বড়ইতলা গণহত্যা দিবস : বিবর্ণ হয়ে পড়ছে স্মৃতিসৌধ

আজ ১৩ অক্টোবর। ১৯৭১ সালের এ দিনে কিশোরগঞ্জের সদর উপজেলার কর্শাকড়িয়াইল ইউনিয়নের বড়ইতলা গ্রামে হত্যাযজ্ঞে মেতে ওঠে পাকিস্তান সেনাবাহিনী। গ্রামের ৩৬৫ জন মানুষকে হত্যা করে তারা। হামলায় আহত হয় দেড় শতাধিক মানুষ।
বড়ইতলায় মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতিসৌধে মাত্র ১৫০ জন শহীদের নাম দেওয়া হয়েছে। দায়সারাভাবে লেখার কারণে ওই ১৫০ জনের নামও মুছে যাচ্ছে। এখনো ওই গণহত্যায় নিহত সবার নাম স্মৃতিসৌধে না আসায় স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে।
যেভাবে ঘটনার সূত্রপাত
স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, ১৯৭১ সালের ১৩ অক্টোবর বুধবার সকালে সেনাবাহিনীর একটি দল ট্রেনে করে কিশোরগঞ্জ জেলা সদরের (তৎকালীন মহকুমা) নিকটবর্তী কর্শাকড়িয়াইল ইউনিয়নের বড়ইতলা গ্রামে যায়। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর উদ্দেশ্য ছিল বড়ইতলাসহ আশপাশের গ্রামের মানুষজনকে উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচির মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে ও পাকিস্তানের পক্ষে সংগঠিত করা। কিন্তু বড়ইতলা গ্রামে প্রবেশের পর পথ হারিয়ে ফেলার কারণে সেনাবাহিনীর একজন সদস্য দলছুট হয়ে পড়েন। পরে একজন সদস্যের স্বল্পতার বিষয়টি পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তাদের নজরে আসে। এ সুযোগে স্থানীয় রাজাকাররা পাকিস্তানি বাহিনীর কাছে গুজব ছড়িয়ে দেয় যে গ্রামবাসী পাকিস্তানি সেনাকে গুম করে ফেলেছে। এ সংবাদের সত্যতা যাচাই না করেই গ্রামের বাসিন্দাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তারা।
সেনাবাহিনীর সদস্য ও তাঁদের স্থানীয় সহযোগীরা বড়ইতলা, চিকনির চর, দামপাড়া, কালিকাবাড়ি, কড়িয়াইল, তিলকনাথপুর, গোবিন্দপুর ও ভূবিরচর গ্রামের পাঁচ শতাধিক লোককে জোর করে ধরে এনে কিশোরগঞ্জ-ভৈরব রেললাইনের পাশে বড়ইতলা গ্রামের একটি স্থানে জড়ো করে। একপর্যায়ে জড়ো হওয়া গ্রামবাসীদের লাইন করে দাঁড় করিয়ে পাকসেনারা বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে, রাইফেলের বাঁট দিয়ে পিটিয়ে ও গুলি করে হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। বর্বর এ হত্যাযজ্ঞে ৩৬৫ জন নিহত এবং আরো দেড় শতাধিক ব্যক্তি আহত হয়।
‘লাশের স্তূপের মধ্যে পড়েছিলাম’
সেনাবাহিনীর সদস্যদের হাতে আটক হলেও বেঁচে যান চিকনিরচর গ্রামের বাসিন্দা মনতাজ উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘পাকসেনারা আমাকে ও আমার ভাই সরাফ উদ্দিনকে রাস্তা থেকে ধরে বড়ইতলা নিয়ে যায়। হত্যাযজ্ঞ শুরু হলে একজন পাকসেনা আমাকে বন্দুক দিয়ে মাথায় আঘাত করলে অচেতন হয়ে মাটিতে লাশের স্তূপের ওপর পড়ে যাই। আমি মারা গেছি মনে করে ফেলে রেখে সেনারা চলে যায়। পুরো একদিন আমি লাশের স্তূপের মধ্যে পড়েছিলাম। পরদিন একজন মহিলা আমাকে লাশের স্তূপ থেকে উদ্ধার করে নিয়ে যায়।’
একইভাবে গণহত্যায় অলৌকিকভাবে বেঁচে যাওয়া দামপাড়া গ্রামের অপর বাসিন্দা আলী আকবর বলেন, ‘১৯৭১ সালের ১৩ অক্টোবর এখানে পাকবাহিনী কয়েক হাজার লোক জড়ো করে। এর মধ্যে আমিসহ আমার বাড়ির কয়েকজন লোককেও এখানে ধরে আনে। এরপর পাকবাহিনী গুলি করে ও বেয়নেট দিয়ে মানুষ হত্যা করে। আমার আপন চাচা, চাচাতো ভাই, ভাতিজাসহ চারজন মারা যায়। আমি অলৌকিকভাবে লাশের স্তূপের নিচে পড়ে গিয়ে রক্ষা পাই। পাকবাহিনী যাওয়ার পর বের হয়ে আসি। দুপুর ১২টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত লাশের নিচে ছিলাম।’
