ফেলা হয়েছে। এ ছাড়াও ৫০ মিটার পরপর একটি করে স্পার তৈরির কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে।