উচ্চশিক্ষায় উচ্চ প্রযুক্তির জালিয়াতি
কয়েক বছর ধরে প্রশ্নপত্র ফাঁস করছে একটি চক্র। ডিজিটাল মাধ্যমের ব্যবহারসহ নানা কৌশলে হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। বারবার ধরা পড়লেও উল্লেখযোগ্য কোনো শাস্তিই হয় না প্রশ্ন ফাঁসের দায়ে আটক ব্যক্তিদের। এ ছাড়া বিচারের আওতায় আনা যায়নি মূল অপরাধীদেরও। অভিযোগ রয়েছে প্রভাবশালী একটি মহলের কারণে ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাচ্ছে বিশেষ এ চক্রটি।
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, প্রযুক্তির অপব্যবহার করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় জালিয়াতি করে এ চক্রটি। নানা ধরনের ইলেকট্রনিক ডিভাইস, এটিএম কার্ডসদৃশ মোবাইল ফোন, স্মার্ট ওয়াচ ব্যবহার করে তারা পরীক্ষার হলে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। এ ছাড়া প্রবেশপত্র নকল করে পরীক্ষায় অংশ নিয়ে অন্যজনের নামে পরীক্ষা দেওয়া এবং ফেসবুক কিংবা ইমেইলের মাধ্যমে পরীক্ষার আগেই প্রশ্নপত্র ও উত্তর সরবরাহ করে তারা ভর্তি-ইচ্ছুক শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেন। আর অধিকাংশ সময় এসব জালিয়াতি চক্রের সঙ্গে জড়িত থাকে প্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তি, অসাধু শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী, কোচিং সেন্টার এবং রাজনৈতিক নেতা এবং প্রশাসনের একটি মহল।
এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর আমজাদ আলী বলেন, ‘এ বছর পরীক্ষায় জালিয়াতির অভিযোগে আমরা ১০ জনকে গোয়েন্দা পুলিশের মাধ্যমে আটক করতে সক্ষম হয়েছি। একটি মহল বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম ক্ষুণ্ণ করতে বিভিন্ন ইলেকট্রনিক মাধ্যমে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। তাদের আটক করতে আমরা সদা তৎপর আছি।’
এদিকে, সর্বশেষ গত ১৫ অক্টোবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের (গ ইউনিট) ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। এ পরীক্ষায় প্রবেশপত্র নকল করে পরীক্ষা দেওয়ার দায়ে সঞ্জয় কুমার সাহা নামে এক তরুণকে এক বছর সাজা দেয় ভ্রাম্যমাণ আদালত। তাকে সহযোগিতা করায় মেহেদী হাসান নামে আরেক তরুণের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত আইনে মামলা করা হয়। পরে তাদের দুজনকে শাহবাগ থানায় সোপর্দ করা হয়। আটক ওই দুই তরুণকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, একটি কম্পিউটার সেন্টার থেকে তারা নকল প্রবেশপত্র তৈরি করে নিয়েছে।
গত ১৪ বৃহস্পতিবার পরীক্ষার আগের দিন গভীর রাতে রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজার থেকে গোয়েন্দা পুলিশ পরীক্ষায় জালিয়াত চক্রের তিন সদস্যকে আটক করে। তাদের কাছে প্রশ্নপত্র জালিয়াতির বিভিন্ন ইলেকট্রনিক ডিভাইস, এটিএম কার্ডসদৃশ মোবাইল ফোন এবং স্মার্ট ওয়াচ পাওয়া যায়। পরে তাদের রমনা থানায় নিয়ে যাওয়া হয়।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রশ্নপত্র জালিয়াতের এ চক্রের সমন্বয়ক হিসেবে থাকে প্রশাসনের ও রাজনৈতিক দলের কিছু ব্যক্তি। এ ছাড়া এ চক্রের সদস্যরা এসএমএসের মাধ্যমেও প্রশ্ন ফাঁস করে থাকে। এ ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয় ইলেকট্রনিক ডিভাইস সংবলিত বিশেষ পদ্ধতিতে তৈরি ঘড়ি বা স্মার্ট ওয়াচ। এ ছাড়া স্মার্টকার্ড সদৃশ মোবাইল ফোনের মাধ্যমে তারা বাইরে যোগাযোগ করে। এ ক্ষেত্রে তাদের কানে থাকে ক্ষুদ্র ব্লু টুথ হেডফোন, খুব খেয়াল না করলে বাইরে থেকে যা চোখেও পড়ে না।
