‘পাচারপুরী’ শাহপরীর দ্বীপ এখন নির্জনপুরী

নারকেল গাছঘেরা দৃষ্টিনন্দন চিকচিকে বালুর সৈকত আর চারদিকে বঙ্গোপসাগরের উন্মুক্ত জলরাশি। কেউ হয়তো বিশ্বাসই করবে না, বাংলাদেশ থেকে পরিচালিত কোটি কোটি টাকার মানব পাচার ব্যবসার মূল কেন্দ্রই হচ্ছে অপূর্ব সুন্দর এই শাহপরীর দ্বীপ। গত কয়েক সপ্তাহে বেশ কয়েকবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দ্বীপটিতে অভিযান চালানোর পর এই ‘পাচারপুরী’ এখন প্রায় মানবশূন্য।
আলোচিত দ্বীপটি নিয়ে আজ রোববার একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বার্তাসংস্থা এএফপি। এতে বলা হয়, দেশের সর্বদক্ষিণে উপজেলা টেকনাফের দ্বীপ শাহপরী। বছর চারেক আগেও ৪০ হাজার মানুষ বসবাস করত দ্বীপটিতে। কিন্তু বঙ্গোপসাগর আস্তে আস্তে গ্রাস করে ফেলছে দ্বীপটিকে। টেকনাফের সাথে এক সময় দ্বীপটির দূরত্ব ছিল খুবই কম। প্রাকৃতিক সম্পদ আর সৌন্দর্যে এই জনপদের জুড়ি ছিল না। পর্যটকরাও আসতেন দ্বীপটিতে। কিন্তু বঙ্গোপসাগরের করাল গ্রাসের কবলে গত ৩ বছরে ৩-৪ কিলোমিটার পর্যন্ত জায়গা সাগর গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। ঘরবাড়ি হারিয়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছে তিন শতাধিক পরিবার।
দ্বীপে অবস্থান করা পুলিশ কর্মকর্তা কবির হোসেন জানান, মানবপাচারে সম্পৃক্ত হওয়ার আগে বিপৎসংকুল এই দ্বীপের অধিবাসীদের সবাই ছিল মাঝি অথবা জেলে। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে তাঁরা বুঝে গেল, মানবপাচারের ব্যবসা কতটা লাভজনক। এরপর সহজে ধনী হওয়ার আশায় তাদের অনেকেই মানব পাচারকারীদের দালালি শুরু করলেন।
কবির হোসেন আরো জানান, বর্তমানে দ্বীপে বসবাসকারীদের ৬০ শতাংশই কোনো না কোনোভাবে পাচারে জড়িত।
এএফপির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের মানব পাচারের যত সব রুট ব্যবহার করা তার মধ্যে শাহপরীর দ্বীপ নানা কারণে বহুল আলোচিত একটি স্পট । বাংলাদেশের নৌবাহিনীর দৃষ্টি এড়িয়ে নাফ চ্যানেল দিয়ে পাচারকারীদের নৌকাগুলোকে এখান থেকেই বঙ্গোপসাগরে পাঠানো হয়।
এএফপির প্রতিবেদক সরেজমিন ঘুরে দেখতে পান, দ্বীপের সৈকতে এখনো সারি সারি কাঠের মাছধরার নৌকা পড়ে আছে। দেখে মনে হচ্ছে, হয়তো কোনো কাজে একটু এদিক-ওদিক গেছে মাঝি ও জেলেরা। কিছুক্ষণ পরই দেখা মিলবে। কিন্তু অনেকক্ষণ অপেক্ষার পর ভুল ভাঙে। আসলে কোথাও কেউ নেই।
গত এক মাসে পুলিশের গুলিতে দ্বীপের তিনজন চিহ্নিত মানব পাচারকারী মারা যান। এ ছাড়া দ্বীপটি থেকে ৯০ জনকে মানব পাচারের অভিযোগে ধরে নিয়ে গেছে পুলিশ। যাঁরা এখন পুলিশি রিমান্ডে আছেন।
গত মাসে মানবপাচারকারীদের সাথে পুলিশের বন্দুকযুদ্ধে দ্বীপের শীর্ষ মানব পাচারকারী ধলু হোসেন নিহত হন। এরপর থেকে ইয়াবা ও মানবপাচারকারীদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। জানা গেছে, ধলু প্রায়ই গর্ব করে বলতেন তিনি একাই এক হাজারের বেশি মানুষ পাচার করেছেন। ধলু নিহতের পর পরই মানবপাচারে জড়িত অনেকে আত্মগোপনে চলে যান।
এরপর গত সপ্তাহে শাহপরীর দ্বীপে র্যাবের একটি নিরাপত্তা চৌকি স্থাপন করা হলে দ্বীপটি কার্যত ভূতুড়ে জনপদে পরিণত হয়।
