বাংলাদেশে বিনিয়োগ করুন, বিদেশিদের প্রধানমন্ত্রী

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির অংশীদার হতে বিশ্বের বড় বিনিয়োগকারীদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, অর্ধ দশক আগের চেয়ে বাংলাদেশ এখন এক ভিন্ন রকম দেশ।
আজ রোববার সকালে রাজধানীর একটি হোটেলে দুই দিনব্যাপী ‘বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট অ্যান্ড পলিসি সামিট-২০১৬’-এর উদ্বোধনী সেশনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এসব কথা বলেন।
প্রধনিমন্ত্রী বলেন, ‘আজকের বাংলাদেশ হচ্ছে সম্পূর্ণ পরিবর্তিত এক বাংলাদেশ। বাংলাদেশের মানুষ এখন আরো বেশি আত্মবিশ্বাসী। তারা যেকোনো অসম্ভব কাজকে বাস্তবায়ন করতে আরো বেশি আত্মবিশ্বাসী ও অঙ্গীকারবদ্ধ।’
বিনিয়োগের জন্য বাংলাদেশকে আকষর্ণীয় স্থান উল্লেখ করে শেখ হাসিনা এ দেশে বিদেশিদের বিনিয়োগের এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘বাংলাদেশ একটি সুন্দর দেশ, আসুন এখানে বিনিয়োগ করুন। আমাদের উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় আপনাদের সক্রিয় অংশীদার হওয়ার এখনই যথার্থ সময়।’ তিনি বলেন,‘বিনিয়োগ বোর্ডের চেয়ারপারসন হিসেবে আমি আপনাদের, বিশেষ করে দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের নিশ্চিত করতে চাই যে আমরা আপনাদের বাস্তবভিত্তিক বিনিয়োগ প্রস্তাবনা বাস্তবায়নে সব ধরনের সহায়তার দেওয়ার জন্য প্রস্তুত। বাংলাদেশে আপনার বিনিয়োগের সুরক্ষা ও বৃদ্ধি সুনিশ্চিত।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বিনিয়োগ কার্যক্রম সহজীকরণের লক্ষ্যে আমরা এরই মধ্যে বাংলাদেশ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছি।আমরা সারাদেশে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার পরিকল্পনা নিয়েছি।এরই মধ্যে অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরির জন্য ৩০টি এলাকা নির্বাচন করা হয়েছে।’ আগামী মাসে ১০টি অর্থনৈতিক অঞ্চলের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হবে বলেও প্রধানমন্ত্রী জানান।তিনি বলেন, ‘আমাদের রয়েছে বিপুল যুব কর্মশক্তি। বিশাল বাজার, উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা, ব্যক্তি স্বাধীনতা এবং সুদৃঢ় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা। কার্যকর বাজার অর্থনীতির যথাযথ ব্যবহারের জন্য আমরা ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ প্রসারে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন ও পদ্ধতিগত সরলীকরণ করেছি।’
শেখ হাসিনা বলেন, ব্যক্তি খাতের নীতি নির্ধারণী বিষয়ক সমস্যাগুলো তথ্যনিষ্ট ও গবেষণার মাধ্যমে চিহ্নিত করা এবং তা সমাধানের জন্য আমার দপ্তর ‘প্রাইভেট সেক্টর ডেভেলপমেন্ট পলিসি কো-অর্ডিনেশন কমিটি (পিএসডিপিসিসি) নামে একটি কমিটি গঠন করেছি। এতে সরকারি ও ব্যবসায়ী চেম্বার ও বাণিজ্য সংস্থাগুলো অন্তর্ভুক্ত রয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
শেখ হাসিনা দেশে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টিতে তাঁর সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের চিত্র তুলে ধরে বলেন, “শিল্প অবকাঠামো ও অর্থনৈতিক অঞ্চল নির্মাণ এবং জ্বালানি ও বিদ্যুৎ অবকাঠামো নির্মাণ ও এখাতে বৈচিত্র্য আনা, ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’-এর পরিধি ও কর্মকাণ্ড বিস্তৃত করা, সড়ক অবকাঠামো উন্নয়ন, অভ্যন্তরীণ জলপথ, বন্দর সুবিধা বৃদ্ধি করা ও ডিপসি পোর্ট নির্মাণের উদ্যোগ, বিনিয়োগ পরিবেশ বিকাশে বিনিয়োগ প্রচার ও প্রসারকারী সংস্থা যেমন বিনিয়োগ বোর্ড, বেজা, পিপিপি দপ্তর, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়ন, গ্রাহকদের যথাযথ সেবা প্রদানের জন্য কার্যক্ষম ‘একক সেবা স্থান’ (ওয়ান স্টপ সেন্টার) সুবিধা স্থাপন প্রভৃতি।’ তিনি বলেন, ‘আমরা সব ধরনের বেসরকারি বিনিয়োগে রাজস্ব এবং রাজস্ব-বহির্ভূত আকর্ষণীয় প্রণোদনা দিচ্ছি। বিনিয়োগকারীদের প্রবেশ এবং বহির্গমন সহজ করা হয়েছে এবং তাঁরা তাঁদের বিনিয়োগকৃত অর্থ ও মুনাফা সহজেই দেশে নিয়ে যেতে পারেন।’
বাংলাদেশ সামাজিক ও অর্থনৈতিক অঙ্গনে অন্তর্ভুক্তি ও সমসুবিধা নিশ্চিত করার এক নতুন যুগে প্রবেশ করেছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, খাদ্য-উৎপাদনে আমরা স্বয়ং-সম্পূর্ণতা অর্জন করেছি। স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে অভূতপূর্ব উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। জনগণের গড় আয়ু বেড়ে ৭০ দশমিক ৭ বছর হয়েছে এবং এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলে মা ও শিশুর যত্নে বাংলাদেশ সব্বোর্চ্চ স্থান অর্জন করেছে। দারিদ্র্যসীমা হ্রাস পেয়ে ২২ দশমিক ৪ শতাংশ হয়েছে।
