স্বাভাবিক জীবনে ফিরছেন সশস্ত্র সংগঠন এমএনপির ৭৮ সদস্য
আত্মসমর্পণর মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনে ফিরছেন বান্দারবানের পাহাড়ের সশস্ত্র সংগঠন ম্রো ন্যাশনাল পার্টির (এমএনপি) ৭৮ সক্রিয় সদস্য। এরই মধ্যে সংগঠনের সশস্ত্র দুটি গ্রুপের ব্যবহৃত ৬০টি অস্ত্র সেনাবাহিনীর কাছে জমা দিয়েছেন তাঁরা।
আগামীকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে জেলার আলীকদম উপজেলার দুর্গম কুরুকপাতাঝিড়ি এলাকায় আনুষ্ঠানিকভাবে অস্ত্রসহ সংগঠনটির ৭৮ সদস্য আত্মসমর্পণ করবেন।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী বীর বাহাদুর। এ ছাড়া সেনাবাহিনীর চট্টগ্রাম অঞ্চলের এরিয়া কমান্ডার, বান্দরবান ৬৯ সেনা রিজিয়ন কমান্ডারসহ সামরিক-বেসামরিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের উপস্থিত থাকার কথা রয়েছে। এরই মধ্যে সব আয়োজন সম্পন্ন হয়েছে বলে জানিয়েছে সেনাবাহিনীর একটি সূত্র।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও ম্রো জনগোষ্ঠীর সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০১১ সালে বান্দরবানে ম্রো যুবকদের নিয়ে ম্রো ন্যাশনাল পার্টি (এমএনপি) নামের সশস্ত্র সংগঠনটি গঠিত হয়। বান্দরবানের সীমান্তবর্তী মিয়ানমার রাষ্ট্রেও ম্রো সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক সংগঠন এমএনপি রয়েছে। অনেকটা ওই আদলেই বান্দরবানের পাহাড়ে এমএনপি গড়ে তোলা হয়েছিল।
সংগঠনের পক্ষ থেকে প্রথম দিকে পাহাড়ের পিছিয়ে পড়া ম্রো জনগোষ্ঠীর অধিকার আদায়ে কথা বলা হলেও পরবর্তী সময়ে দলের সদস্যরা বিপথগামী হয়ে ওঠে। পাহাড়ে খুন, অপহরণ, চাঁদাবাজি, অস্ত্র বেচা-কেনাসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়তে থাকে তারা।
আলীকদম উপজেলার পোয়ামুহুরী-করুকপাতাঝিরিসহ আশপাশের সীমান্ত অঞ্চলগুলোতে সদস্য সংগ্রহের মাধ্যমে সংগঠনটি তাদের সশস্ত্র কর্মকাণ্ডের জানান দেয়। ২০১২ সালের এপ্রিল মাসে সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা মেনরুং ম্রো এবং জুন মাসে সংগঠনের সেকেন্ড ইন কমান্ড পালে ম্রো আলীকদমে আধিপাত্য বিস্তারের দ্বন্দ্বে প্রতিপক্ষের গুলিতে মারা যায়। এ ছাড়া আধিপাত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষে সংগঠনের ২৫ জনের মতো সদস্য খুন হয়েছে। এমএনপি পরবর্তী সময়ে কয়েকটি ভাগে বিভক্ত হয়। মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা সশস্ত্র সংগঠনের সদস্যদের ধরতে সেনাবাহিনী, বিজিবি ও পুলিশের সদস্যরা বান্দরবানের পাহাড়ে টানা অভিযান চালিয়ে শতাধিক সদস্যকে গ্রেপ্তার করে। নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযান, আর্থিক সংকট এবং নিজ জনগোষ্ঠীর সদস্যদের অসহযোগিতাসহ টানাপড়েনের কারণে সশস্ত্র সংগঠনের সদস্যরা আত্মসমর্পণের পথ বেছে নিয়েছে বলে জানান ম্রো জনগোষ্ঠীর কয়েকজন নেতা।
সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান খামলাই ম্রো ও পার্বত্য জেলা পরিষদের সদস্য সিইয়ং ম্রো জানান, এমএনপি সশস্ত্র সংগঠনের মেনরুম ম্রো গ্রুপের ৬৪ জন এবং লুইপ ম্রো গ্রুপের ১৪ জন সদস্য আত্মসমর্পণ করবেন। এরই মধ্যে তাদের অনেকে দেশীয় তৈরি ৬০টি অস্ত্র নিরাপত্তা বাহিনীর কাছে জমা দিয়েছেন। সংগঠনটির অপতৎপরতার কারণে ম্রো জনগোষ্ঠীর সাধারণ মানুষর দুশ্চিন্তায় ছিলেন বলে জানান এই দুই নেতা। তাঁরা বলেন, ম্রো জনগোষ্ঠীর কেউই চাননি তাঁদের সন্তানরা বিপথগামী হয়ে পড়ুক। পরে ম্রো জনগোষ্ঠীর সামাজিক সংগঠন ম্রো সোশ্যাল কাউন্সিল উদ্যোগ নেয় এসব যুবককে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার।
স্বাভাবিক জীবনে ফিরলে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হবে— এমন আশ্বাসের ভিত্তিতে সশস্ত্র সংগঠনের দুটি গ্রুপের সদস্যরা আত্মসমর্পণে রাজি হয়। দীর্ঘদিন আলাপ-আলোচনা ও নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষার মাধ্যমে আত্মসমর্পণের পথে ফেরাতে সহযোগিতা করেছেন ইউপি চেয়ারম্যান রাংলাই ম্রো, লেখক ও গবেষক সিইয়ং ম্রো, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান খামলাই ম্রো, পার্বত্য জেলা পরিষদের সাবেক সদস্য অংপ্রু ম্রো, আইনজীবী মাইইয়ং ম্রোসহ জনগোষ্ঠীর নেতারা।
বর্তমানে এমএনপির সশস্ত্র দুটি পক্ষের ৭৮ জন সদস্য দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র জমা দিয়ে আত্মসমর্পণের পথে ফিরলেও সংগঠনের মজুদ করা ও ব্যবহৃত অনেক অস্ত্র-গোলাবারুদের অনেকটাই জমা পড়ছে না বলে স্থানীয় একটি সূত্র দাবি করেছে। কিন্তু এমএনপির কাছে দেশীয় এলজি রাইফেল ছাড়া অন্য কোনো ভারী অস্ত্র ছিল না বলে দাবি ম্রো নেতাদের।
এদিকে আত্মসমর্পণের আগে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে কোনো ধরনের কথা বলতে রাজি হননি দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা।