জলঢাকার ধর্মপালে প্রত্নতত্ত্বের সন্ধান
![](https://ntvbd.com/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2016/01/31/photo-1454211064.jpg)
নীলফামারীর জলঢাকা উপজেলার ধর্মপাল ইউনিয়নের খেরকাটি গ্রামের গড় ধর্মপাল এলাকায় প্রত্নতত্ত্বের নিদর্শনের সন্ধান পাওয়া গেছে। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের পাওয়া এটিই জেলার একমাত্র প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হতে যাচ্ছে। এ ছাড়া খনন এলাকা থেকে ২০০ গজ দূরে সবুজপাড়ায় আরেকটি প্রত্নতত্ত্বের সন্ধান মিলেছে।
জলঢাকার এ ধর্মপাল গড়ে সর্বপ্রথম ১৯৯০ সালে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর খননকাজ শুরু করে। ধর্মপাল গড়ের উত্তর বাহুর পূর্বাংশে কয়েকটি বর্গে খনন করা হয়। সে সময় সর্বোচ্চ সাত/আট ফুট গভীর পর্যন্ত খনন করা হয়। খননের ফলে কোনো প্রকার স্থাপত্য কাঠামো বা প্রত্নতত্ত বস্তু পাওয়া যায়নি। শুধু বালুর স্তর প্রকাশ পায়। একই সময়ে গড়ের দক্ষিণ বাহুর কয়েকটি স্থানে ৮/১০ ফুট গভীরে খনন করা হয়। এ বাহুতেও কোনো প্রকার স্থাপত্য কাঠামো বা প্রত্নতাত্ত্বিক বস্তু পাওয়া যায়নি।
সে সময়ে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর তাদের খননকাজে উল্লেখ করে, ধর্মপাল গড়ের প্রাচীরগুলো মাটির তৈরি। তাদের এ বক্তব্যের যৌক্তিকতাও তারা পেশ করে। ১৮৭৬ সালে ভারতের তৎকালীন ইংরেজ মেজর রেনেল ধর্মপাল গড় সার্ভে (জরিপ) করেন। তিনি এ সময় তিস্তা নদীর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলোতেও ব্যাপক সার্ভে পরিচালনা করেন। সার্ভে শেষে তিনি উল্লেখ করেন, তিস্তা নদীতে প্রতিবছর বন্যার ফলে তিস্তা অববাহিকার এ এলাকাগুলো প্লাবিত হয়। যার ফলে বালুতে এ অঞ্চল গঠিত হয়েছে। ১৯৯০ সালের পর দীর্ঘ বিরতি শেষে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর পুনরায় ধর্মপাল গড়ে প্রত্নতাত্ত্বিক খননের সিদ্ধান্ত নেয়। এরই আলোকে এ বছরের ১ জানুয়ারি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের একটি খননকারী দল এ এলাকায় আসে খননের জন্য। এই খননকারী দল এ অঞ্চলের দুর্গ প্রাচীর এবং এর অভ্যন্তরীণ অংশ, ময়নামতির কোট, খেরকাটি পীরের মাজার, সতীশের ডাঙ্গা, হাজীপাড়া শাহি মসজিদে জরিপকাজ পরিচালনা করে। এ সময় খননকারী দলের কাছে প্রতীয়মান হয়, ধর্মপাল গড়ের কোথাও না কোথাও স্থাপত্য কাঠামোর সন্ধান পাওয়া যেতে পারে। সে লক্ষ্যেই গড়টিকে কয়েকটি সেক্টরে ভাগ করে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে জরিপ কাজ পরিচালনা করা হয়। এর পরেই গড়ের পূর্ব বাহু, দক্ষিণ বাহু ও মধ্য বাহুতে পরীক্ষামূলক খননকাজ শুরু করে। বিশেষ করে গড়ের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে পরিখার বাইরে প্রাচীরে খনন করার সময় ইটের অবকাঠামোর কিছু নিদর্শনের অস্তিত্ব মেলে। এরপর পর্যায়ক্রমে এ পরীক্ষামূলক খননে পূর্ব-পশ্চিমে প্রলম্বিত একটি ইটের দেয়াল পাওয়া যায়। দেয়ালটিতে একটি প্রজেকশন রয়েছে। এখনো দেয়ালের শেষ প্রান্ত পাওয়া যায়নি। খননের প্রাথমিক পর্যায়ে এ ধরনের প্রত্নবস্তুর সন্ধান পাওয়ায় খননকারী দল আশার আলো দেখছেন। হয়তো সময়ব্যাপী খনন করা হলে এ গড়ের স্থাপত্য কাঠামো সম্পর্কে বাস্তব ধারণা পাওয়া যাবে।
লোকমুখে এ গড়ের ইতিহাস সম্পর্কে জানা যায়, পাল বংশের রাজা ধর্মপাল এখানে বাস করতেন। এখান থেকে তিনি রাজ্য পরিচালনা করতেন। এটা ছিল তার রাজপ্রাসাদ। তারই নামানুসারে এ এলাকার নাম হয়েছে ধর্মপাল। এখানকার মানুষের ধারণা, প্রায় ৫০০ কিংবা হাজার বছর আগে এ স্থাপনা নির্মাণ হয়েছিল। ঐতিহাসিকভাবে এ লোককথার সত্যতা মেলা ভার। কথিত রয়েছে, গড় ধর্মপালের পূর্ব দিকে একটি ছোট নদীর তীরে ধর্মপালের রাজপ্রাসাদ ছিল। ধর্মপালের গড় থেকে ১/২ মাইল উত্তর-পশ্চিমে একটি মজে যাওয়া জলাশয় রয়েছে, যার পূর্বপাড়ে বাঁধানো ঘাট ও একটি উঁচু মাটির ঢিবি এবং ঢিবির ভেতরের প্রাচীরের ইট দেখে অনেকে এটাকে ধর্মপালের রাজবাড়ি মনে করে থাকেন।
