নতুন বাংলাদেশে ভয়-শঙ্কাহীন বাংলা নববর্ষ

পহেলা বৈশাখ, ১৪৩২। বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন আজ। স্বৈরাচার ও ফ্যাসিবাদমুক্ত বাংলাদেশে ভয়-শঙ্কা কাটিয়ে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা ও উৎসবমুখর পরিবেশে পালিত হচ্ছে এবারের বর্ষবরণ। এ বছর পহেলা বৈশাখকে সর্বাধিক অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং অসাম্প্রদায়িক হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে। সামাজিক সম্প্রীতি তৈরি এবং জাতির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে শক্তিশালী করে তোলার উপলক্ষ এ বাংলা বর্ষবরণ।
বাংলা নববর্ষে প্রতিবারের মতো এবারও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ শোভাযাত্রা বের করবে। তবে এবারের আয়োজনে বাংলা নববর্ষের 'মঙ্গল শোভাযাত্রা'র নাম পরিবর্তন করা হয়েছে। শোভাযাত্রার নতুন নাম 'বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা'।
বর্ষবরণ উপলক্ষ্যে দেশবাসীকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বাণী দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। বাণীতে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, এবারের পহেলা বৈশাখকে অনন্য করে তুলেছে অসাম্প্রদায়িক ও সর্বজনীন চেতনা। ধর্মীয় উৎসবগুলো নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও, পহেলা বৈশাখ সবার জন্য মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান এবং আদিবাসী সম্প্রদায়সহ সব শ্রেণি-পেশার মানুষ এ উৎসবে সমানভাবে অংশগ্রহণ করে। এটি কোনো নির্দিষ্ট ধর্মের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়; বরং এটি একটি সম্মিলিত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতীক, যা অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ ও জাতীয় সংহতির অনন্য প্রতিচ্ছবি।
প্রধান উপদেষ্টা তার বার্তায় জাতিকে উষ্ণ শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন, শুভ নববর্ষ ১৪৩২। বাংলা নববর্ষের এ উপলক্ষে, আমি সকল দেশবাসীকে আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা জানাই। পহেলা বৈশাখের ঐতিহ্যবাহী উদযাপন বাঙালি সংস্কৃতিতে অনন্য। এটি বাঙালিদের ঐক্য এবং মহা পুনর্মিলনের দিন।
বংশগতভাবে, ধর্ম বা বর্ণ নির্বিশেষে সমগ্র বাঙালি জাতি নববর্ষকে নবচেতনা এবং নতুন অঙ্গীকারের সঙ্গে গ্রহণ করে আসছে এ কথা উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, এই দিনে মানুষ বিগত বছরের দুঃখ ও হতাশাকে দূরে সরিয়ে রেখে সম্প্রীতি, বন্ধুত্ব, আনন্দ এবং ভালোবাসার চেতনায় একত্রিত হয়।
প্রধান উপদেষ্টা উল্লেখ করেন যে, মোঘল সম্রাট আকবরের রাজত্বকালে বাংলা নববর্ষ উদযাপন শুরু হয়েছিল। কৃষিকাজ সহজতর করার জন্য তিনিই বাংলা বছরকে 'ফসলি বছর' হিসেবে গণনা শুরু করেছিলেন। এটি একটি ঐতিহ্য যা সময়ের সাথে সাথে সকল বাঙালির জন্য ধর্মনিরপেক্ষ ঐক্যের চেতনার প্রতীক হয়ে উঠেছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর সময় আসুন আমরা অতীতের দুঃখ, কষ্ট এবং দুর্ভাগ্যকে পেছনে ফেলে নতুন আশা ও উৎসাহ নিয়ে এগিয়ে যাই। তিনি উল্লেখ করেন যে, ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান সকল প্রকার বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তোলার পথ খুলে দিয়েছে। এটি আমাদেরকে অন্তর্ভুক্তিমূলক, সুখী, সমৃদ্ধ, শান্তিপূর্ণ এবং প্রাণবন্ত একটি বাংলাদেশ গড়ার জন্য কাজ করার অনুপ্রেরণা জোগায়।
প্রধান উপদেষ্টা আরও বলেন, এই নববর্ষ এমন একটি জাতি গঠনের জন্য আমাদের যৌথ অঙ্গীকারের মাধ্যমে চিহ্নিত হোক। তিনি নববর্ষ উপলক্ষে গৃহীত সকল উদ্যোগের সাফল্য কামনা করেন।
এদিকে, পহেলা বৈশাখের আনন্দ শোভাযাত্রায় নিরাপত্তা নিশ্চিতে প্রশাসন সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে রয়েছে বলে জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী। নিরাপত্তার স্বার্থে এ বছর যেখান-সেখান থেকে শোভাযাত্রায় অংশ নেওয়া যাবে না বলে নির্দেশনা দেন তিনি।
শেখ মো. সাজ্জাত আলী বলেন, নববর্ষের শোভাযাত্রাটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে শুরু হয়ে শাহবাগ মোড়, শহীদ মিনার, দোয়েল চত্বর, বাংলা একাডেমি ও টিএসসি হয়ে পুনরায় চারুকলায় গিয়ে শেষ হবে। শোভাযাত্রার পুরো রুট নিরাপত্তার চাদরে ঢাকা থাকবে। পাশ থেকে বিকল্প পথে শোভাযাত্রায় প্রবেশ করা যাবে না।
সাজ্জাত আলী জানান, শোভাযাত্রায় যোগদান করতে হলে শাহবাগ মোড় থেকে যোগ দিতে হবে। আর ছায়ানটের অনুষ্ঠান শেষে যারা শোভাযাত্রায় অংশ নিতে চান— তারা শাহবাগ হয়ে কাঁটাবন মোড় দিয়ে নীলক্ষেত মোড় হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির বাংলোর সামনে থেকে অংশ নেবেন।
ডিএমপি কমিশনার জানান, বৈশাখে যেকোনো ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়াতে ১৮ হাজার পুলিশ সদস্যসহ র্যা ব, সেনাবাহিনী ও এন্টি-টেরোরিজম ইউনিটের সদস্যরা দায়িত্বে থাকবেন।
বাংলা বর্ষবরণ উৎসবকে কেন্দ্র করে ঢাকা মহানগরকে ২১টি সেক্টরে ভাগ করে পর্যাপ্ত সংখ্যক পোশাকধারী ও সাদা পোশাকে পুলিশ সদস্য মোতায়ন করা হবে উল্লেখ করে ডিএমপি কমিশনার বলেন, গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাস্থলগুলো ডগ স্কোয়াড দিয়ে সুইপিং করা হবে। রমনা পার্ক ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানসহ মোট ২১টি স্থানে ব্যারিকেড থাকবে।
প্রতিটি অনুষ্ঠানস্থলের প্রবেশমুখে আর্চওয়ে ও হ্যান্ড মেটাল ডিটেক্টর দিয়ে তল্লাশি করা হবে। অনুষ্ঠানস্থলে যাওয়া ও শোভাযাত্রার রোড সমূহ সিসি ক্যামেরাসহ স্থির ও ভিডিও ক্যামেরা দ্বারা ও ড্রোনের মাধ্যমে সার্বক্ষণিক মনিটরিং করা হবে। অনুষ্ঠানের চারপাশে পর্যাপ্ত পরিমাণ ফুট পেট্রোল থাকবে। সিটিটিসি, সোয়াত ছাড়াও পর্যাপ্ত সংখ্যক পোশাকধারী ও সাদা পোশাকে পুলিশ সদস্য মোতায়েন থাকবে।