তুলে নিয়ে গণধর্ষণ, হু কেয়ারস!
বেড়েই চলেছে ধর্ষণ, নারী নির্যাতন আর হেনস্তার ঘটনা। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এ ঘটনাগুলোর কোনো সুরাহা হয় না। অপরাধের পাল্লা ভারী হতে থাকে, সংখ্যা বেড়ে যায় অপরাধীর। আর নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে নারীরা।
গত পহেলা বৈশাখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকাসহ একই দিনে দেশের তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটেছে নারী হেনস্তার ঘটনা। এ ঘটনার এক মাসেরও বেশি সময় পার হয়ে গেলেও এখনো অপরাধীদের খুঁজে বের করতে পারেনি পুলিশ প্রশাসন। এরই মধ্যে রাজধানীতে ঘটল মাইক্রোবাসে আদিবাসী নারী গণধর্ষণের ঘটনা।
এ ঘটনায় নিন্দা আর প্রতিবাদে মুখর হয়ে উঠেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম।
জয়দ্বীপ সরকার নামের এক প্রবাসী বাংলাদেশি তাঁর ফেসবুক পেজে লিখেছেন, “দিল্লি আর ঢাকার মধ্যে আর কোনো পার্থক্য নাই। শুধু একটাই পার্থক্য তা হলো, দিল্লির মানুষ এই ঘটনার পর রাস্তায় নেমে এসেছিল বিচারের দাবিতে, আর আমরা ‘হু কেয়ারস’ বলে বিনোদন পাতায় গিয়ে ঘোরাঘুরি করব।”
আবৃত্তি শিল্পী রবি শঙ্কর মৈত্রী তাঁর ফেসবুক পেইজে লিখেছেন ,‘ঢাকায় মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে ধর্ষণ। এই ঘটনা আমাদের কতটুকু নাড়া দেবে? মেয়েটির পক্ষে কতজন রাস্তায় দাঁড়াবে? মনে হয়, তেমন কিছু হবে না। যে ধর্ষিতা, তার পরিচয় এখানে বড় হয়ে দেখা দেবে। সে যদি ছাত্রী হতো, কোনো দলের কর্মী হতো। তবে জোরালো একটা প্রতিবাদ হতো।’
‘পিতা ও পুত্র মিলে পালাক্রমে গৃহকর্মীকে ভোগ করা যায় যে শহরে, পেটের দায়ে সে মেয়েটি যদি ভয়ে চুপ হয়ে থাকে, বৈষম্যবিষ যেখানে তীব্র, সেখানে সব অপরাধই লঘু হয়ে যায় সামাজিক অনাচারে ব্যাভিচারে।’ লিখেছেন রবি।
সাখাওয়াত আমিন নামের এক গণমাধ্যমকর্মী লিখেছেন, “কয়েক দিনের জন্য প্রতিবাদী স্ট্যাটাসে টাইমলাইন ভরে ফেলব। গারো মেয়েটিকে নিজের বোন দাবি করে দরদ উথলে উঠবে আমাদের। কেউ কেউ ‘দুষ্ট’দের গ্রেপ্তার ও বিচার দাবিতে হয়তো প্ল্যাকার্ড হাতে রাস্তায়ও দাঁড়াবো। কিন্তু এরপর....???
এরপর আমাদের বোন বা গার্লফ্রেন্ড যখন রাস্তায় বের হবে ‘দুষ্ট’রা আবারও পিছু নেবে। সুযোগ পেলে ‘দুষ্টামি’ও করবে। সাথে থাকলেও কিচ্ছুটি করতে পারব না। আমরা তো আর বাংলা সিনেমার হিরো নই যে, একাই দশ/বারোজনকে মেরে একেবারে মাটিতে লুটিয়ে দেব!
পুলিশের সাহায্য চাইলে বলবে, ছাড়ুন তো ছেলেপুলে কি একটু দুষ্টুমিও করতে পারবে না!
