মরছে অভয়াশ্রমের মাছ, অভিযোগ চিনিকলের দিকে
পঞ্চগড়ে করতোয়া নদীর মৎস্য অভয়াশ্রমের কয়েক শ মণ মাছ মরে গেছে। পঞ্চগড় চিনিকল ও এশিয়া ডিস্টিলারিজ পরিশোধন না করেই বিষাক্ত বর্জ্য নদীতে ফেলায় এই ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। তবে উভয় কারখানা কর্তৃপক্ষ এ অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, গতকাল শুক্রবার সকাল থেকেই করতোয়া নদীর কয়েকটি অভয়াশ্রমের মাছ মরে ভেসে উঠতে শুরু করে। ১০-১৫ কেজি ওজনের বোয়াল, আইড়, গ্রাসকার্পসহ ছোট-বড় নানা প্রজাতির মাছ মরে ভেসে ওঠে নদীতে। সকাল ৮টার দিকে স্থানীয় লোকজন নদীতে মাছ ধরতে শুরু করে। খবরটি ছড়িয়ে পড়লে আশপাশের এলাকার শত শত মানুষ নদী থেকে মাছ ধরা শুরু করে। সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত নদীতে মাছ ধরা হয় বলে জানিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা।
খবর পেয়ে বোদা উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আবু আউয়াল, মৎস্য কর্মকর্তা মকছেদুর রহমান, বেংহারী বনগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ ও কালিয়াগঞ্জ ইউপির চেয়ারম্যান ফজলার রহমান ঘটনাস্থলে যান।
মৎস্য কর্মকর্তা মকছেদুর রহমান এনটিভি অনলাইনকে জানান, সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত শত শত মানুষ নদীতে মরে যাওয়া মাছ ধরেছে। এতে প্রায় কোটি টাকারও বেশি ক্ষতি হয়েছে। শুধু তাই নয়, মাছের প্রজনন মৌসুমে এভাবে মা-মাছ ধ্বংস হওয়ায় দেশি মাছের প্রজনন ব্যাহত হবে এবং চলতি মৌসুমে দেশীয় মাছের তীব্র সংকট দেখা দেবে।
মৎস্য কর্মকর্তা আরো জানান, কারখানার বিষাক্ত বর্জ্যে নদীর পানি দূষিত হওয়ায় মাছের মৃত্যু হয়। মৎস্য অভয়াশ্রমসহ করতোয়া নদীর বিশাল এলাকাজুড়ে এ বর্জ্য ছড়িয়ে পড়ায় নদীর পানি বিষাক্ত হবে এবং পরিবেশে বিরূপ প্রভাব পড়বে। অন্যদিকে নদীর ছোট-বড় মাছ, পোনা, জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদের ব্যাপক ক্ষতি হতে পারে বলে আশঙ্কা করেছেন মৎস্য কর্মকর্তা।
করতোয়া নদীর নলকুড়া অভয়াশ্রম মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক মখলেছুর রহমান ও কালিয়াগঞ্জ মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সভাপতি আবদুল আজিজ জানান, পঞ্চগড় চিনিকল বা এশিয়া ডিস্টিলারিজ লিমিটেডের তরল বর্জ্যে নদীর মাছ মারা যেতে পারে বলে তাঁরা আশঙ্কা করছেন। এ ঘটনায় ক্ষতিপূরণ চেয়ে জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন করবে বলে জানিয়েছে মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি।
অভয়াশ্রমের মাছ রক্ষার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালানো হচ্ছে উল্লেখ করে বোদার ইউএনও আবু আউয়াল জানান, উপজেলার বেংহারী বনগ্রাম ও কালিয়াগঞ্জ ইউপির চেয়ারম্যানকে ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। নদীতে পর্যাপ্ত বাঁশ-গাছ ফেলাসহ মাছ রক্ষায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
এশিয়া ডিস্টিলারিজ লিমিটেডের স্থানীয় উৎপাদন ব্যবস্থাপক শামসুল হুদা জানান, ‘সাতদিনেরও বেশি সময় ধরে ডিস্টিলারিজে কোনো উৎপাদন হচ্ছে না। তা ছাড়া আমরা কোনো বর্জ্য নদীতে ফেলি না। আমাদের নিজস্ব বর্জ্য শোধনাগার আছে।’
চিনিকলে উৎপাদন মৌসুম শেষ হওয়ার ব্যাপারটি জানিয়ে পঞ্চগড় চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এস এম আবদুর রশীদ বলেন, বর্জ্য সুড়ঙ্গ ড্রেনের মাধ্যমে করতোয়া নদীতে ফেলা হয়। চিনিকলের বর্জ্যে কোনো বিষাক্ত পদার্থ বা কেমিকেল নেই। চিনিকলের বর্জ্যে মাছ মারা যাওয়ার বিষয়টি তিনি অস্বীকার করেন।
তবে মৎস্য কর্মকর্তা ও স্থানীয়দের অভিযোগ, গত ৯ মার্চ পঞ্চগড় চিনিকল বন্ধ হয়েছে। বন্ধের পর চিনিকলের বিষাক্ত বর্জ্য সংশোধন না করে নদীতে ছেড়ে দেওয়া হয়। এতে নদীর পানি কালো হয়ে শুক্রবার সকাল থেকে করতোয়া নদীর মাছ মরে ভেসে উঠতে শুরু করে। পঞ্চগড় সদর থেকে বোদা উপজেলার তেপুকুরিয়ার বোয়ালমারী পর্যন্ত প্রায় ২৫ কিলোমিটার নদীপথের নলকুড়া, সারোগাড়া, টেংরামনি, নলকুড়ামণি, ফুলতলা, বন্দর মণি ও বোয়ালমারী মৎস্য অভয়াশ্রমের কয়েক শ মণ মাছ মরে গেছে।
সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পঞ্চগড় চিনিকলের উৎপাদন মৌসুম শেষ হওয়ায় চিনিকলের কারখানার যন্ত্রপাতি বিষাক্ত কস্টিং সোডা দিয়ে ধোয়া হয়। এ ছাড়া চিনিকলের ড্রেনগুলোও মাছের জন্য বিষাক্ত জীবাণুনাশক দিয়ে পরিষ্কার করা হয়। গত বৃহস্পতিবার গভীর রাতে এসব বর্জ্য করতোয়া নদীতে ফেলা হয়। এতে ভোর থেকেই করতোয়া নদীর মাছ মরতে শুরু করে এবং নদীতে ভেসে ওঠে।