আলোর দিকে ধাবিত হওয়ার প্রত্যয়ে হলো এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রা
বাংলা ১৪৩১ সনকে স্বাগত জানিয়ে ঢাক-ঢোলের বাদ্যের তালে, নাচ-গান ও হৈ-হুল্লোড়ে মেতে মঙ্গল শোভাযাত্রা করেছেন নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ। শোভাযাত্রায় মানুষের হাতে হাতে স্থান পেয়েছে নীল গাই, ময়ূর, বাঘ, হাতি, ভেড়া, মা-শিশু, মাছ ও পেঁচার শৈল্পিক কাঠামো ও রাজা-রানির মুখোশ। এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রতিপাদ্য ‘আমরা তো তিমিরবিনাশী’। শোভাযাত্রায় কুসংস্কারের অন্ধকার দূরীভূত করে সবাইকে নিয়ে আলোর দিকে যাত্রার প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়।
আজ রোববার (১৪ এপ্রিল) সকাল সোয়া ৯টায় শোভাযাত্রাটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের সামনে থেকে শুরু হয়। পরে এটি শাহবাগ, ঢাকা ক্লাব ও শিশু পার্কের সামনে থেকে ইউটার্ন নিয়ে টিএসসিতে এসে শেষ হয়। মঙ্গল শোভাযাত্রার নিরাপত্তায় নিয়োজিত ছিল সোয়াত, র্যাব ও পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিপুল সদস্য।
শোভাযাত্রাকে সফল করতে আগেই সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করেন আয়োজকরা। সকাল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে মঙ্গল শোভাযাত্রা শুরুর জন্য অপেক্ষা করেন বিভিন্ন বয়স ও শ্রেণি-পেশার মানুষ। পুরোনো গ্লানি, হতাশা আর মলিনতাকে পেছনে ফেলে নতুন উদ্যমে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যাশায় নতুন বছরকে বরণ করেন তারা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে মঙ্গল শোভাযাত্রা বের হওয়ার আগে থেকেই তরুণ-তরুণীদের সরব উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। সকাল থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, টিএসসি, বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্মৃতি চিরন্তন চত্বর, দোয়েল চত্বরে তাদের উপস্থিতি দেখা গেছে। এ ছাড়া শোভাযাত্রায় অংশ নিতে প্রতি বছরের ন্যায় এবারও বিভিন্ন দেশের নাগরিকরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে জড়ো হন।
আজ মঙ্গল শোভাযাত্রার উদ্বোধন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এ এস এম মাকসুদ কামাল। এবারের শোভাযাত্রার আয়োজন নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেন উপাচার্য। এবার কুসংস্কার, হিংসা, হানাহানি ও যুদ্ধ বন্ধ এবং শান্তির প্রত্যাশায় মঙ্গল শোভাযাত্রা করা হয়েছে। এবারের শোভাযাত্রায় অংশ নেন সমাজকল্যাণ মন্ত্রী দীপু মনি, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম ও ডিএমপি কমিশনার।
বাঙালির বর্ষবরণের অন্যতম অনুষঙ্গ মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন সম্পূর্ণ নিজ অর্থায়নে করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুদান ও চারুকলা বিভাগের শিক্ষার্থীদের তহবিল সংগ্রহের ওপর নির্ভর করে আয়োজন করা হয় এ শোভাযাত্রা। মঙ্গল শোভাযাত্রার ৩৫ বছর পূর্তি হলো এ বছর।
১৯৮৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে বের হয় প্রথম মঙ্গল শোভাযাত্রা। ২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর ইউনেস্কো এ শোভাযাত্রাকে বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মর্যাদা দেয়। বাংলা নববর্ষের তাৎপর্য এবং মঙ্গল শোভাযাত্রার ইতিহাস ও ইউনেস্কো কর্তৃক এটিকে বিশ্ব সংস্কৃতির ঐতিহ্য হিসেবে অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি তুলে ধরে আজ সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় ও বাংলা একাডেমির উদ্যোগে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হচ্ছে।
এর আগে এদিন সকাল সোয়া ৬টায় রাজধানীর রমনা বটমূলে ছায়ানটের শিল্পীদের আয়োজনে বর্ষবরণের অন্যতম অনুষ্ঠান শুরু হয়। গানের সুর ও কবিতা আবৃত্তির মধ্য দিয়ে স্বাগত জানানো হয় নতুন বছরকে।
বর্ষবরণের এই অনুষ্ঠান জাতীয় সংগীত ও এসো হে বৈশাখ গান পরিবেশনের মাধ্যমে শুরু হয়। ভোর থেকেই এ অনুষ্ঠানে অংশ নিতে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে ছুটে আসেন সব শ্রেণি-পেশার মানুষ। সুন্দর ও শান্তিপূর্ণ বছরের প্রত্যাশা নিয়ে বাংলা নববর্ষ ১৪৩১কে স্বাগত জানান তারা।
মূলত ১৫৫৬ সালে কার্যকর হওয়া বাংলা সন প্রথমদিকে পরিচিত ছিল ফসলি সন নামে। পরে তা পরিচিত হয় বঙ্গাব্দ নামে। কৃষিভিত্তিক গ্রামীণ সমাজের সঙ্গে বাংলাবর্ষের ইতিহাস জড়িয়ে থাকলেও এর সঙ্গে রাজনৈতিক ইতিহাসেরও সংযোগ ঘটেছে। পাকিস্তান শাসনামলে বাঙালি জাতীয়তাবাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হয় বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের। আর ষাটের দশকের শেষে তা বিশেষ মাত্রা পায় রমনা বটমূলে ছায়ানটের আয়োজনের মাধ্যমে। এ সময় ঢাকায় নাগরিক পর্যায়ে ছায়ানটের উদ্যোগে সীমিত আকারে বর্ষবরণ শুরু হয়। আমাদের মহান স্বাধীনতার পর ধীরে ধীরে এই উৎসব নাগরিক জীবনে প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে। পয়লা বৈশাখের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বাঙালির অসাম্প্রদায়িক এবং গণতান্ত্রিক চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটতে থাকে। কালক্রমে বর্ষবরণ অনুষ্ঠান এখন শুধু আনন্দ-উল্লাসের উৎসব নয়, এটি বাঙালি সংস্কৃতির একটি শক্তিশালী ধারক-বাহক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। শুধু তাই নয়, উৎসবের পাশাপাশি স্বৈরাচার-অপশক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদও এসেছে পয়লা বৈশাখের আয়োজনে।