গণহত্যায় বেঁচে যাওয়া চিকনিরচর গ্রামের বাসিন্দা জিল্লুর রহমান বলেন, ‘পাকবাহিনী এসে আমাদের ধরে নিয়ে যায়। অনেক লোকজন একসঙ্গে জড়ো করে লাইন করে দাঁড় করিয়ে গুলি ছুড়ে লোক মারা শুরু করে। আমি লাশের স্তূপের নিচে পড়ে রক্ষা পাই। পাকবাহিনী যাওয়ার পর লোকজন আমাকে বের করে আনে।’
স্মৃতি মুছে যাচ্ছে সৌধ থেকে
২০০০ সালে মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের স্মরণে ওই স্থানে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। জেলা পরিষদের উদ্যোগে বড়ইতলায় ৬৬৭ বর্গফুট এলাকাজুড়ে নির্মিত হয় ২৫ ফুট উঁচু একটি স্মৃতিসৌধ। মূল সৌধের পাশে বড়ইতলা গণহত্যায় শহীদদের নাম সংবলিত দুটি সুউচ্চ পিলার। স্মৃতিসৌধের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন বর্তমান সরকারের জনপ্রশাসনমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম (তৎকালীন বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী)। এর নকশা প্রণয়ন করেন শিল্পী সজল বসাক।
মূল সৌধের পাশে দুটি সুউচ্চ পিলারে বড়ইতলা গণহত্যায় দেড়শ শহীদদের নামসংবলিত ফলক লাগানো হলেও এখন পর্যন্ত বাদবাকি শহীদদের নাম সংগ্রহ করে সেখানে ওঠানো হয়নি। এ ছাড়া নিম্নমানের দায়সারাভাবে লেখার কারণে অধিকাংশ নামই মুছে গেছে ফলক থেকে। স্বাধীনতার ৪২ বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো বড়ইতলার শহীদদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা সংগ্রহ করে ফলকে না ওঠানোয় ক্ষোভ রয়েছে শহীদ পরিবারের সদস্যদের মাঝে। বিষয়টিকে মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের মহান শহীদদের প্রতি অবমাননাকর বলে মনে করেছেন তাঁরা। এ ছাড়া স্মৃতিসৌধটিও এখনো উদ্বোধন করা হয়নি আনুষ্ঠানিকভাবে।
কালিকাবাড়ী গ্রামের বাসিন্দা মো. রুকন উদ্দিন বলেন, ‘বড়ইতলা গণহত্যা মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম নৃশংস ঘটনা। এই ঘটনার খবর সংবাদমাধ্যম বিবিসিতে প্রচারের পর বিশ্ববাসীর বিবেকে টনক নড়ে এবং মুক্তিযুদ্ধের বিজয় ত্বরান্বিত হয়। ওই গণহত্যায় আমার বাবাসহ আমার পরিবারের পাঁচজন নিহত হয়। কিন্তু আজ পর্যন্ত শহীদদের তালিকা প্রণয়ন হয়নি এবং স্মৃতিসৌধের কাজ শেষ হয়নি। এটা মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের প্রতি অবমাননা।’
দামপাড়া গ্রামের বাসিন্দা স্থানীয় শিক্ষক মোমিনুল হক বলেন, ‘১৩ অক্টোবর এখানে নির্মম হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। আমার বাড়ি থেকেও দুই চাচা ও চাচাতো ভাইসহ মোট তিনজনকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। কিন্তু স্বাধীনতার এতদিন পরও শহীদদের তালিকা সম্পন্নসহ নামফলক স্থাপন করা হয়নি। তাই আমি অবিলম্বে নামফলক স্থাপনের দাবি জানাচ্ছি।’
চিকনিরচর গ্রামের বাসিন্দা ফিরোজ উদ্দিন বলেন, ‘মূল সৌধের বর্তমান অবস্থাও খুব নাজুক। বছরের পর বছর ধরে অযত্ন-অবহেলায় স্মৃতিসৌধের বিভিন্ন স্থানে সৃষ্টি হয়েছে বড় বড় ফাটল, খসে পড়ছে সিমেন্টের আস্তর। এর ফলে পুরো স্মৃতিসৌধটিই ঝুঁকিতে পড়েছে।’
এ ব্যাপারে ক্ষোভ প্রকাশ করে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কিশোরগঞ্জ জেলা ইউনিটের কমান্ডার মো. আসাদ উল্লাহ বলেন, ‘অবিলম্বে স্মৃতিসৌধের অসমাপ্ত কাজ সম্পন্নকরণসহ শহীদদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রণয়নে সরকাবিভাবে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন।’