মুফতি ওমর ফারুকের মাকে কী জবাব দেবেন বাবা?
পুরান ঢাকার চকবাজারের চুরিহাট্টা গলিতে অগ্নিদগ্ধ হয়ে শরীয়তপুরের দুই ব্যক্তি প্রাণ হারিয়েছেন। এঁদের একজন চকবাজার বড়কাটরা মাদ্রাসার শিক্ষক মুফতি ওমর ফারুক (৩৫)। আরেকজন চুরিহাট্টার হাজী ওয়াহেদ ম্যানশনের মদিনা ডেকোরেটর দোকানের শ্রমিক বিল্লাল হোসেন চৌকিদার (৪৫)।
ওমর ফারুকের বাড়ি নড়িয়া উপজেলার চরআত্রা মুন্সিকান্দি গ্রামে। বিল্লাল হোসেন চৌকিদারের বাড়ি শরীয়তপুর সদর উপজেলার গ্রামচিকন্দি গ্রামে। তাঁদের মর্মান্তিক মৃত্যুতে এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে। শোকে কাঁদছে পরিবারের সদস্য ও আত্মীয়-স্বজনরা।
নিহতের পরিবার ও স্থানীয় সূত্র জানায়, পদ্মা নদীর দুর্গম চরাঞ্চল নড়িয়ার চরআত্রা ইউনিয়ন। ওই ইউনিয়নের চরআত্রা মুন্সিকান্দি গ্রামের করিম মাদবরের ছেলে মুফতি ওমর ফারুক। তিনি পাশের মুন্সীগঞ্জ জেলার লৌহজং উপজেলার একটি মাদ্রাসায় পড়ালেখা করেছেন। দশ বছর ধরে চকবাজার বড় কাটরা মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেন। মাত্র তিন বছর আগে বিয়ে করেন মুফতি ওমর ফারুক। দুই বছরের একটি মেয়েও রয়েছে তাঁর।
গত বুধবার মাদ্রাসায় ক্লাস নেন মুফতি ওমর ফারুক। রাত ১০টায় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে রাতের খাবারও খান। খাবার খেয়ে যান চুরিহাট্টা গলির মদিনা ডেন্টাল ক্লিনিক ও ফার্মেসিতে। রাত সাড়ে ১০টার ভয়াবহ আগুনে সেই ফার্মেসির চিকিৎসক, মালিক, তিনিসহ উপস্থিত সবাই মারা যান। পরদিন বৃহস্পতিবার সকালে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা তাঁদের সবার লাশ উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে নিয়ে যান।
এদিকে সকালে মুফতি ওমর ফারুকের মৃত্যুর খবরে সহকর্মী, প্রিয় শিক্ষার্থী, বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়স্বজনরা কান্নায় ভেঙে পড়েন। গতকাল তাঁর লাশ নিতে শতাধিক শিক্ষার্থী ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গের সামনে জড়ো হন। খবর পেয়ে গ্রাম থেকে পরিবারের সদস্যরা লাশ শনাক্ত করেন। বৃহস্পতিবার রাতেই তাঁর লাশ নানা বাড়ি মুন্সীগঞ্জের লৌহজং উপজেলার দীঘিরপার গ্রামে নিয়ে দাফন করা হয়।
ওমর ফারুকের বাবা করিম মাদবর বলেন, ‘ছুটিতে আমার বাবার বাড়ি আসার কথা ছিল। ওর মাকে ডাক্তার দেখাতে ঢাকায় নেওয়ার কথা ছিল। বাবা তো আর বাড়ি আসল না, আর আসবোও না। পুড়ে অঙ্গার হয়ে গেছে। আল্লাহ কেন এমন করলা? ওর মারে কী জবাব দিমু?’
চরআত্রা মুন্সিকান্দি গ্রামের বাসিন্দা চিকিৎসক তৌহিদ মুন্সি বলেন, ছেলেটি অনেক ভালো ছিল। তাঁর দুই বছর বয়সী একটি শিশু মেয়ে রয়েছে। সে প্রায়ই আমার কাছে আসত। এভাবে সে (মুফতি ওমর ফারুক) মারা যাবে কল্পনাও করতে পারিনি। তাঁর মৃত্যু মানতে পারছি না।’
তৌহিদ মুন্সি বলেন, ‘গতকাল খবর পেয়ে তাঁর পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ঢাকা মেডিকেলে ছুটে যাই। লাশ নিয়ে মুন্সীগঞ্জে নানার বাড়ি দাফন করি।’
এদিকে সদর উপজেলার শৌলপাড়া ইউনিয়নের গ্রামচিকন্দি গ্রামের আদাল উদ্দিন চৌকিদারের ছেলে বিল্লাল হোসেন। বাবা-মায়ের মৃত্যুর পর স্ত্রী ও আট বছর বয়সী মেয়েকে নিয়ে ঢাকার লালবাগ এলাকার শহীদবাগে ভাড়া বাসায় বসবাস করতেন। মেয়ে স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ে দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী। শ্রমিকের কাজ করতেন চুরিহাট্টা গলির ওয়াহেদ ম্যানশনের মদিনা ডেকোরেটরের দোকানে। বুধবার কাজ শেষ করে রাতে বাড়ি ফেরার কথা ছিল বিল্লালের। আগুন ছড়িয়ে পড়লে ভবনের ওই দোকানে আটকা পড়েন তিনি। পরের দিন সেখান থেকে তাঁর পুড়ে যাওয়া মরদেহ উদ্ধার করা হয়।
বিল্লালের চাচা সুলতান হোসেন বলেন, সংসারে একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন বিল্লাল। তাঁর করুণ মৃত্যুতে স্ত্রী-সন্তান পাগল প্রায়। ঢাকার আজিমপুরে বিল্লালের লাশ দাফন করা হয়েছে।
বিল্লালের স্ত্রী রুমা বেগম বলেন, ‘বাসা থেকে রাত সাড়ে ৯টার দিকে কাজের উদ্দেশে চকবাজারের মদিনা ডেকোরেটরে যান আমার স্বামী। ঘটনার ১৫ মিনিট আগে তাঁর সঙ্গে আমি কথা বলি। যখন আগুন লাগে, তখন বার বার ফোন দেই। আমার স্বামীর ফোন বন্ধ পাই। শুনেছি, আগুনে পুড়ে যারা নিহত হয়েছে তাদের লাশ নাকি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। দৌঁড়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যাই। সেখানে আমার স্বামীর লাশ পাই।’
শরীয়তপুরের জেলা প্রশাসক কাজী আবু তাহের বলেন, মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় শরীয়তপুরের দুজনের করুণ মৃত্যু হয়েছে। সরকার ঘোষিত সব অনুদান তাদের পরিবার পাবে। এ ছাড়া জেলা প্রশাসন ওই দুজনের পরিবারকে সব ধরনের সহায়তা দেবে।