নড়িয়ায় স্কুলছাত্রীর আত্মহত্যার প্ররোচনায় মামলা
শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার বারইপাড়া গ্রামে অহনা আক্তার মুন্নী (১৪) নামে এক স্কুলছাত্রীর মৃত্যুর ঘটনায় আত্মহত্যায় প্ররোচনা ও অপবাদ দেওয়ার অভিযোগে মামলা হয়েছে। একই গ্রামের মজিদ লাকরিয়াকে (৫০) আসামি করে নড়িয়া থানায় ওই মামলা করেছেন অহনার বড় ভাই।
নড়িয়া থানার পুলিশ ও স্থানীয় সূত্র জানায়, উপজেলার বারইপাড়া গ্রামের ইসমাইল ঢালীর মেয়ে অহনা আক্তার মুন্নী (১৪)। স্থানীয় পণ্ডিতসার শহীদ নজরুল ইসলাম বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণিতে পড়ত। প্রায় তিন বছর আগে অহনার মা নাজমা বেগম মারা যান। দুই ভাই ও দুই বোনের মধ্যে অহনা সবার ছোট ছিল। মা মারা যাওয়ার পর বড় ভাই-ভাবির কাছে থেকেই লেখাপড়া করত অহনা। বড় ভাই নুরুল আমিন ঢালী অটোরিকশাচালক। অহনার স্বপ্ন ছিল লেখাপড়া শিখে ভালো শিক্ষক হবে। বোনের স্বপ্ন পূরণ করতে দিন-রাত পরিশ্রম করে লেখাপড়ার খরচ জোগাড় করতেন ভাই।
অহনার পরিবার ও প্রতিবেশীরা জানায়, একই গ্রামের প্রতিবেশী মুদি দোকানি ৫০ বছর বয়সী মজিদ লাকরিয়া স্কুলে যাওয়ার-আসার পথে দীর্ঘদিন ধরে অহনাকে উত্ত্যক্ত করে আসছিল। বিভিন্ন সময় অর্থের লোভ দেখিয়ে কুপ্রস্তাব দিত। এসব কথা অহনা তার বড় ভাইকে জানালে মজিদকে কুৎসা রটাতে বারণ করেন। এ নিয়ে দুজনের মধ্যে বাকবিতণ্ডা হয়। এর পর থেকেই অহনাকে ঘিরে সমাজে কুৎসা রটাতে শুরু করেন মজিদ।
গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে বিদ্যালয়ে যাওয়ার পথে দোকানে উপস্থিত মানুষের সামনেই মজিদ অহনাকে অপবাদ দিয়ে বলেন, ‘এ মুখ নিয়ে বেঁচে আছিস কেন, মরতে পারিস না।’
এই অপবাদ সইতে না পেরে বিদ্যালয় থেকে ফিরে এসে বৃহস্পতিবার দুপুরেই কীটনাশক পান করে অহনা। পরিবারের সদস্যরা তাকে নড়িয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যায়। অবস্থার অবনতি হলে শরীয়তপুর সদর হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক অহনাকে মৃত ঘোষণা করেন।
শরীয়তপুর সদর হাসপাতাল মর্গে ময়নাতদন্ত শেষে আজ শুক্রবার সকালে অহনার লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করে পুলিশ। আজ শুক্রবার জুমার নামাজ শেষে অহনার লাশ পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। এ ঘটনায় অহনার বড় ভাই নুরুল আমিন ঢালী বাদী হয়ে আত্মহত্যায় প্ররোচনার অভিযোগে মজিদ লাকরিয়াকে আসামি করে নড়িয়া থানায় একটি মামলা করেন।
আজ শুক্রবার সকালে নিহত অহনার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, স্বজনরা কান্নাকাটি করছেন। পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাতে গ্রামের লোকজন এসে ভিড় করেছে বাড়িতে। লাশ দাফনের জন্য কবর খোঁড়া হচ্ছে। অহনার বড় ভাই নুরুল আমিন ঢালী মাটিতে গড়িয়ে বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন।
প্রতিবেশীরা তাঁকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। কান্নাজড়িত কণ্ঠে নুরুল আমিন ঢালী বলেন, ‘আমার মা মারা যাওয়ার সময় ওকে (অহনা) আমার হাতে তুলে দিয়ে গিয়েছিল। আমি অনেক কষ্ট করে আমার বোনের লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছিলাম। বোনটির স্বপ্ন ছিল পড়ালেখা শিখে একদিন ভালো শিক্ষক হবে। এ আমার কী হয়ে গেল। আমার শিশু বোনটি কী অপরাধ করেছিল। কেন আমার বোনকে মিথ্যা অপবাদ দেওয়া হলো।’
প্রতিবেশী বাহার আলী দেওয়ানের স্ত্রী পিয়ারা বেগম (৪৫) বলেন, ‘মা-মরা মেয়েটি চাঁদমুখ নিয়ে এ বাড়ি থেকে ও বাড়ি হেসেখেলে বেড়াত। বৃহস্পতিবার সকালে অহনা বিদ্যালয়ে যাওয়ার পথে দোকানে উপস্থিত মানুষের সামনেই মজিদ মেয়েটিকে অপবাদ দিয়ে বলেন, ‘এ মুখ নিয়ে বেঁচে আছিস কেন, মরতে পারিস না। মজিদ লাকরিয়ার দেওয়া অপবাদ সইতে না পেরে মেয়েটি আজ দুনিয়া ছেড়ে চলে গেল। এমন আর কত মেয়েকে দুনিয়া ছেড়ে যেতে হবে। আমরা এর পরিত্রাণ চাই।’
আরেক প্রতিবেশী মুকুল হাওলাদার বলেন, ‘মজিদ লাকরিয়া এলাকায় দোকান দেওয়ার পর থেকেই রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করার সময় মেয়েদের নিয়ে নানা রকম মন্তব্য করত। বয়স্ক লোক হওয়ায় তাঁকে কিছু বলতে পারতাম না। আমরা এর বিচার চাই।’
এ ব্যাপারে কথা বলতে মজিদ লাকরিয়ার বাড়িতে গিয়ে কাউকে পাওয়া যায়নি। স্থানীয় লোকজন জানায়, মেয়েটির মৃত্যুর খবর শোনার পর থেকেই পরিবারের সবাই বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেছে।
নড়িয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইকরাম আলী মিয়া বলেন, লাশের ময়নাতদন্ত শেষ করে পরিবারের সদস্যদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। আত্মহত্যার প্ররোচনার অভিযোগে মজিদ লাকরিয়াকে আসামি করে নিহতের ভাই একটি মামলা করেছেন। মজিদ লাকরিয়াকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।