ব্লু ইকোনমির সুযোগ গ্রহণে বিনিয়োগকারীদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘বঙ্গোপসাগরে আমাদের অফুরন্ত সামুদ্রিক সম্পদ যথাযথভাবে ব্যবহারের জন্য বিনিয়োগকারীদের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। মিয়ানমার এবং ভারতের সঙ্গে সমুদ্র সীমানার বিরোধ নিষ্পত্তির মাধ্যমে এটি সম্ভব হয়েছে। ব্লু ইকোনমি আমাদের এখন নতুন সম্ভাবনার হাতছানি দিচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি সব সময়ই বলে থাকি সরকার ব্যবসা করবে না। ব্যবসা করবেন ব্যবসায়ীরা। আমার সরকার ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ তৈরি করে দেবে। আমরা তাই করছি।’
বর্তমান সরকারের শাসনামলে ১০০টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ১৪ হাজার ৭৭ মেগাওয়াটে উন্নীত করা এবং গ্যাসের দৈনিক উৎপাদন এক হাজার ৬০০ মিলিয়ন ঘনফুট থেকে দুই হাজার ৭২৮ মিলিয়ন ঘনফুটে উন্নীত করা হয়েছে বলেও প্রধানমন্ত্রী জানান। তিনি বলেন, ‘ভবিষ্যতে গ্যাসের ঘাটতি মেটানোর জন্য এলএনজি আমদানির পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে এবং এজন্য এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘বিগত ছয় বছরে আমাদের বাজেটের আকার প্রায় পাঁচ গুণ বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় তিন লাখ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। রপ্তানি আয় বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ৩২ দশমিক দুই বিলিয়ন ডলার। ২০০৫-২০০৬ অর্থবছরে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৩ দশমিক ৪৮ বিলিয়ন ডলার। তা আজ পৌনে আট গুণ বৃদ্ধি পেয়ে ২৭ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে।’ বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন জিডিপির ভিত্তিতে বিশ্বের ৪৫তম এবং ক্রয়ক্ষমতার ভিত্তিতে ৩৩তম স্থান অধিকার করেছে বলেও তিনি জানান।
আঞ্চলিক, উপ-আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বৃদ্ধির জন্য সরকারে প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের জোর প্রচেষ্টার ফলে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল, মধ্যপ্রাচ্য, মধ্য এশিয়া, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, আমেরিকা, আফ্রিকার সাথে আমাদের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্কের দিকগুলো আরো গভীর ও বিস্তৃত হয়েছে। ব্যবসায়ী ও জনগণের মধ্যে সম্পর্কের নতুন মাত্রা উন্মোচিত হয়েছে।’
প্রতিবেশীদের সাথে আঞ্চলিক সহযোগিতার এক নতুন যুগের সূচনা হয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘দক্ষিণ এশিয়া অদূর ভবিষ্যতে নিশ্চিতভাবে প্রবৃদ্ধির একটি বৃহৎ কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হতে যাচ্ছে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের ব্যক্তি খাতে দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের দক্ষতা বেড়েছে। উদ্যোক্তাদের মনোবল এবং দক্ষতা বেড়েছে। আমাদের বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের সক্ষমতা তৈরি হয়েছে। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতুর মতো বৃহৎ প্রকল্প বাস্তবায়নে যে সাহসী উদ্যোগ আমরা নিয়েছি, তা আমাদের সক্ষমতারই পরিচয় বহন করে।’
২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করার লক্ষ্য পুনর্ব্যক্ত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও নিরক্ষরতা দূর করে বাংলাদেশকে একটি উন্নত, সমৃদ্ধ ও শান্তিপূর্ণ দেশ হিসেবে বিশ্বের বুকে প্রতিষ্ঠা করা। আমাদের এ পথচলায় আমরা আপনাদের সহযোগিতা চাই। পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমেই এ বিশ্ব একদিন ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত হবে, অন্তত এ অঞ্চল এবং বাংলাদেশ দারিদ্র্যমুক্ত হবে বলেও তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
বার্তা সংস্থা বাসসের খবরে বলা হয়েছে, অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্য দেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত, বোর্ড অব ইনভেস্টমেন্টের ভাইস চেয়ারম্যান শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু, বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্যসচিব আবুল কালাম আজাদ, মেঘালয়ের মুখ্যমন্ত্রী ড. মুকুল সাংমা এবং ভারতের আদানী গ্রুপের চেয়ারমান গৌতম আদানী।
এফবিসিসিআই প্রেসিডেন্ট আব্দুল মাতলুব আহমেদ অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন এবং বোর্ড অব ইনভেস্টমেন্টের চেয়ারম্যান ড.এ সামাদ ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন।