‘আমার হাত ছেড়ে দাও, তোমার প্রাণ বাঁচাও’
‘মা আমার হাত ছেড়ে দাও, আমি আর বাঁচব না। তোমার প্রাণ বাঁচাও।’ মৃত্যুর আগে মাকে বলেছিল স্বর্ণা দাস। মায়ের সঙ্গে পালিয়ে ভারতে মামার বাড়িতে যাওয়ার সময় ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীবাহিনী বিএসএফের গুলিতে ঘটনাস্থলেই নিহত হয় সে।
গত ১ সেপ্টেম্বর (রোববার) রাত অনুমান ৯টার দিকে মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়ার শরিফপুর ইউনিয়নের লালারচক সীমান্ত দিয়ে ভারত মামার বাড়ি যেতে চেয়েছিল তারা।
বিএসএফের নির্মমতায় নিহত স্বর্ণার পরিবার অজনা আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে। মুখ খুলে কারো সঙ্গে কথা বলছে না। থামছে না তাদের পরিবারে কান্না। বাবা পরেন্দ্র দাস ও মা সঞ্জিতা রানী দাস বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন। পরিবারের কনিষ্ট সদস্যকে হারিয়ে তারা এখন নির্বাক। একই অবস্থা প্রতিশীদের মধ্যেও। তিন ভাই ও দুই বোনের মধ্যে স্বর্ণা ছিল ছোট। স্বর্ণাকে হারিয়ে তার সহপাঠীরাও বিচলিত। জুড়ী উপজেলার স্থানীয় নিরোদ বিহারী উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী মেধাবী স্বর্ণা পুরো স্কুল মাতিয়ে রাখত। মৌলভীবাজার জেলার জুড়ী উপজেলার কালনীগড় গ্রামে এখন সুনসান নীরবতা।
স্বর্ণা মায়ের সঙ্গে গত ১ সেপ্টেম্বর রাতে কুলাউড়ার শরিফপুর ইউনিয়নের লালারচক সীমান্ত দিয়ে ভারত যেতে চেয়েছিল। ত্রিপুরা রাজ্যের কৈলাশহর এলাকার শনিচড়া গ্রামে তার মামার বাড়ি। স্বর্ণার এক ভাই মামা কার্তিক দাসের পরিবারের সঙ্গে থাকেন। আপন ভাইকে দেখা ও মামার বাড়ি বেড়ানোর উদ্দেশে স্বর্ণা ও তার মা সীমান্তে যান।
স্বর্ণা দাসের বাবা পরেন্দ্র দাস বলেন, ‘ওই সকালে মা ও মেয়ে ভারতে যাওয়ার উদ্দেশে বাড়ি থেকে বের হয়। সোমবার সকালে স্বর্ণার মামার বাড়িতে যোগাযোগ করে জানতে পারি তারা যায়নি। পরে অনেক খোঁজাখুঁজির পর এক সেনা কর্মকর্তার সহযোগিতায় শমশেরনগর থেকে স্বর্ণার মাকে উদ্ধার করি। ওই দিন বিকেলে ৪৬ বিজিবি সীমান্ত ক্যাম্প কমান্ডারের মাধ্যমে আমার মেয়ের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত হই।’
পরেন্দ্র দাস জানান, দালালের সহযোগিতায় লালারচক সীমান্ত দিয়ে ভারতে যাওয়ার চেষ্টা করেন তারা। রাত ৯টার দিকে ভারতের কাঁটাতারের বেড়ার কাছে পৌঁছালে বিএসএফ তাদের লক্ষ্য করে এলোপাতাড়ি গুলি চালালে স্বর্ণা ঘটনাস্থলেই মারা যায়। ভাগ্যক্রমে স্বর্ণার মা বেঁচে যান।
কুলাউড়া উপজেলার শরিফপুর ইউনিয়ন পনিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান খলিলুর রহমান জানান, মোট চার বাংলাদেশি দালালের মাধ্যমে সীমান্তের কাঁটাতারের পাশে গেলে বিএসএফ গুলি করে। গুলিতে ঘটনাস্থলেই এক কিশোরী নিহত হয়। এ সময় দুজন আহত হয়। আহতদের সিলেট ওসমানি মেডিকেল কলেজে হাসপাতালে পাঠানো হয়। তাদের বাড়ি চট্টগ্রামে।
স্বর্ণার ভাই পিন্টু দাস কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘স্বর্ণা কাঁটাতারের পাশে হঠাৎ বিএসএফ সদস্যদের দেখে আতঙ্কিত হয়ে যায়। তাদের বলে, ‘আমাদের মারবেন না, আইনের আওতায় নিয়ে যান।’ কোনো কথা না শুনে বিএসএফ যখন একেবারে কাছে থেকে বন্দুক তাক করে, তখন স্বর্ণা তা দেখে ঘুরে দাঁড়ায়। তখন পেছন দিক থেকে বিএসএফ গুলি করলে গুলি পিঠ দিয়ে ঢুকে বুকের ডানপাশ দিয়ে বের হয়ে যায়। তখন স্বর্ণা মা’কে বলে, ‘মা আমার হাতটা ছেড়ে দাও, আমি আর বাঁচব না। তোমার প্রাণ বাঁচাও।’”
পিন্টু দাস আরও বলেন, ‘ওই সময় চট্টগ্রামের একটি পরিবারের সঙ্গে আমার মা ও বোনকে দালালরা ভারতে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা করে। নির্দয় বিএসএফের গুলিতে আমার বোনের শরীর ঝাঁজরা হয়ে গেছে।’
পশ্চিম জুড়ী ইউপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম বলেন, মেয়েটি খুব নম্র-ভদ্র ছিল। পুরো গ্রামেই তার সুনাম ছিল। গুলি করে মারার অধিকার কে দিলো বিএসএফকে। আমরা সীমান্তে গুলি করে মারাকে সমর্থন করি না। ফেলানি স্বর্ণার মতো আর কত লাশ সীমান্তে পড়বে?’
স্বর্ণার সহপাঠী মারিয়া জান্নাত, হুমাইরা আক্তার ও ইসরাত জাহান নুরা বলে, ‘পড়ালেখায় স্বর্ণা ভালো ছিল। খেলাধুলাও করত। সুন্দর কথাবার্তায় পুরো ক্লাস মাতিয়ে রাখত। বিএসএফ তাকে গুলি করে হত্যা করেছে,এটা ভাবতে কষ্ট হচ্ছে। এই বাহিনী এত নির্মম কেন? ওদের কি স্বর্ণার মতো কোনো সন্তান নাই। আমরা স্বর্ণ হত্যার বিচার চাই।’
স্বর্ণার স্কুলশিক্ষক তপনকান্তি দাস বলেন, ‘স্বর্ণা লেখাপড়ার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও ছিল মেধাবী। সে ছিল বহুমুখী প্রতিবার অধিকারী। তার সহপাঠী, শিক্ষকসহ এলাকাবাসি এ মৃত্যু কোন ভাবে মেনে নিতে পরছে না।’ তিনি এ হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু বিচারের দাবি করে সীমান্তে মানুষ হত্যা বন্ধের জোর দাবি করেন।
পতাকা বৈঠক শেষে প্রায় ৪৫ ঘণ্টা পর গত মঙ্গলবার (৩ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে চাতলাপুর চেকপোস্ট দিয়ে স্বর্ণার মরদেহ হস্তান্তর করে বিএসএফ। এর আগে বিএসএফ বিকেল ৫টার দিকে মরদেহ সীমান্তে নিয়ে আসে।