এ ছাড়া ইয়াবা ব্যবসায়ীর তালিকায়ও এলাকার বেশ কিছু ব্যক্তির নাম ওঠে এসেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকায়। যার কারণে প্রশাসনের তৎপরতা শুরুর সাথে সাথে মানব পাচারকারী ও ইয়াবা ব্যবসায়ীরা গ্রেপ্তার এড়াতে গা-ঢাকা দেন।
পুলিশের সূত্রে রয়টার্স জানায়, এসব তালিকাভুক্ত ব্যবসায়ী ও মানবপাচারকারীর অনেকে সীমান্ত পার হয়ে মিয়ানমারে পাড়ি দিয়েছেন। বাকিরা কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম শহরে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। তা ছাড়া অনেকে সাগরে জেলে সেজে আছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
পুলিশের গোয়েন্দা কর্মকর্তা মুজিবুর রহমান জানান, মানব পাচারকারী এক নারীকে কয়েক মাস ধরে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছিল। গত ছয় মাসে তাঁর একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টেই ৩১ লাখ টাকার বেশি লেনদেন করা হয়েছে। র্যাবের অভিযানের পর ওই নারীও গা ঢাকা দিয়েছেন।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, প্রায় জনশূণ্য এই দ্বীপের বেশির ভাগ বাড়ি ইট এবং কংক্রিটের তৈরি। অনেক বাড়ির ভেতরে ঢুকে দেখা গেছে, সম্প্রতি দামি রঙ লাগানো হয়েছে। যে অল্প কয়েকজন লোক রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে তাঁদেরই একজন হোসেন এএফপিকে জানান, বাংলাদেশের পুলিশের কড়া পদক্ষেপের কারণে দ্বীপের বেশির ভাগ লোক মিয়ানমার অথবা টেকনাফে পালিয়ে গেছে।
কক্সবাজারে থাকা জাতিসংঘের একজন কর্মী জানান, ২০০১ সালের দিকে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশকে পয়েন্ট হিসেবে ব্যবহার করে সাগর পাড়ি দিয়ে থাইল্যান্ড ও মালেয়শিয়ায় পৌঁছানোর চেষ্টা করে। এরপর উন্নত জীবনের সন্ধানে বাংলাদেশিরাও এই বিপৎসংকুল পথে যাত্রা করতে থাকে।
জাতিসংঘের ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘এটা সবচাইতে লাভজনক অপরাধ। যার শিকার হয় নিরীহ মানুষ।’ তিনি আরো জানান, ২০১২ সালে প্রথম মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমানোর চেষ্টার অভিযোগে বঙ্গোপসাগরে ১৩২ জন লোককে আটক করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, ২০১৪ সালে এই সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় ১৫৫০ জনে।
মানবাধিকারকর্মীরা ধারণা করছেন, এই মুহূর্তে দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গোপসাগরে প্রায় আট হাজার অভিবাসী ভাসছে। যার বেশির ভাগই রোহিঙ্গা। তাঁদের অনেকেই মিয়ানমার সীমান্ত অথবা বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা থেকে মালেয়শিয়ার মতো ধনী রাষ্ট্রগুলোর উদ্দেশে পাড়ি জমায়। আর কক্সবাজার থেকে হাজারো বাংলাদেশি একই উদ্দেশে শাহপরী দ্বীপের মতো পাচারকারীর আস্তানা থেকে সাগরে পাড়ি জমায়। এদের সহযোগিতা করা অথবা যোগাযোগ করিয়ে দেওয়ার কাজটি করত এই দ্বীপের মানব পাচারকারীদের দালালরা। আর এই কাজে তাদের উপার্জন হয় মাছ শিকার অথবা নৌকার মাঝিগিরিতে করা উপার্জনের কয়েকগুণ।
এভাবেই বাংলাদেশের ভূসীমানার শেষপ্রান্তের একটি দ্বীপের অধিবাসীরা হঠাৎ করে সম্পদশালী হয়ে যায়। আর আজ এই দ্বীপের ‘ধনী মানব পাচারকারীরাই’ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভয়ে বাড়ি ফিরতে পারছেন না।