তীব্র তাপপ্রবাহের কবলে যশোর, প্রভাব পড়েছে সড়ক-ফসলেও
টানা তীব্র তাপপ্রবাহের কবলে যশোরাঞ্চল। গত বুধবার থেকেই এ জেলার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে ঘোরাফেরা করছে। গতকাল শনিবার (২০ এপ্রিল) তা পৌঁছে যায় ৪২ দশমিক ছয় ডিগ্রিতে। আজ রোববার বিকেল ৩টায় এ জেলার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৪০ দশমিক দুই ডিগ্রি সেলসিয়াস। সব মিলিয়ে হাঁসফাঁস মানবজীবন। প্রভাব পড়েছে গবাদি পশুসহ প্রাণিকূলে। বাদ যায়নি ফসলের ক্ষেত। গলতে শুরু করেছে সড়কের বিটুমিন।
তীব্র তাপপ্রবাহের কারণে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়েছেন সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ। তারা রাস্তায় বের হতে পারছেন না, কাজ করতে পারছেন না। জীবীকার তাগিদে কেউ কেউ বাইরে বের হলেও বেশিক্ষণ শ্রম দিতে পারছেন না। অনেককেই বড় গাছের নিচে, পার্কে বিশ্রাম নিতে দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে বেলা ১১টা থেকে বিকেল সাড়ে ৩টা পর্যন্ত তাপপ্রবাহ সহ্যক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে বলে জানান তারা।
তাপপ্রবাহ দীর্ঘায়িত হওয়ায় ডায়রিয়া, নিউমোনিয়াসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। যাদের বেশিরভাগই শিশু ও বয়স্করা। যশোর আড়াইশ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. আব্দুস সামাদ বলেন, তীব্র তাপপ্রবাহের কারণে ঠান্ডা-জ্বর, সর্দি-কাশি, নিউমোনিয়া নিয়ে হাসপাতালে সবচেয়ে বেশি ভর্তি হচ্ছে শিশু ও বয়স্করা। আজ রোববার এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত তথ্য বলছে, হাসপাতালে নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে ৬৫ শিশু ভর্তি ছিল, যাদের মধ্যে ২৮টি শিশুই গরমের কারণে ঠান্ডাজনিত রোগে আক্রান্ত। আর এদিন ডায়রিয়া ওয়ার্ডে ভর্তি ছিলেন ১৬ জন রোগি।
অতিতীব্র তাপপ্রবাহে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ফসলের ক্ষেতও। যশোর কৃষি অর্থনীতি প্রধান অঞ্চল। প্রায় সব ধরণের ফসলই এখানে উৎপাদন হয়। তাই যেকোনো বৈরি আবহাওয়া যশোরের কৃষি অর্থনীতিতে কিছুটা হলেও ক্ষতি করে। তবে, এবার ধানের ক্ষতি একটু কম হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে, তাপপ্রবাহ আরও দীর্ঘায়িত হলে সবজির ক্ষতি হবে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর যশোরের উপপরিচালক ড. সুশান্ত কুমার তরফদার এনটিভি অনলাইনকে বলেন, যশোরের মাঠে এখন যত ধরণের ফসল রয়েছে, তার মধ্যে ৮০ ভাগই ধান। এসব ধানের ৮০ ভাগই পেকে গেছে। কোথাও কোথাও ধান কাটা শুরু হয়ে গেছে। দুই-তিন দিনের মধ্যে বেশিরভাগ ধান কাটা হয়ে যাবে। তবে কিছু এলাকায় কৃষক কিছুটা দেরিতে ধানের চারা রোপন করেছিলেন। তাদের ধান উঠতে আরও কয়েকদিন লাগবে। তীব্র তাপপ্রবাহের কারণে তাদের জমিতে দু’তিনটি সেচ বেশি লাগবে।
যশোর অঞ্চল সবজি উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত। বছরে ছয় লাখ মেট্রিক টন সবজি এখানে উৎপাদিত হয়, যা দিয়ে যশোর ও আশপাশের এলাকার চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি বড় একটি অংশ বিভিন্ন জেলায় পাঠানো হয়। কৃষি কর্মকর্তা সুশান্ত কুমার তরফদার বলেন, তাপপ্রবাহ দীর্ঘায়িত হলে লতাজাতীয় সবজি ও সবজির চারা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। পাতা পুড়ে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে সন্ধ্যায় এসব ক্ষেতে সেচ দেওয়ার জন্য কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে চাষীদের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।
দেশে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদিত কাঁচা ফুলের সিংহভাগই যশোরের গদখালীর চাষীরা উৎপাদন করে থাকেন। যশোর ফুলচাষী সমবায় সমিতি লিমিটেডের সভাপতি আব্দুর রহিম এনটিভি অনলাইনকে বলেন, তীব্র গরমে সব ধরণের ফুলের পাপড়ি পুড়ে, শুকিয়ে পড়ে যাচ্ছে। এর থেকে রেহাই পেতে ঘন ঘন সেচ দিতে হচ্ছে। ফলে ফুলের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, এই গরমের কারণে ফুলগাছে নানারকম রোগের প্রাদুর্ভাবও হচ্ছে। সেসবের মোকাবিলা করতে গিয়েও উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে।
দেশে উৎপাদিত সাদা মাছের রেনু পোনার বড় একটি অংশ যশোরের হ্যাচারিগুলোতে উৎপাদিত হয়ে থাকে। যশোর মৎস্য হ্যাচারি মালিক সমিতির সভাপতি ফিরোজ খান এনটিভি অনলাইনকে বলেন, টানা তীব্র তাপপ্রবাহের কারণে তাদের হ্যাচারিগুলোতে উৎপাদন এখন প্রায় বন্ধ। পুকুর জলাশয়ে পানি নেই। যে কারণে মৎস্য চাষীরা তাদের কাছ থেকে রেনু কিনছেন না। যেহেতু চাহিদা নেই, তাই হ্যাচারি মালিকরা রেনু তৈরি করছেন না। আবার রেনু তৈরি করতে গেলেও পানির পর্যাপ্ত সরবরাহ দরকার হয়। কিন্তু পানির লেয়ার আশংকাজনকভাবে নেমে যাওয়ায় হ্যাচারিতে তারা পানি তুলতে পারছেন না।
এদিকে প্রচণ্ড খরতাপে দুপুরের দিকে যশোরের বিভিন্ন সড়কের বিটুমিন গলে যাচ্ছে। সড়ক বিভাগের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী মাহবুব হায়দার খান এনটিভি অনলাইনকে বলেন, কিছু রাস্তার কোনো কোনো স্থানে বিটুমিন গলে যাচ্ছে বলে আমরা খবর পেয়েছি। এটা মূলত তাপমাত্রার কারণেই হচ্ছে।
সড়ক বিভাগ সূত্র জানায়, এখন সড়কগুলোকে বেশি তাপমাত্রা সহনশীল করতে ৬০ থেকে ৭০ গ্রেডের বিটুমিন ব্যবহার করা হচ্ছে। আগে ৮০ থেকে ১০০ গ্রেডের বিটুমিন ব্যবহার করা হতো। কিছু কিছু রাস্তা বেশ কয়েক বছর আগের তৈরি, যেগুলোতে ৮০ থেকে ১০০ গ্রেডের বিটুমিন ব্যবহার করা হয়েছে। সে কারণে এগুলো গলে যেতে পারে।