শেষ হলো কঠিন চীবর দানোৎসব
রাঙামাটি রাজবন বিহারে দুই দিনব্যাপী ৪৩তম দানোত্তম কঠিন চীবর দানোৎসব সম্পন্ন হয়েছে। বৃহস্পতিবার বেইনঘর উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় এই উৎসব। এটি পার্বত্যাঞ্চলে বৌদ্ধদের বৃহত্তম কঠিন চীবর দানোৎসব।
শুক্রবার দুপুরে গৌতম বুদ্ধ ও বনভান্তের প্রতিকৃতিতে চীবর দান ও দেশনার মাধ্যমে শেষ হয় এবারের দানোৎসবের আনুষ্ঠানিকতা। সন্ধ্যায় আকাশ প্রদীপ প্রজ্বালন করা হয়। এ দানোৎসবে লক্ষাধিক লোকের সমাগম হয় প্রতি বছরই।
এর আগে দানোৎসব উপলক্ষে বৃহস্পতিবার বেইন কর্মীদের পঞ্চশীল গ্রহণের মধ্য দিয়ে বেইনঘর উদ্বোধন করেন চাকমা রাজা ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায়। পরে চরকায় সুতা কেটে অনুষ্ঠানের সূচনা করেন। এ বছর রাজবন বিহারে ১৩০টি বেইনে অন্তত ৫২০ জন নারী কর্মী অংশগ্রহণ করে।
এ ছাড়া সুতা লাগানো, সিদ্ধ, রং, টিয়ানো, শুকানো, তুম করা, নলী করা, বেইন টানার কাজে আরো শতাধিক পুরুষ কর্মী অংশগ্রহণ করে।
শুক্রবার সকাল ৬টা থেকে শুরু করে দুপুর ১২টা পর্যন্ত চীবর সেলাই শেষে চীবর দান করা হয়। এ সময় ‘সাধু’ ‘সাধু’ ধ্বনিতে মুখরিত হয় পুরো রাজবন বিহার।
বৃহস্পতিবার রাতব্যাপী কঠিন চীবর প্রস্তুত করে শুক্রবার বেলা আড়াইটায় রাঙামাটি রাজবন বিহারের আবাসিক প্রধান প্রজ্ঞালঙ্কার মহাস্থবিরের হাতে কঠিন চীবরটি তুলে দিয়ে ভিক্ষুসংঘকে দান করেন চাকমা রাজা ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায়।
শুক্রবার সকাল ৬টায় বুদ্ধ পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে দিনের কার্যক্রম শুরু হয়। সকাল ১০টায় অনুষ্ঠিত হয় দেব-মানবের তথা সব প্রাণীর হিতার্থে ধর্মদেশনা। ধর্মদেশনায় উপস্থিত ছিলেন রাজবন বিহারের আবাসিক প্রধান শ্রীমৎ প্রজ্ঞালঙ্কার মহাস্থবির।
এ সময় উপস্থিত ছিলেন পার্বত্য সচিব নব বিক্রম কিশোর ত্রিপুরা, চাকমা সার্কেল চিফ ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায়, উপাসক-উপাসিকা পরিষদের সহসভাপতি গৌতম দেওয়ানসহ অন্য পুণ্যার্থীরা।
চরকায় সুতা কাটার পর রাজা দেবাশীষ রায় বলেন, ‘বিশাখা প্রবর্তিত এই চীবর অনুষ্ঠান বর্তমানে সার্বজনীন রূপ গ্রহণ করেছে। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তুলা থেকে সুতা তৈরি করে এরপর চীবর তৈরি করা হয়। এতে নারী-পুরুষ সবাই অংশগ্রহণ করে।’
চীবর তৈরির পর শুক্রবার দুপুর ১টায় শোভাযাত্রা সহকারে কঠিন চীবর ও কল্পতরু মঞ্চে আনা হয়। পঞ্চশীল গ্রহণের পর দুপুর আড়াইটায় বনভান্তের মানব প্রতিকৃতির উদ্দেশ্যে কঠিন চীবর উৎসর্গ করা হয়। এ সময় বনভান্তের প্রতিনিধি হিসেবে এ চীবর গ্রহণ করেন আবাসিক প্রতিনিধি শ্রীমৎ প্রজ্ঞালঙ্কার মহাস্থবির।
চীবর দানে শ্রীমৎ প্রজ্ঞালষ্কার মহাস্থবির বলেন, বৌদ্ধ ধর্ম সবার শান্তি কামনা করে। এইবার বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বের শান্তির জন্য প্রার্থনা করা হয়েছে বলেও তিনি জানান।
তিন পার্বত্য জেলার মধ্যে সবচেয়ে আড়ম্বরপূর্ণভাবে রাঙামাটি রাজবন বিহারে প্রতি বছর এ দানোৎসবের আয়োজন করা হয়।
এদিকে উৎসব উপলক্ষে রাজবন বিহার এলাকায় বিশাল মেলা বসেছে। মেলা প্রাঙ্গণে সহস্রাধিক স্টলে সারা দেশ থেকে কুটির ও হস্তশিল্পের পণ্যের পসরা নিয়ে লোকজন এ মেলায় অংশ নিয়েছে। এ ছাড়া নাগরদোলাসহ বিভিন্ন খেলা, জাদু প্রদর্শনী, ধর্মীয় পালাকীর্তনের ব্যবস্থাও করা হয়েছে।
গৌতম বুদ্ধের জীবদ্দশায় মহাউপাসিকা বিশাখা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তুলা থেকে সুতা এবং সুতা রং করে কাপড় বুনে তা সেলাই করে চীবর (ভিক্ষুদের পরিধেয় বস্ত্র) দান করে এই কঠিন চীবরদানের সূচনা করেন আড়াই হাজার বছর আগে। এই পদ্ধতিতে দান করলে কায়িক, বাচনিক মানসিকভাবে অধিক পরিশ্রম হয় এবং অধিকতর পুণ্যলাভ হয় বলে বৌদ্ধ শাস্ত্রে উল্লেখ আছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে সর্বোচ্চ বৌদ্ধ ধর্মীয় গুরু সাধনানন্দ মহাস্থবির (বনভান্তে) ১৯৭৪ সালে রাঙামাটি জেলার লংগদু উপজেলার তিনটিলা বন বিহারের দায়ক-দায়িকাদের দিয়ে এই কঠিন চীবর দানোৎসবের পুনঃ প্রবর্তন করান।
রাঙামাটি রাজবন বিহারে সর্বপ্রথম কঠিন চীবর দান অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭৭ সালে। সেই থেকে প্রত্যেক বছর রাঙামাটি রাজবন বিহারসহ পার্বত্য তিন জেলার রাজবন বিহারের শাখাসমূহে বিশাখা প্রবর্তিত নিয়মে কঠিন চীবর দানোৎসব সম্পাদন করা হয়ে থাকে।