মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধাকে কটাক্ষ করলে জেল-জরিমানা
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি বা মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে কটাক্ষ করার শাস্তি পাঁচ বছরের কারাদণ্ড এবং এক কোটি টাকা জরিমানা।
উল্লিখিত বিধান সংবলতি একটি আইন করতে যাচ্ছে সরকার।
‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতিকরণ অপরাধ আইন, ২০১৬’ শিরোনামে তৈরি করা আইনের খসড়াটি এখন আইন মন্ত্রণালয়ের লেজিসলেটিভ ও ড্রাফটিং বিভাগ পর্যালোচনা করে দেখছে। প্রস্তাবিত এ আইনের খসড়া তৈরি করেছে আইন কমিশন।
আইনে অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে সংক্ষিপ্ত বিচারের (সামারি ট্রায়াল) প্রস্তাব করা হয়েছে। বিচারক মামলাটি আমলে নেওয়ার পর কোনো পক্ষকে সময় না দিয়ে প্রতি কার্যদিবসে শুনানি করে ৪৫ দিনের মধ্যে বিচার নিষ্পত্তি করবেন।
প্রস্তাবিত আইনের খসড়ার বিষয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, ‘এ ধরনের একটি আইনের অপরিহার্যতা রয়েছে। মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কটাক্ষ করা হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি হচ্ছে। এটা রোধে একটি আইনের প্রয়োজন। আইন কমিশন এ ধরনের একটি আইনের খসড়া তৈরি করে আমাদের কাছে পাঠিয়েছে। আমরা এটি এখন পর্যালোচনা করে দেখছি।’
যেসব বিষয়কে অপরাধ বলা হয়েছে
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি ও এ বিকৃতিকে সমর্থনকারী উভয় ব্যক্তিই এই আইনের বর্ণিত অপরাধের আওতায় আসবেন।
খসড়া আইনের ৪ (১) ধারায় অপরাধের বিবরণ দিয়ে বলা হয়েছে যে, ‘(ক) ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্ট তারিখ হইতে ১৯৭১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি মধ্যবর্তী সময়ে মুক্তিযুদ্ধের ক্ষেত্র প্রস্তুতকারী ঘটনাসমূহ অস্বীকার;
(খ) ১৯৭১ সালের ১লা মার্চ তারিখ হইতে ১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ মধ্যবর্তী ঘটনাসমূহ অস্বীকার; (গ) ১৯৭১ সালের ২৬ শে মার্চ তারিখ হইতে ১৯৭১ সালের ১৬ ই ডিসেম্বর মধ্যবর্তী সময়ে মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাসমূহ অস্বীকার; (ঘ) মুক্তিযুদ্ধের কোনো ঘটনাবলীকে হেয় প্রতিপন্ন করিবার উদ্দেশে দেশি বা বিদেশি গণমাধ্যম বা প্রচারমাধ্যমে বিদ্বেষমূলক বক্তব্য প্রচার; (ঙ) সরকার কর্তৃক এ যাবতকালে প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংক্রান্ত যেকোনো ধরণের প্রকাশনার অপব্যাখ্যা বা অবমূল্যায়ন; (চ) পাঠ্যপুস্তকসহ যেকোনো মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে ভ্রান্ত বা অর্ধসত্যভাবে উপস্থাপন; (ছ) মুক্তিযুদ্ধের শহীদ, বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধা, জনগণকে হত্যা, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ এবং লুটতরাজসংক্রান্ত যেকোনো তথ্যের অবনমন; (জ) মুক্তিযুদ্ধসংক্রান্ত কোনো ঘটনা, তথ্য বা উপাত্ত ব্যাঙ্গাত্মকভাবে উপস্থাপন; (ঝ) মুক্তিযুদ্ধকে জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রাম ভিন্ন অন্য কোন নামে অবনমন বা অবমাননা; (ঞ) ১৯৭১ সালে পাকিস্তান দখলদার সশস্ত্রবাহিনী, বিভিন্ন সহায়ক বাহিনী ও তাহাদের সহায়ক বাহিনী, যেমন : রাজাকার, আল বদর, আল শামস ও শান্তি কমিটি ইত্যাদির বিভিন্ন অপরাধমূলক কার্যক্রমের পক্ষে কোনো ধরনের যুক্তি প্রদর্শন বা প্রচারণা; এবং (ট) মুক্তিযুদ্ধে সংগঠিত মানবতাবিরোধী অপরাধ, শান্তিবিরোধী অপরাধ, গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধকে সমর্থন বা উক্তরূপ অপরাধের বিচার কার্যক্রমকে প্রশ্নবিদ্ধকরণ বা এতদবিষয়ে কোনো ধরনের অপপ্রচার।’ এগুলো সবই অপরাধের আওতায় আসবে।
