পাহাড়ের প্রচলিত আইনের অসঙ্গতি সংশোধনের প্রস্তাব

পার্বত্য তিন জেলায় সুষ্ঠু বিচারব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রচলিত আইনের বিদ্যমান অসঙ্গতি, অস্পষ্টতা ও অসম্পূর্ণ বিষয়গুলো সংশোধনের প্রস্তাব দিয়েছেন বিশিষ্টজনরা।
আজ শুক্রবার রাঙামাটিতে অনুষ্ঠিত দিনব্যাপী সেমিনারে প্রস্তাবটি তুলে ধরেন স্থানীয় রাজনীতিক, জনপ্রতিনিধি, বিচারপতি ও সুশীলসমাজের প্রতিনিধিরা।
পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের সম্মেলন কক্ষে সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত ‘তিন পার্বত্য জেলায় দেওয়ানী বিচারব্যবস্থায় বিদ্যমান অসঙ্গতি ও অস্পষ্টতা এবং সেগুলো নিরসনের প্রয়োজনীয়তা’ শীর্ষক সেমিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতি মো. নিজামুল হক নাসিম।
এ ছাড়া জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু), চাকমা সার্কেল চিফ ব্যারিস্টার রাজা দেবাশীষ রায়, জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থার পরিচালক মালিক আবদুল্লাহ আল-আমিন সেমিনারে বক্তব্য রাখেন।
রাঙামাটি জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট প্রতীম রায়ের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সেমিনারে আলোচনায় অংশ নেন রাঙামাটি জেলা ও দায়রা জজ মো. কাউসার, বান্দরবানের জেলা ও দায়রা জজ মো. শফিকুর রহমান, রাঙামাটি জেলা প্রশাসক মো. সামসুল আরেফিন, বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) পরিচালক ইদ্রিসুর রহমান, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের সিনিয়র কর্মকর্তা মাহমুদুর রহমান তন্ময়, রাঙামাটির বিশিষ্ট আইনজীবী মোক্তার আহমদ, অ্যাডভোকেট জ্ঞানেন্দু বিকাশ চাকমা, বান্দরবানের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) ড. মহিউদ্দিনসহ স্থানীয় আইনজীবী, গবেষক, রাজনৈতিক, আইন, শাসন ও বিচার বিভাগীয় পদস্থ কর্মকর্তারা।
সেমিনারে বক্তারা বলেন, ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধিসহ অন্যান্য প্রচলিত আইনে অসঙ্গতি, অস্পষ্টতা, অসম্পূর্ণতা ও সাংঘর্ষিক ধারা বিদ্যমান। এ ছাড়া তিন পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে দেওয়ানি বিচারব্যবস্থায় অসঙ্গতি ও অসম্পূর্ণতার কারণে ওই তিনটি পার্বত্য জেলায় বিচারব্যবস্থা ব্যাহত হচ্ছে। সুষ্ঠু বিচার পাওয়া নিয়ে চরম হয়রানির শিকার হচ্ছেন তিন জেলার লোকজন। সেগুলো দূরীকরণে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর সই করা সর্বশেষ পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির শর্তে প্রণীত আইনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ করে বিদ্যমান আইনি জটিলতা নিরসন করতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন আইনগুলোর সংশোধন। আর এই উদ্যোগটি নিতে হবে সরকারকেই।
সেমিনারে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতি মো. নিজামুল হক বলেন, সম্প্রতি এক মামলায় পার্বত্য চট্টগ্রামের বিচারব্যবস্থার ওপর ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ দিয়ে উচ্চ আদালত একটি রায় দিয়েছেন। রায়ে দেওয়া ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, দেশে যত আইন প্রচলিত সেগুলোর সব আইন পার্বত্য চট্টগ্রামের বেলায় প্রযোজ্য নয়। মূলত সেখানে প্রচলিত প্রথাগত আইন ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধির অনুসরণে সেখানকার বিচারকার্য পরিচালিত হয়ে থাকে। ওই আইনে পার্বত্য তিন জেলায় পারিবারিক আদালতের বিরোধ নিষ্পত্তি করে থাকেন মৌজা ও সার্কেল চিফরা। সে ক্ষেত্রে তিন পার্বত্য জেলায় সুষ্ঠু বিচারব্যবস্থা নিশ্চিত করতে প্রচলিত আইনে যদি কোনো অসঙ্গতি ও অসম্পূর্ণতা থেকে থাকে জনস্বার্থে সেগুলো নিরসন হওয়া দরকার। এতে করে এ অঞ্চলের মানুষের আইনগত অধিকার প্রতিষ্ঠাসহ সঠিক বিচারব্যবস্থা নিশ্চিত করা সম্ভব।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের উপজাতি সেখানকার জনগোষ্ঠীর অধিকার নিশ্চিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন ছাড়া কোনো উপায় নেই। পার্বত্য শান্তিচুক্তি পূর্ণাঙ্গ রূপে বাস্তবায়িত হলেই এ অঞ্চলের সব সমস্যা ও জটিলতা নিরসন হয়ে যাবে।
ড. মিজান আরো বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের বেলায় রাষ্ট্রের এমন কিছু করা উচিত হবে না- যাতে করে সেখানে কোনোভাবেই সম্প্রীতি ক্ষুণ্ণ হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামে যা কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হবে সেখানে উপজাতি মানুষের স্বার্থ রক্ষাসহ তাদের মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রেখেই অগ্রসর হতে হবে। সেই দায়িত্ব পালন করতে হবে রাষ্ট্রকে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ চেয়ারম্যান সন্তু লারমা বলেন, আইন, বিচার, শাসনতান্ত্রিক ও ভূমি ব্যবস্থাপনাসহ পার্বত্য চট্টগ্রামে যেসব সমস্যা ও জটিলতা বিরাজমান সেগুলো পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ার কারণেই নিরসন হচ্ছে না। পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন হলে বিচারিক ব্যবস্থাসহ বিদ্যমান সবগুলো জটিলতার সুরাহা হয়ে যাবে। তিনি অভিযোগ করে বলেন, প্রশাসনিক ক্ষেত্রে তিন পার্বত্য জেলার ডিসিরা তিন ধরনের কাজ করে থাকেন। পার্বত্য অঞ্চলে সার্বিক ক্ষেত্রে শাসক ও শোষিতের মধ্যে যে দূরত্ব বজায় রয়েছে তা দূর করতে পার্বত্য চুক্তির আলোকে প্রণীত আইনগুলো কার্যকর হতে হবে বলে মন্তব্য করেন সন্তু লারমা।
চাকমা সার্কেল চিফ রাজা ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায় বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে বিদ্যমান আইনে যেসব অসঙ্গতি রয়েছে সেগুলো চিহ্নিত করে সংশোধনসহ আইন প্রণয়নের জন্য সুপারিশ পেশ করতে হবে।