জিডির পরও খুলনার সেই ফিলিং স্টেশনে থেমে নেই ‘ক্রস ফিলিং’
অবৈধ প্রক্রিয়ায় পানিসহ যানবাহনের গ্যাস সিলিন্ডারে ভরে বিক্রির অভিযোগে সংশ্লিষ্ট ফিলিং স্টেশনের বিরুদ্ধে সাধারণ ডায়েরি করা হয়েছে। ডুমুরিয়া থানায় গত ২৮ মার্চ ভুক্তভোগী কোম্পানি বসুন্ধরা এলপি গ্যাস লিমিটেডের মোংলা প্লান্টের ডেপুটি ম্যানেজার জামিল আহমেদ বাদী হয়ে জিডিটি করেন।
তার আগে ২৬ মার্চ ‘পানিসহ যানবাহনের গ্যাস সিলিন্ডারে, কোম্পানির লাভ ডিলারের পকেটে’ শিরোনামে এনটিভি অনলাইনে একটি খবর প্রকাশিত হয়। তারপর কিছুদিন বন্ধ ছিল এই অবৈধ কার্যক্রম। খবরের পরে নড়েচড়ে বসে স্থানীয় প্রশাসন। পরে ২৮ মার্চ ভুক্তভোগী কোম্পানির পক্ষ থেকে জিডি করা হয়। জিডির পরও সংশ্লিষ্ট ফিলিং স্টেশনটি তাদের এই অবৈধ কার্যক্রম বন্ধ করেনি। বরং বহাল তবিয়তে ক্রস ফিলিং চালিয়ে যাচ্ছে।
যানবাহনে ব্যবহৃত গ্যাস রান্নার বোতলজাত সিলিন্ডারে ক্রস ফিলিং করলে জেল, অর্থদণ্ড ও লাইসেন্স বাতিল করার আইন আছে। কিন্তু খুলনা জেলার ডুমুরিয়া উপজেলা পরিষদের মহিলা ভাইস চেয়ারম্যানের পারিবারিক ফিলিং স্টেশনে এই আইনই যেন অসহায়, খোদ বিস্ফোরক পরিদর্শক সে কথা স্বীকার করেন। ফলে এই ফিলিং স্টেশন থেকে রান্নার শত শত গ্যাস সিলিন্ডারে ক্রস ফিলিং করে এক রাতেই লাখ টাকার ওপরে অবৈধ আয় করছেন। প্রতারিত হচ্ছে গ্রাহক, ঝুঁকি বাড়ছে বিস্ফোরণের। জেলা ও উপজেলা প্রশাসন এবং ভোক্তা অধিদপ্তর জানায়, অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। যদিও বসুন্ধরা এলপি গ্যাসের পক্ষ থেকে এ লতিফ ফিলিং স্টেশনের বিরুদ্ধে জিডির প্রায় এক মাস পেরিয়ে গেলেও আজ পর্যন্ত কোন তদন্ত হয়নি।
এনটিভির প্রতিবেদক গত ৬ এপ্রিল দ্বিতীয় দফায় ঐ ফিলিং স্টেশনে গেলে ক্রস ফিলিং করতে দেখা যায়। সেখানে কর্মরত মিনহাজ স্বীকার করেন, এখানে প্রতিরাতে ক্রস ফিলিং করা হয়। তিন প্রতিবেদককে মালিকের সাথে কথা বলতে বলেন। মিনহাজ আরও জানান, ডিলার যত টাকার গ্যাস ভরে দিতে বলে তত টাকার গ্যাস ভরা হয়। ১০০ থেকে ২০০ ক্রস ফিলিং বা রিফিল করলে প্রতিষ্ঠানের প্রতিরাতে মুনাফা হয় সিলিন্ডার প্রতি ৫০০-৬০০ টাকা। ফলে এক রাতেই অবৈধভাবে মুনাফা হয় এক থেকে দেড় লাখ টাকা পর্যন্ত।
এই ঘটনার পর খুলনা এলপি গ্যাস ব্যবসায়ী মালিক সমিতির সভাপতি শেখ মো. তোবারক হোসেন তাপু খুলনা এনটিভি অফিসে এসে বলেন, অন্য কোন টিভি যায় না। গভীর রাতে এনটিভি যান কেন? এজন্য অফিস খরচ আছে, রাস্তায় খরচ আছে। সাংবাদিকদের খরচ আছে, সবাইকে টাকা দিতে হয়।
এসময় এ লতিফ ফিলিং স্টেশনের পক্ষে এনটিভি প্রতিনিধিকে ডিলার সমিতির সভাপতি একটি খাম ধরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন।
এই ক্রস ফিলিং অবৈধ স্বীকার করে এ লতিফ ফিলিং স্টেশনের মালিক মো. আব্দুল লতিফ জমাদ্দার বলেন, গ্যাসের গাড়ি খুলনায় কম। তাই বিক্রির জন্য ঘন ঘন গ্যাস স্টেশন দিয়েছে। চালের দাম বাড়লে সবাই চিৎকার করে, কিন্তু গ্যাসের দাম বাড়লে সবাই নিরব থাকে।
খুলনার বেশির ভাগ গ্যাস ফিলিং স্টেশনে গ্যাস চেম্বার থাকে উন্মুক্ত। কিন্তু ডুমুরিয়ার এ লতিফ ফিলিং স্টেশনের গ্যাস চেম্বার ইটের গাঁথুনি দিয়ে ঢাকা। এই ফিলিং স্টেশনের মালিক মো. আব্দুল লতিফ জমাদ্দারের মেয়ে শারমিন পারভিন ডুমুরিয়া উপজেলা পরিষদের মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান। প্রশাসনের কেউ অভিযোগ আনলে এই মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান সকলকে সামাল দেন বলে অভিযোগ করেন বিস্ফোরক পরিদপ্তর খুলনা কার্যালয়ের পরিদর্শক ড. মো. আসাদুল ইসলাম।
এনটিভিতে নিউজের পর তারা পরিদর্শন করে ক্রস ফিলিংয়ের প্রমাণ পেয়েছেন এবং ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠি দিয়েছেন জানিয়ে আসাদুল ইসলাম জানান, তারা কোন পদক্ষেপ নিতে গেলে ডুমুরিয়া উপজেলা পরিষদের মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান শারমিন পারভিন যোগাযোগ করেন। এমনকি তাদের হুমকিও দেন। ফলে তারা অনেকটা অসহায় অবস্থায় আছেন।