সুতরাং... লাভ নেই। চলবে এভাবেই যেভাবে চলছে। এই দুষ্টদের মধ্যে হয়তো রয়েছে আমাদের মধ্যেই কেউ কেউ। কারণ এ দেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে পঁচন ধরেছে। কেউ কারো জায়গায় ঠিক নেই।
হুমায়ুন আজাদ স্যার বেঁচে থাকলে এখন নিশ্চয়ই লিখতেন, সবকিছু নষ্টদের অধিকারে গেছে।”
তানভীর বিন হাসান নামের এক ব্যাংক কর্মকর্তা ক্ষোভ নিয়ে লিখেছেন, ‘বাংলাদেশে এসব ঘটলে উত্তেজিত হওয়ার কিছু নাই। নারী গারো, মারমা, চাকমা, বাঙালি নাকি ইউরোপিয়ান তাতে কিছু আসে যায় না, সে শিশু, কিশোরী, তরুণী, যুবতী, বৃদ্ধা একটা কিছু হলেই হলো। যে দেশে রাত ৯টায় সবকিছুই অনিরাপদ, সেখানে এই মেয়ের কাজ করতে যাওয়া উচিত হয়নি। মেয়েদের কাজে যাওয়া বন্ধ করে দেওয়া উচিত। মেয়েরা থাকবে হেঁশেলে। সেখানে তারা নিরাপদ।’ অভিমান করে তিনি আরো লিখেছেন, ‘সকল দোষ এই ধর্ষিতার। অনাগত সময়ের সব ধর্ষিতার। বিনা বাক্য ব্যয়ে এই মামলা খারিজ করে দেওয়া হোক। নির্দোষ ধর্ষকদের পেছনে রাষ্ট্রের মূল্যবান সময় নষ্ট করা না হোক।’
গণমাধ্যমকর্মী জ ই মামুন তাঁর ফেসবুক পেইজে ‘আয়নায় ধর্ষকের মুখ!’ শিরোনামে দেওয়া পোস্টে লেখেন, ‘চলন্ত মাইক্রোবাসের ভেতরে একটা মেয়েকে পাঁচটা হায়েনা মিলে ছিড়ে খুঁড়ে ফেলল, আর আমরা সবাই চুপ করে বসে আছি! আমাদের কোথাও কোনো বিকার নেই, প্রতিবাদ নেই, প্রতিরোধ নেই, বিদ্রোহ বিপ্লব নেই। অথচ এই আমরাই কত ফালতু বিষয় নিয়ে আসমান-জমিন একাকার করে ফেলি! মনে পড়ে, ভারতে যখন যাত্রীবাহী বাসে এক মেডিকেল ছাত্রী গণধর্ষণের শিকার হয়েছিল, তখন আমাদের সে কি প্রতিবাদ, নিন্দার ঝড়, ফেসবুক উত্তাল! আর এখন আয়নায় নিজের মুখ, তাই সবাই মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছি!
আমাদের কোনো কিছুতেই আর কেন কোনো প্রতিক্রিয়া হয় না- কেউ বলতে পারেন? আমাদের ধমনীতে কি আর মানব রক্ত প্রবাহিত হয় না? কেবলই গোলামি, চাটুকারিতা, পরনিন্দা এবং পরশ্রীকাতরতায় ঠাসা আমাদের হৃদপিণ্ড?
মানুষ হিসেবে, তার চেয়েও বেশি পুরুষ হিসেবে- নিজেকে বড় বেশি অপরাধী মনে হয়! ’
বার বার এ ধরনের ঘটনায় আতঙ্কে আছে নারীরা। প্রতিনিয়ত যাদের নানা কারণে বাইরে বের হতে হয় তারা বিশ্বাস করতে পারছে না তাদের পাশের লোকটিকেও।
জেসমিন পাপড়ি নামের এক গণমাধ্যমকর্মী নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেছেন, ‘বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৯টা! যমুনা ফউচার পার্কের উল্টো পাশে আধা ঘণ্টার চেষ্টায়ও বাসে উঠতে না পেরে আতিককে জানালাম। কারওয়ান বাজারের নিজের অফিস থেকে বেরিয়ে সে তখন তেজগাঁওয়ে মাত্র। বলল, তুমি বিশ্বরোডের দিকে এগুতে থাক। বাস পেলে চলে যেও, না পেলে বিশ্বরোডের রেল লাইন পার হয়ে মেইন রোডের পাশে অপেক্ষা করো। তোমাকে তুলে নেব। এটা নিয়মিত ঘটনা।
