পুলিশ হত্যার স্মৃতি আতঙ্ক ছড়িয়েছে ঢালারচরের ভোটে

ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন নিয়ে পাবনার বেড়া উপজেলার ঢালারচরবাসীর দিন কাটছে চরম আতঙ্কে। গত ৩ মার্চ প্রতীক বরাদ্দের পর থেকে প্রতিদ্বন্দ্বী দুই প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে একের পর এক সংঘর্ষ ঘটায় ও উত্তেজনা বেড়ে চলায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এ ছাড়া নির্বাচনকে সামনে রেখে এলাকায় চরমপন্থীদের আনাগোনা বেড়েছে বলে এলাকাবাসীর অভিযোগ। তবে পুলিশ তা অস্বীকার করেছে।
গত শনিবার (২০ মার্চ) রাতে আওয়ামী লীগ ও একই দলের ‘বিদ্রোহী প্রার্থীর’ সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে গহের মণ্ডল (৩০) নামে এক ব্যক্তি নিহত এবং ১০ জন গুলিবিদ্ধ হয়। এ ঘটনায় ইউনিয়নবাসীর আতঙ্ক চরমে পৌঁছে।
এলাকাবাসী জানায়, পদ্মা ও যমুনা নদীর দুর্গম চরাঞ্চল নিয়ে ঢালারচর ইউনিয়ন গঠিত। দুর্গমতার কারণে এ ইউনিয়নটি চরমপন্থীদের অভয়ারণ্য বলে পরিচিত। ২০১০ সালের ২০ জুলাই ঢালারচর পুলিশ ফাঁড়ির দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাসহ তিন পুলিশ সদস্য চরমপন্থীদের হাতে নিহত হন।
এর আগে ২০০০ সালের ১১ সেপ্টেম্বর ঢালারচর ইউনিয়নের কোমরপুর গ্রামে চরমপন্থীদের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে বেড়া থানার উপপরিদর্শক (এসআই) হেদায়েতুল ইসলাম ও চরমপন্থী দলের তিন সদস্য নিহত হন। এ ছাড়া চরমপন্থীদের হাতে গত ১৫ বছরে এ ইউনিয়নে ঘটেছে আরো অনেক হত্যাকাণ্ড।
তবে ২০১০ সালের ২০ জুলাই চরমপন্থীদের হাতে তিন পুলিশ সদস্য নিহত হওয়ার পর ব্যাপক পুলিশি অভিযান চালানো হয় ঢালার চরে। এরপর এলাকাটি অনেকটাই চরমপন্থীশূন্য হয়ে পড়ে। গত পাঁচ বছর চরমপন্থীরা এলাকা থেকে দূরে সরে ছিলেন। ইউপি নির্বাচনকে সামনে রেখে আবারও তাদের আনাগোনা শুরু হয়েছে বলে এলাকাবাসীর অভিযোগ।
জেলা ও বেড়া উপজেলা বিএনপির উদ্যোগে গত ১৬ মার্চ পাবনা প্রেসক্লাবে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে ঢালারচর ইউনিয়নে চরমপন্থীদের বিষয়টিও তুলে ধরা হয়।
এ ব্যাপারে উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক রইচ উদ্দিন জানান, ‘ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে সামনে রেখে আওয়ামী লীগ প্রার্থী ও একই দলের বিদ্রোহী প্রার্থী চরমপন্থীদের সহায়তা নিচ্ছেন। এ কারণে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী প্রচারণার ক্ষেত্রে অনেকটাই নিষ্ক্রিয় হয়ে রয়েছেন।’
এলাকাবাসী জানায়, ঢালারচর ইউপি নির্বাচনে একটি কথা বেশ প্রতিষ্ঠিত। আর তা হল এখানে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হতে হলে চরমপন্থীদের সমর্থন লাগবেই। তবে ১৯৮৪ সালের পর থেকে গত ৩২ বছরে চেয়ারম্যান পদে যাঁরা নির্বাচিত হয়েছেন তাঁদের একজনও এলাকায় থেকে দায়িত্ব পালন করতে পারেননি। নির্বাচিত হওয়ার পর পরই চরমপন্থী ও দুর্গমতার অজুহাত দেখিয়ে ইউনিয়নের বাইরে নিরাপদ কোনো স্থানে অস্থায়ী ইউপি কার্যালয় বসিয়ে দায়িত্ব পালন করেছেন তাঁরা। এতে চেয়ারম্যানদের কাছে না পেয়ে ইউনিয়নের বাসিন্দারা বঞ্চিত হয়েছেন নাগরিক সুবিধা থেকে।
এদিকে গত শনিবার (১৯ মার্চ) প্রতিদ্বন্দ্বী দুই প্রার্থীর সমর্থকদের সংঘর্ষে একজন নিহত ও ১০ জন আহত হওয়ার পর গতকাল রবিবার ঢালারচরে গিয়ে এলাকাবাসীর মধ্যে চরম আতঙ্ক লক্ষ করা গেছে। ইউনিয়নের বাজারগুলোর বেশির ভাগ দোকান বন্ধ থাকতে দেখা গেছে।
মিরপুর গ্রামের আইজুদ্দিন মণ্ডল (৭০), রামনারায়ণপুর গ্রামের কটাই মণ্ডল (৮০) জানান, এমনিতেই কয়েকদিন ধরে ভয়ে ছিলেন তাঁরা। এরই মধ্যে শনিবার রাতের ঘটনা তাঁদের আতঙ্ক চরম বাড়িয়ে দিয়েছে। বৃষ্টির মতো গুলির শব্দে অনেক বাড়িতে নারী ও শিশুরা ভয়ে কান্নাকাটি শুরু করে বলে তাঁরা জানান।
এদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চার-পাঁচজন গ্রামবাসী জানান, নির্বাচনী কর্মকাণ্ড শুরুর পর থেকে রাতের বেলায় এলাকায় প্রায়ই অপরিচিত লোকজনকে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়। এ অবস্থায় ভোট দেওয়া নিয়ে চরম উৎকণ্ঠার কথা জানান তাঁরা।
এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগ প্রার্থী কোরবান আলী ও বিদ্রোহী প্রার্থী নাছিরুদ্দিন উভয়েই চরমপন্থীদের সঙ্গে নিজেদের সংশ্লিষ্টতার কথা অস্বীকার করেন।
এ ব্যাপারে পাবনার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার লিটন কুমার সাহা বলেন, ঢালারচরে চরমপন্থীদের অস্তিত্ব নেই। নির্বাচনকে সামনে রেখে দুই-একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটলেও তা নিয়ে এলাকাবাসীর আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। এলাকার নিরাপত্তা বজায় রাখার জন্য পুলিশি টহল বাড়ানোর পাশাপাশি আমরা সর্বদা সজাগ দৃষ্টি রেখেছি।