একই ধারার ২ নং উপধারায় বলা হয়েছে , উপরোক্ত অপরাধ সংঘটনকারী ব্যক্তির পক্ষে যিনি বা যারা সমর্থন জানাবেন, তিনিও সমানভাবে অপরাধী বলে গণ্য হবেন।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির শাস্তি
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির সাজা হিসেবে খসড়া আইনের ৫ (১) নং ধারা বলা হয়েছে, ‘যদি কোনো ব্যক্তি ৪ ধারায় বর্ণিত কোনো অপরাধ করে, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তি অন্যূন ৩ (তিন) মাস এবং অনূর্ধ্ব ৫ (পাঁচ) বৎসর বিনাশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবে এবং ইহার অতিরিক্ত সর্বোচ্চ ০১ (এক) কোটি টাকা অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হইবে।’
একই ধারার ২ নম্বর উপধারায় বলা হয়েছে, ‘এই ধারায় উল্লিখিত কোনো অপরাধের জন্য দণ্ডিত হইয়া দণ্ড ভোগ করিবার পর কোনো ব্যক্তি পুনরায় এই আইনের অধীন কোনো অপরাধ করে, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তি পূর্বে যে দণ্ডে দণ্ডিত হইয়াছিল, কমপক্ষে উহার দ্বিগুণ দণ্ডে দণ্ডনীয় হইবে।’
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির বিচার প্রক্রিয়া
খসড়া আইনের ১০ নম্বর ধারায় এ মামলার বিচার প্রক্রিয়া সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘এই আইনের অধীন অপরাধসমূহ দায়রা আদালত, ক্ষেত্রমতো মহানগর দায়রা আদালত কর্তৃক বিচার্য হইবে : তবে শর্ত থাকে যে, দায়রা জজ, ক্ষেত্রমতো মহানগর দায়রা জজ তাহার অধীন অন্য কোনো অতিরিক্ত দায়রা জজ বা অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ এর নিকট মামলা বিচার ও নিষ্পত্তির জন্য প্রেরণ করিতে পারিবে। এই আইনের অধীন সংঘটিত কোনো অপরাধের অভিযোগ গঠনের পর ৪৫ (পয়ঁতাল্লিশ) কার্যদিবসের মধ্যে আদালত বিচারকার্য সম্পন্ন করিবে : তবে শর্ত থাকে যে, উক্ত বিধান সত্ত্বেও, উক্ত সময়সীমার মধ্যে বিচারকার্য সম্পন্ন না হইবার কারণ ব্যাখ্যা করিয়া পরবর্তী ৩০ (ত্রিশ) কার্যদিবসের মধ্যে বিচারকার্য সম্পন্ন করিতে হইবে : তবে আরো শর্ত থাকে যে, নির্ধারিত সময়ে বিচারকার্য সম্পন্ন করিতে ব্যর্থতার সাথে জড়িত ব্যক্তির বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আদালত উপযুক্ত কর্তৃপক্ষকে আদেশ দিতে পারিবে। বিচার শুরু হইলে উহা শেষ না হওয়া পর্যন্ত প্রতি কর্মদিবসে একটানা শুনানি চলিবে। আদালত এই আইনের অধীন সংঘটিত অপরাধের বিচার সংক্ষিপ্ত পদ্ধতিতে সম্পন্ন করিবে এবং এতদুদ্দেশ্যে এই আইনে ভিন্নতর কিছু না থাকিলে, ফৌজদারি কার্যবিধির ২২ অধ্যায়ে বর্ণিত পদ্ধতি, যতদূর প্রযোজ্য হয়, অনুসরণ করিবে।’
আইনটি কার্যকর হলে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও এর মর্যাদা সংরক্ষিত হবে বলে মনে করেন আইনমন্ত্রী। এনটিভি অনলাইনকে তিনি আরো বলেন, আইনের খসড়াটি পর্যালোচনা করে শিগগির পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।