ইউএস-বাংলার বিমানে হঠাৎ জঙ্গি আতঙ্ক!
সন্ধ্যা ৭টা ৩০ মিনিট। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। বেসরকারি বিমান সংস্থা ইউএস-বাংলার বিএস ১০৯ নম্বর ফ্লাইট চট্টগ্রামের উদ্দেশে রওনা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত। অন্য যাত্রীদের সঙ্গে বিমানে চড়ে বসে বোরকা পরিহিতা এক তরুণী। সবাই টিকিট আর বোর্ডিং পাস দেখালেও তরুণী জানাল, তাঁর কাছে এসব নেই। তিনি তা হারিয়ে ফেলেছেন।
এর পরই বিমানে ছড়িয়ে পড়ে আতঙ্ক। বিমানে ট্যাগ ছাড়া একটি সুটকেস পাওয়ার পর আতঙ্ক আরো বেড়ে যায়। জঙ্গি আতঙ্কে থমকে যায় ইউএস-বাংলার যাত্রা। গতকাল মঙ্গলবার এ ঘটনা ঘটে।
বিমানবন্দর সূত্রে জানা যায়, বিমানটি রানওয়ের দিকে রওনা হতেই একটা ফোন পেয়েই থেমে যায়। হঠাৎ বলা হয় সবার বোর্ডিং হাতে তুলে দেখানোর জন্য। যথারীতি সবাই তাই করলেও কিছুক্ষণ পর দেখা গেল এক তরুণীর কাছে টিকেট নেই। তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি জানান যে টিকেট হারিয়ে ফেলেছেন। কিন্তু বোর্ডিং হওয়া যাত্রীদের সংখ্যার সাথে প্রকৃত যাত্রীদের সংখ্যা মিলছে না। এদিকে তরুণীর সঙ্গে কোনো লাগেজ বা অভিভাবকও নেই। আর সম্পূর্ণ যাত্রী বোঝাই প্লেনটিতে ওই একটিমাত্র আসনই খালি ছিল, যেটাতে ওই তরুণী বসেছিলেন। পরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা সব যাত্রীকে বিমান থেকে নামান। আর ওই তরুণী ভাবলেশহীন ও প্রতিবাদ ছাড়াই দ্রুত প্লেন থেকে নেমে যান। পরে ওই ফ্লাইট যাত্রীদের পরীক্ষা করে তবেই গন্তব্যে উড়াল দেয় এবং নিরাপদে পৌঁছে, তবে সেই তরুণী ছাড়া।
ফ্লাইট বিএস ১০৯-এর যাত্রী বেসরকারি এক প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পুলক কান্তি বড়ুয়া ঘটনার পর উদ্বিগ্ন হয়ে ফেসবুকে লিখেন, ‘মাত্র এক ভয়াবহ বিপর্যয়ের কাছ থেকে দেশ রক্ষা পেল, সেই সাথে আমিও বেঁচে গেলাম। ঘটনা যদি সত্য হতো, তবে আজ হতো আমার শেষ দিন। এত অনিশ্চিত জীবনের কাছে কোনো স্বপ্ন কি বেঁচে থাকে?’
এই ঘটনায় বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) তিন সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করেছে বলে জানিয়েছেন বেবিচকের জনসংযোগ কর্মকর্তা এ কে এম রেজাউল করিম।
ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের জনসংযোগ কর্মকর্তা কামরুল হাসান বলেন, ‘একটি উড়োজাহাজ যখন যাত্রা শুরু করে তখন কেবিন ক্রুরা সবার মাথা গুনে দেখেন যাত্রী ঠিক আছে কি না। তখন তাঁরা দেখতে পান একজন বেশি এবং তিনি বোর্ডিং পাস দেখাতে পারেননি। জানা গেছে, ওই তরুণী মানসিক বিকারগ্রস্ত।’
বিমানবন্দর আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) জানিয়েছে, তরুণীর নাম সামিয়া ইসলাম। বয়স ২২ বছর। সামিয়া ইস্ট ওয়েস্ট ইউনির্ভাসিটিতে পড়ে তড়িৎ প্রকৌশল বিষয়ে। তরুণীর পরিবার দাবি করেছে- সামিয়া মানসিকভাবে অসুস্থ। তিনি তাঁর মায়ের সাথে রাগ করে যেদিক খুশি সেদিকে চলে যেতে গিয়েই বিমানবন্দরে চলে আসেন।
বিমানবন্দর আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আলমগীর হোসেন বলেন, ‘অভ্যন্তরীণে তো আন্তর্জাতিকের মতো চেকিং সিস্টেম নেই। তারপরও এখানে চেকিং হয়। সেটা হচ্ছে প্রথমে মালামাল চেক করে, দ্বিতীয় হচ্ছে কাউন্টরের পর বোর্ডিং পাস দেওয়ার পর চেকিং হয়। আর সেখানেই একটি সিল দিয়ে ঢুকতে দেওয়া হয়। নিয়ম অনুযায়ী ওই তরুণী সেখানে ঢুকতে পারার কোনো ব্যবস্থা নেই এবং সবার শেষে সংশ্লিষ্ট এয়ারলাইনস কিন্তু তার বোর্ডিং পাসের একটা কাউন্টার কাগজ ছিঁড়ে রাখে এবং টিকেট চেক করে বে এরিয়াতে নিয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনস বলেছে, গতকাল ওই সময় একইসঙ্গে চারটি এয়ারলাইনসের যাত্রীরা প্রবেশ করেছিল। তাই তারা মনে করেছে ওই যাত্রী তাদের নয়।’
মোহাম্মদ আলমগীর হোসেন আরো বলেন, ‘কিন্তু সামিয়া নামক ওই যাত্রী পরে তাদেরই উড়োজাহাজে উঠে যায়। পরে বিমান যখন কাউন্টিং শুরু করল ওই চেকে দেখল একজন বাড়তি।’
মোহাম্মদ আলমগীর আরো বলেন, ‘সামিয়ার ব্যাগ পরীক্ষা করা হয়েছে। জঙ্গি হামলার সঙ্গে কোনো সম্পৃক্ততা নেই বলে মনে করি।’
বিমান পরিচালনা পর্ষদের সাবেক সদস্য ও বিমান চলাচল বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহেদুল আলম এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘এটি একটি অভাবনীয় ও ভয়াবহ ব্যাপার। সারা বিশ্বে যখন বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ, এয়ারলাইনসগুলো নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিচ্ছে তখন আমাদের এখানে একজন যাত্রী কোনো রকম টিকেট বা বোর্ডিং পাস ছাড়াই উড়োজাহাজে আরোহন করে। দেশের প্রধান বিমানবন্দর কতটা ঝুঁকিপূর্ণ তা এ থেকেই বোঝা যায়। এটা আমাদের এখনই সতর্ক করে দিয়েছে এবং ভবিষতে এর থেকে শিক্ষা নিয়ে নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরো জোরদার করতে হবে।’
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড এম এ মোমেন বলেন, ‘আমাদের যে নিরাপত্তা ব্যবস্থা তা খুবই দুর্বল। সঠিক চেকিং হয়নি। কারণ বিমানবন্দরে চেকিংয়ের তিনটি ধাপ থাকে। এ ক্ষেত্রে এই ঘটনা সিভিল এভিয়েশন ও কাস্টমসের ব্যর্থতা। তারা রুটিন ওয়ার্ক ঠিক মতো করেনি, করলে এই ধরনের ঘটনা ঘটত না।’