তবে স্থানীয় বাসিন্দারা এর প্রকৃত ইতিহাস বলতে পারছেন না। ঐতিহাসিক সত্যতা অনুযায়ী প্রাচীন বাংলা যে কয়টি ভাগে ভাগ ছিল, তারই কামরূপ অংশের একটি অঞ্চল হল নীলফামারী জেলা। বাংলার কামরূপ অঞ্চল কখনো পাল বংশের শাসনাধীন ছিল না। সে সূত্রে এ ঐতিহাসিক স্থাপনা পাল রাজা ধর্মপালের কি না, তা আজ প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। যদি পাল বংশের স্থাপনা হয়, তবে এ স্থাপনার বয়স হবে প্রায় হাজার বছর। কেননা, বাংলায় পাল বংশের সমাপ্তি ঘটে ১১৫৮ খ্রিস্টাব্দে। আবার কিছু কিছু ঐতিহাসিক মনে করেন, পাল বংশের শেষ দিকের রাজা হর্ষবর্ধন দেবের ছেলে ধর্মপাল হয়তো এ অঞ্চল দখলে নিতে যুদ্ধবিগ্রহ করতে এসে এখানে দুর্গ গড়ে তুলেছেন। কেননা, এ গড়ের অদূরেই রয়েছে ধর্মপাল-এর শ্যালিকা ময়নামতির নামে ময়নামতির গড়। যদি এসব তথ্যর ঐতিহাসিক সত্যতা মেলে, তাহলে এ স্থাপনা দশম কিংবা একাদশ শতাব্দীতে তৈরি হয়েছে। এ অঞ্চল ঐতিহাসিকভাবে একটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা। এ গড়ের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ঐতিহাসিক নদী গুপ্তবাসী। এ নদীর এক তীরে ধর্মপাল গড় আর অপর তীরে বিখ্যাত সুফি সাধক গৌড় কামাল পীর সাহেবের মাজার। এ অঞ্চল প্রাচীনকাল থেকে একটি সুখী সমৃদ্ধ অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী একটি অঞ্চল হিসেবে সুবিদিত ছিল। তিস্তা, করতোয়া, দেওনাই, গুপ্তবাসী বিধৌত এ এলাকাটি তার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সুখ্যাতির কারণে প্রাচীন রাজা-বাদশাদের দৃষ্টির মধ্যেই ছিল। এ কারণেই এ অঞ্চলটিকে দখলে নিতে যে যার সুবিধামতো প্রায়ই এ এলাকায় যুদ্ধবিগ্রহ লাগাত। প্রাচীন বাংলার সে ঐতিহাসিক মূল্য থেকে এ গড়টিকে একটি দুর্গ নগরী হিসেবে মনে করছে ইতিহাসবিদরা।
খননকারী দলের মতে, ঐতিহাসিকভাবে যেহেতু এ অঞ্চল কামরূপ অঞ্চলে অবস্থিত। আর কামরূপ অঞ্চল কখনো পাল শাসনাধীনে ছিল না, সে হিসাবে এ স্থাপনা পাল বংশের হওয়া নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। তবে স্থাপত্য দেখে মনে হচ্ছে, এ গড়ে কখনো দীর্ঘ সময়ে কেউ ছিল না। কারণ স্থাপত্যর গঠন অনুযায়ী তাই মনে হয়। তবে স্থাপত্যর গঠন অনুযায়ী এটি একটি দুর্গ নগরী বলে মনে হচ্ছে। পুরোপুরি খনন শেষেই এর ঐতিহাসিক মূল্যমান বোঝা যাবে।
ধর্মপাল গড়ে খননকারী দলে রয়েছেন, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের রাজশাহী বিভাগের আঞ্চলিক পরিচালক নাহিদ সুলতানা, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর বগুড়ার মহাস্থানগর জাদুঘরের কাস্টোডিয়ান মুজিবুর রহমান, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর রংপুর জাদুঘরের কাস্টোডিয়ান আবু সাইদ ইনাম তানভিরুল, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর মহাস্থানগড় জাদুঘরের অ্যাসিস্ট্যান্ট কাস্টোডিয়ান এসএম হাসনাত বিন ইসলাম, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর রাজশাহী বিভাগের সিনিয়র ড্রাফটম্যান আফজাল হোসেন, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর রাজশাহী বিভাগের আলোকচিত্রকর আবুল কালাম আজাদ ও প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর রাজশাহী বিভাগের সার্ভেয়ার লোকমান হোসেন। প্রত্নতত্ত্ব নিদর্শনের সন্ধান পাওয়ার খবরে ধর্মপালগড়ে নেমেছে সহস্র মানুষের ঢল। ওই এলাকার ঐতিহাসিক প্রচারণায় এতদিনের অবহেলিত পরিত্যক্ত জায়গাটি নতুন করে ফিরে পেয়েছে তার প্রাণ চাঞ্চল্য। উৎসুক জনতা একনজর দেখার জন্য আসছেন দূর-দূরান্ত থেকে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সেখানে পুলিশ ও আনসার বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে।