নবদম্পতিসহ চারজন নিহত, পরিবারে হাহাকার
ঢাকার মগবাজারের ইমরান হোসেনের (৩১) সঙ্গে খিলগাঁওয়ের বাসিন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী সাদিয়া আক্তার সাথীর (২৪) কাবিন হয় গত ১৭ জুলাই। ঠিক এক মাস পর ১৬ আগস্ট দিবাগত রাত আড়াইটার দিকে সিলেট থেকে ফেরার পথে শ্যামলী পরিবহনের একটি বাসের সঙ্গে প্রাইভেটকারের মুখোমুখি সংঘর্ষে প্রাণ হারান ইমরান, সাথী ও সাথীর দুই বন্ধু-বান্ধবী।
এই ঘটনার পর শোকে কাতর নিহতদের পরিবার। ইমরানের মা বিউটি বেগমকে (৬৫) ঘুমের ওষুধ খাইয়ে অচেতন করে রাখা হচ্ছে। কারণ চেতনা ফিরলেই তিনি ছেলেকে খুঁজছেন। চাচ্ছেন ছেলের সঙ্গে কথা বলতে।
দুর্ঘটনায় ইমরানের মৃত্যুর ঘটনাটি বিউটি বেগম শুনেছেন একবার। তবে তিনি বিশ্বাস করেননি এখনো। কারণ যখন ছেলেকে (মৃত অবস্থায়) শেষবার দেখানো হয়েছিল, তখন বলা হয়েছিল হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এরপর থেকে পরিবারের সবাই মাকে বোঝানোর চেষ্টা করছেন, তাঁর ছেলে এখনো হাসপাতালে বেঁচে আছেন। তবে মাকে বলা হচ্ছে, ইমরান কথা বলতে পারবেন না। কারণ তিনি অচেতন হয়ে হাসপাতালে পড়ে আছেন। তবে মাকে কী আর থামানো যায় ভুল-ভাল বলে! মা ঠিকই সচেতন হয়েই ছেলের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা বলতে চাচ্ছেন।
সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ইমরানের পরিবারে এখন শুধুই হাহাকার। ছবি : এনটিভি
এই যেমন সোমবার সকালে ইমরানের বাবা আবুল কালাম মুঠোফোনে কাকে যেন বলছিলেন, তাঁর ছেলে মারা গেছেন। ঘুমের ঘোরেও বিউটি বেগম ঠিকই শুনে ফেলেছেন ছেলে নিহত হওয়ার কথা। একটু পরই ঘরের দরজা খুলে কাউকে না বলে চলে যাচ্ছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে! বাসার গেট থেকে বেশ কিছু দূর চলেও গিয়েছিলেন। আর ঠিক তখনই সেজ ছেলে কামরুল ইসলাম (২৬) বনানী কবরস্থান থেকে ইমরানের কবর জিয়ারত করে ফিরছিলেন। মায়ের এই অবস্থা দেখে কামরুল হতভম্ব হয়ে যান। পরে মাকে বাসায় নিয়ে যান তিনি।
বাসায় যাওয়ার পর মা বিউটি বেগম বিলাপ করতে করতে বলতে থাকেন, ‘আমার ছেলেকে এনে দে। আমি তার সঙ্গে ফোনে কথা বলতে চাই।’ এই বলে ছেলেদের সামনেই গুমরে কেঁদে উঠেন মা। বলছিলেন কামরুল ইসলাম।
রাজধানীর মগবাজারের নয়াটোলায় র্যাব ৩-এর কার্যালয় ঘেষে কামরুল ইসলামদের বাড়ি। বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, কামরুল ও তাঁর আরেক ছোট ভাই এবং ফুফা কাঁদছেন। সবাই জড়ো হয়ে বসে আছেন ফ্ল্যাটের মেঝেতে। বিউটি বেগমকে ঘুমের বড়ি খাইয়ে অচেতন করে রাখা হয়েছে।
সিলেটে বেড়ানোর সময় সাদিয়া আক্তার সাথী ও তাঁর বান্ধবী জান্নাত ও বন্ধু আকিবুল। তাঁদের কেউ আর বেঁচে নেই। ছবি : সংগৃহীত
তখন কামরুল ইসলাম এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘মাকে থামানো যাচ্ছে না। ঘুমের বড়ি খাইয়ে তাঁকে অচেতন করে রাখা হচ্ছে। মাঝেমধ্যে ঘুম ভাঙলেই কাউকে না বলে উঠে দৌঁড় দিচ্ছেন হাসপাতালের দিকে। কখনো ছেলেকে চাচ্ছেন ফোনে। কিন্তু ছেলে তো নেই! কাকে ফোনে ধরিয়ে দেব? তাই মাকে সান্ত্বনা হিসেবে বলা হচ্ছে, ছেলে এখনো বেঁচে আছে হাসপাতালে।’
কামরুল বলেন, ‘আমার ভাবির (সাদিয়া আক্তার সাথী) মায়ের অবস্থাও খুব খারাপ। তাঁকে ঘুমের বড়ি খাইয়ে অচেতন করে রাখা হচ্ছে। কারো সঙ্গেই কথা বলছেন না তিনি। রোববার ভাবিদের বাসায় গিয়েছিলাম। দেখে এসেছি তাঁর মায়ের অবস্থাও খুব খারাপ। ভাবির বাবা মোরশেদুর রহমান খোকনেরও অবস্থা একই। জামাই-মেয়ের শোকে কারো মুখের দিকে তাকানো যায় না।’
পরে সোমবার বিকেলে খিলগাঁওয়ের কুমিল্লা হোটেলের কাছে ৮৩৪ নম্বর বাসায় প্রবেশ করলে দেখা যায়, সাথীর মা কাঁদছেন। সঙ্গে সাথীর ছোট ভাইও কাঁদছেন। ঘরের ভেতরে প্রবেশ করতেই সাথীর মা এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘আমার মেয়ে-জামাই মইরা গ্যাছে। আমার মেয়ে শ্বশুরবাড়ি যাইতে পারল না। আগেই চলে গেল। কত সখ ছিল সাথীর। কিছুই হইল না।’
বলতে বলতে আবারও কেঁদে উঠেন সাথীর মা। তাঁর কান্নায় পরিবেশটা এমন হয়ে উঠে যে নামটাও জানা সম্ভব হয়নি।
সাথীর মা আরো বলেন, ‘আমার সব শ্যাষ হয়ে গেছে। সব স্বপ্ন শ্যাষ। আমি এহন কী লইয়া বাঁচুম?’ এরপর চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করেন তিনি। পাশে থাকা ছোট ভাই জানান, তাঁর মা ঘুম থেকে উঠেছে একটু আগে।
নরসিংদীর শিবপুরের কারারচরে ১৬ আগস্ট দিবাগত রাতে সংঘর্ষের পর ক্ষতিগ্রস্ত প্রাইভেটকার ও শ্যামলী পরিবহনের বাস। ছবি : এনটিভি
এর আগে কামরুল ইসলাম বলেন, ‘জুলাই মাসের ১৭ তারিখে আমার ভাই-ভাবির কাবিন হয়। কথা ছিল আগস্টের ২৩ তারিখে আমরা ভাবিকে উঠিয়ে নিয়ে আসব। গত ১৪ আগস্ট আমার ভাবি, সাথীসহ তাঁর আরো তিন বন্ধু সিলেটে হজরত শাহাজালাল (র.)-এর মাজার জিয়ারত করতে যান। এদিকে ১৫ আগস্ট বনানীর কবরস্থানের ডেকোরেশনের সব দায়িত্ব ছিল আমাদের। ফুল দেওয়াসহ সব ধরনের ডেকোরেশনের কাজ আমি আর ইমরান করেছিলাম। পরে ১৫ আগস্ট বনানীর কাজ শেষ করে ওখান থেকেই ভাবিকে আনতে প্রাইভেটকার নিয়ে রওনা দেই সিলেটের পথে।’
‘সিলেটে মাজার জিয়ারত শেষে সেখানে একদিন অবস্থান করে ১৬ তারিখ রাতে রওনা দেই ঢাকার পথে। গাড়িতে মোট পাঁচজন ছিলেন। আমার ভাই গাড়ি চালাচ্ছিলেন। পথে দিবাগত রাত আড়াইটার দিকে নরসিংদীর শিবপুরের কারারচরে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে যাত্রীবাহী বাসের সঙ্গে প্রাইভেটকারটির সংঘর্ষ হয়। এতে আমার ভাই ইমরান, ভাবি সাথী, ভাবির বান্ধবী জান্নাত রাইসা (২৫) ও বন্ধু আকিবুল হক রিফাত (২৭) নিহত হন। আরেক বন্ধু রফিকুল ইসলামকে (২৫) গুরুতর আহত অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।’
সাথী, জান্নাত ও আকিবুল ঢাকার মিলেনিয়াম বিশ্ববিদ্যালয়ের এমবিএর শিক্ষার্থী ছিলেন।