অ্যানালগ পদ্ধতিতেও হচ্ছে জালিয়াতি। এ ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কেন্দ্র টার্গেট করে ওই কেন্দ্র সংশ্লিষ্টদের সহযোগিতায় আশপাশেই একটি কক্ষ নেওয়া হয়। সেখানে প্রশ্ন সমাধান করে একটি চক্র। পরে কেন্দ্রে থাকা অতিরিক্ত ওএমআর ও প্রশ্নপত্র বাইরে পাচার করা হয়। সেখান থেকে সঠিক উত্তর দিয়ে ওএমআর পূরণ করে চুক্তিবদ্ধ শিক্ষার্থীকে দেওয়া হয়। শিক্ষার্থী তার কাছে থাকা মূল ওএমআর তখন লুকিয়ে ফেলেন এবং জালিয়াত চক্রের দেওয়া ওএমআর জমা দেন।
এদিকে, গত ৯ অক্টোবর ‘খ’ ইউনিটের পরীক্ষার আগের দিন রাত ১০টায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে প্রশ্নপত্র ফাঁসের গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে। এ ঘটনায় ভর্তি-ইচ্ছুক শিক্ষার্থী ও তাঁদের অভিভাবকরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। পরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন গোয়েন্দা পুলিশের সহযোগিতায় জালিয়াত চক্রের সদস্য সন্দেহে পাঁচজনকে আটক করা হয়।
এ বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি-ইচ্ছুক এক শিক্ষার্থী রাহাত জানান, সালিহুর নামে এক ব্যক্তি ফেসবুকের একটি গ্রুপ ‘ব্যাচ-২০১৫’-তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘খ’ ইউনিটের প্রশ্নের জন্য যোগাযোগ করতে একটি পোস্ট দেন। পরে ওই গ্রুপের ম্যাসেজ অপশনে গিয়ে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তারা একটি ফোন নম্বর দেন। ওই নম্বরে ফোন দিয়ে সালিহুরের সঙ্গে কথা হয়। এ সময় তাঁর পরিচয় জানতে চাইলে সালিহুর নিজেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিয়া হলের আবাসিক ও এমবিএর (ফিন্যান্স) ছাত্র বলে পরিচয় দেন।
রাহাত আরো জানান, কীভাবে প্রশ্ন পাওয়া যাবে জানতে চাইলে সালিহুর প্রথমে তাঁর বিকাশ নম্বরে ১০ হাজার টাকা পাঠাতে বলেন। টাকা পেলে তিনি মেইলে প্রশ্ন ও উত্তর পাঠাবেন বলে জানান। এ সময় পরীক্ষা দেওয়া হলে বাকি ৪০ হাজার টাকা নেবেন বলেও জানান তিনি। একপর্যায়ে সালিহুর টাকা পাওয়ার পর সরাসরি ভিডিও কলে কথা বলতেও রাজি হন।
এ সময় সালিহুর এ বিষয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নয়, অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলেন বলে জানান।
এছাড়া রাজীব রহমান নামে আরেক ব্যক্তি ‘বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাডমিশন টেস্ট হেল্প-২০১৪-১৫’ গ্রুপে একটি পোস্ট করেন। পোস্টে তিনি ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন ও উত্তর পেতে এখনই যোগাযোগ করুন’ বলে উল্লেখ করেন। সেই সঙ্গে যারা আগ্রহী তাদের ওই পোস্টের নিচে কমেন্ট করতে অনুরোধ করেন।
সুমন মাহমুদ নামে এক ব্যক্তি ‘বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার ভর্তি প্রস্তুতি’ নামে আরেকটি পেজ খোলেন। সেখানে তিনি লেখেন, ‘৯ অক্টোবর ঢাবির খ ইউনিটের অ্যাডমিশন টেস্ট। কারো যদি প্রশ্ন লাগে তাহলে ইনবক্সে যোগাযোগ করুন। উত্তরসহ দেওয়া হবে।’
একইভাবে পোস্ট দেন সুজন খান নামে আরো এক ব্যক্তি। তাঁর ফেসবুক আইডিতে প্রবেশ করলে দেখা যায়, সেখানে তার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে ঢাকা সিটি কলেজের নাম লেখা। তাঁর ফেসবুক টাইমলাইনে ১৮ সেপ্টেম্বর শুক্রবার ৯টা ৬ মিনিটে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন ও উত্তর আপ করা হয়েছে। যেখানে পরীক্ষা শুরু হয়েছে ১০টায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক এ বিষয়ে বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র কখনো ফাঁস হয় না। এখানে প্রশ্ন ফাঁসের সুযোগও নেই। একটি চক্র শিক্ষার্থীদের বিভ্রান্ত করে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। তারাই এ গুঞ্জন রটিয়েছে। আমরা তাদের ব্যাপারে তৎপর।’