এব্যাপারে ডুমুরিয়া উপজেলা পরিষদের কার্যালয়ে গিয়ে মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান শারমিন পারভিনের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে বলেন, ‘আমি এনটিভিকে সাক্ষাৎকার দেব না।’
এসময় তিনি চেয়ার ছেড়ে উঠে যান। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হয়ে কীভাবে সাধারণ গ্রাহকদের প্রতারিত করছেন? এমন প্রশ্ন করলে তিনি কোন জবাব না দিয়ে এনটিভির প্রতিনিধির ভিজিটিং কার্ড ছুড়ে ফেলে দেন এবং তার সরকারি কক্ষ ছেড়ে বাইরে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ডুমুরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আল আমিন বলেন, আমি মাত্র কয়েকদিন হলো এসেছি। তাই এ ব্যাপারে কিছু জানি না। তবে অভিযোগের সত্যতা পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
অপরদিকে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর খুলনার উপপরিচালক মোহাম্মদ সেলিম জানান, তারা তদন্ত করেছেন। অচিরেই ব্যবস্থা নেবেন।
বসুন্ধরা এলপিজির মোংলা পোর্ট এরিয়ার ডেপুটি ম্যানেজার জামিল আহমেদ জানান, বিষয়টি লিখিতভাবে বিস্ফোরক পরিদপ্তর, জেলা প্রশাসক ও শ্রম অধিদপ্তরে অভিযোগ দিয়েছেন। তারা এই অবৈধ রিফিল বন্ধের চেষ্টা চালাচ্ছেন। কারণ এতে ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
ডুমুরিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সুকান্ত সাহা জানান, জিডি গ্রহণ করে তদন্তের জন্য এসআই বিশ্বজিৎ পালকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তদন্ত শেষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। নিয়ম অনুযায়ী আদালতকে অবহিত করা হয়েছে।
তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই বিশ্বজিৎ পালের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, তদন্ত করার জন্য বিধান মোতাবেক আদালতে আবেদন করা হয়েছে। আদালতের অনুমতির পর তদন্ত শুরু করা হবে।
খুলনার জেলা প্রশাসক খন্দকার ইয়াসির আরেফীন এনটিভিকে বলেন, অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ফিলিং স্টেশনের মালিকের মেয়ে মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান হওয়ায় প্রশাসন অসহায় কিনা জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক জোর দিয়ে বলেন, ‘প্রশাসন অসহায় নয়।’ এসময় জেলা প্রশাসক তাৎক্ষণিকভাবে ডুমুরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে ফোন করে ব্যবস্থা নিতে বলেন।
ভৌগলিক কারণে ডুমুরিয়ার এই ফিলিং স্টেশন হতে খুলনা-সাতক্ষীরা-যশোরসহ বিভিন্ন জেলায় গ্যাস সরবরাহ হয়ে থাকে। এমনকি ঢাকায় যাওয়ারও অভিযোগ রয়েছে। বসুন্ধরার এলপিজি গ্যাস সরবরাহ করলে ডিলাদের মুনাফা হয় সিলিন্ডার প্রতি ৫০-৬০ টাকা আর এই ক্রস ফিলিং করলে অসাধু ব্যবসায়ীরা প্রতি সিলিন্ডারের মুনাফা করেন ৫০০-৬০০ টাকা।
যানবাহনের গ্যাসের লিটার ৬৮ টাকা আর রান্নার গ্যাসের লিটার পড়ে ১০৭ টাকার ওপরে। তবে এসব ক্রস রিফিল গ্যাস সিলিন্ডারের পানিসহ এক হাজার টাকা করে নেওয়া হয়। বসুন্ধরা, ওমেরা, লাফার্জ সব ব্রান্ডের সিলিন্ডারে এখানে ক্রস ফিলিং হয়। আট-নয়শ থেকে এক হাজার টাকার গ্যাস সরবরাহ করা হয়। অথচ বসুন্ধরার ডিলার মূল্য ১৫৫০ টাকা আর গ্রাহকের কাছে বিক্রি মূল্য ১৬০০ টাকা।
এই প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা বলেন, প্রশাসন ম্যানেজ করেন ডুমুরিয়া উপজেলা মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান শারমিন পারভিন। তাই আইন তার স্বাভাবিক গতিতে চলতে পারছে না।