তেজগাঁও থেকে বিশ্বরোড আসার সময় অনুমান করে হেঁটেই এগুতে থাকলাম। কিন্তু বেশ অসস্তিকর রাস্তা, হাঁটতে গিয়ে অনেকের ইচ্ছাকৃত ধাক্কা খেলাম। কিছুদূর আসার পর খেয়াল করলাম একটি মোটর সাইকেল আমার পাশে পাশে আসার চেষ্টা করছে। আমি হাঁটার গতি কমিয়ে পিছিয়ে পড়লে সে থেমে ফোনে কারো সঙ্গে কথা বলার ভান করছে। আমি এগুলে সেও এগুচ্ছে। নিজেও এক বন্ধুর সঙ্গে ফোনে কথা বলে ঘটনাটিকে পাত্তা না দেওয়ার চেষ্টা করছিলাম। এভাবেই আসলাম বিশ্বরোড পর্যন্ত। বেশ ভিড়। রাস্তার পাশে দোকান। কিন্তু সে পথেও হাঁটতে দারুণ অস্বস্তি লাগছিল। যেন আমি সার্কাস দেখাতে দেখাতে হাঁটছি। পুরো রাস্তা তাকিয়ে আছে। তবে আমি ভিড়ের মাঝে হারিয়ে গেলাম। দূর থেকে দেখলাম, যেখানে সবাই বাসে ওঠে, সেখানে মোটরসাইকেল থামিয়ে লোকটা আমায় খুঁজছে। এক নিঃশ্বাসে তার পেছন দিক দিয়ে রেললাইন পার হয়ে এক পুলিশকে বললাম, রাস্তা পার করে দিতে। পুলিশ বলল, আপনি রাস্তা পার হন, কিছু হবে না, স্পিড ব্রেকার আছে।
রাস্তা পেরিয়ে আরেক বিপদ। ফ্লাইওভারের নিচে হওয়ায় জায়গাটা বেশ অন্ধকার। বুকটা শুকিয়ে উঠছিল। রাত তখন ১০টা পেরিয়ে গেছে। উদ্ধারকারী হিসেবে মিরপুর থেকে আসা অভিজাত বাসটি সামনে থামল। সেদিনকার মতো বাঁচলাম। আতিককে ফোন করা হয়নি। ও-ই পরে ফোন করে জানল, অপেক্ষা না করে গাড়ি পেয়ে চলে এসেছি। পুরো কাহিনীটা ওকে বলা হয়নি।
সেদিন আমি বেঁচে গিয়েছিলাম। বাঁচেনি আমার গারো বোনটা। ঘটনাটি শোনার পর থেকে ডুকরে কান্না পাচ্ছে। আমি আর ওই রাস্তায় হাঁটব না- এমন পরামর্শ পাব এবার?’
সৃজন আহমেদ নামের এক চিকিৎসক মাইক্রোবাসে ধর্ষণের ঘটনার খবরটি শেয়ার দিয়ে একে ‘ভয়ঙ্কর’ বলে উল্লেখ করেছেন।
কুং থাং নামের এক ব্যক্তি লিখেছেন, “তুরাগ থানা কাছে হয় বলে মামলা করার জন্য রাত ৪টার দিকে মেয়েটিকে নিয়ে তাঁরা সেখানে যান। কিন্তু অন্য এলাকার ঘটনা বলে পুলিশ তাঁদের ফিরিয়ে দেয়।
এরপর ভোর ৫টার দিকে তাঁরা যান গুলশান থানায়। সেখানেও একই উত্তর মেলে।
শেষে সাড়ে ৬টার দিকে ভাটারা থানায় গেলে বলা হয়, ওসি নেই, অপেক্ষা করতে হবে।
এরপর সকাল সাড়ে ৯টার দিকে ওসি আসেন এবং তাঁদের কথা শুনে সাড়ে ১২টার দিকে মামলা নথিভুক্ত করা হয় বলে মেয়েটির বড় বোন জানান ৷
ভয়াবহ অবস্থা। ধর্ষণের অভিযোগ জানাতেই যদি এমনভাবে হয়রানির শিকার হতে হয়, বিচারের অবস্থা কী হবে। মামলা নথিভুক্ত করার হয়রানি এড়াতে কতজন নারী ধর্ষণের ঘটনা চেপে যায় ধারণা করতে পারি?”
গতকাল রাত সাড়ে ৯টার দিকে যমুনা ফিউচার পার্কে কাজ শেষে এক আদিবাসী নারী কুড়িল বাসস্ট্যান্ডে গাড়িতে ওঠার জন্য দাঁড়িয়ে ছিলেন। এ সময় একটি মাইক্রোবাস এসে তাঁকে জোর করে তুলে নেয়। গাড়ির মধ্যে পাঁচজন ধর্ষণের পর তাঁকে উত্তরার জসীমউদদীন এলাকায় ফেলে রেখে যায়।