‘আমার ছেলের রক্তে নতুন প্রাণে জেগে উঠুক বাংলাদেশ’
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে নিহত হন রমজান। দিনটা ছিল ৫ আগস্ট। সময় বেলা ১১টার আশপাশ। মিছিলে একেবারে সামনের সারিতে ছিলেন রমজান। পুলিশের গুলি রমজানের বুকের বাম পাশ দিয়ে ঢুকে বেরিয়ে যায় পিঠ চিরে। রাজপথ ভেসে যায় শ্রমজীবী রমজানের তাজা রক্তে। গুরুতর আহত রমজানকে এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পর দুপুরেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।
শহীদ রমজানকে নিয়ে মা অজুফা বেগম বলেন, ‘আমার ছেলেকে তো আর ফিরে পাব না। দেশের জন্যে ও রক্ত দিয়েছে, প্রাণ দিয়েছে। আমার ছেলের রক্তে নতুন প্রাণে জেগে উঠুক বাংলাদেশ।’
অজুফা বেগমের ছয় ছেলে-মেয়ের মধ্যে ব্যতিক্রম ছিলেন রমজান আলী (৩০)। নাটোরের চলনবিল অধ্যুষিত হাজীপাড়া গ্রামে কেটেছে তার শৈশব-কৈশরের দূরন্ত দিনগুলো। বাবা-মায়ের অভাবের সংসার। নিজের চেষ্টায় কতুয়াবাড়ি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি আর কলম ডিগ্রি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে আসেন ঢাকায়। কাজ নেন একটা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। একই কর্মক্ষেত্রে কাজের সুবাদে সেখানেই প্রেম আর বিয়ে। ঘর আলো করে আসে সুকন্যা। বাড়ে অভাবও। পাড়ি জমান সৌদি আরবে। কিন্তু বাবা-মা, ভাই-বোন আর স্ত্রী-কন্যার জন্যে পরান পোড়ে। ফিরে আসেন দেশে। এবার বাড়িতে থেকে নতুন সংগ্রাম, শুরু করেন রাজমিস্ত্রির কাজ। কিছুদিন পরে আবারও পেশার পরিবর্তন। ঢাকার বাইপাইলে এসে যোগ দেন মাছের আড়তে আর স্ত্রী একটা গার্মেন্টসে। দুজনের উপার্জনে মেয়েকে নিয়ে সুখের সংসার। মাঝেমাঝে নাড়ির টানে বাড়ি ফেরেন। সুযোগ পেলে মায়ের হাতে তুলে দেন কষ্টার্জিত টাকা। বাবা-মায়ের জন্য যেন একটু বেশি দরদ, অন্য ভাই-বোনদের চেয়ে। এই বয়সেও বাড়ি ফিরলে মা নিজ হাতে মুখে ভাত তুলে খাওয়ান।
অজুফা বেগম জানান, এই ঈদেও বাড়ি আসলে আমি রমজানকে ভাত মাখিয়ে মুখে তুলে খাইয়েছি। ও ছিল আমার আদরের ধন।
শহীদ রমজানের চাচাতো ভাই পোল্ট্রি খামারি তোফাজ্জল হোসেন বলেন, রমজান আমার চেয়ে ১০ বছরের ছোট। কিন্তু সে ফোনে নিয়মিত যোগাযোগ রাখত। বাড়িতে এলে সব আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে দেখা করত।
কতুয়াবাড়ি উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক তোফাজ্জল হোসেন বলেন, রমজান ছিল মেধাবী আর বিনয়ী। এমন ছাত্র খুব কম দেখা যায়। মহান আল্লাহ তাকে বেহেশত নসীব করুন।
শহীদ রমজানের বাবা নজরুল ইসলাম সন্তান হত্যার বিচার দাবি করে বলেন, আমি সকল হত্যাকাণ্ডের বিচার চাই, সকলের জীবন উৎসর্গের স্বীকৃতি চাই। জেলা প্রশাসক মো. মাছুদুর রহমান আমাদের পরিবারকে ৫০ হাজার টাকা দিয়েছেন। তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামের সঙ্গে আমার মেয়ে ময়নাকে সঙ্গে নিয়ে দেখা করতে গেলে তিনি জানিয়েছেন, সকল শহীদ পরিবারকে মাসিক ভাতা দেওয়া হবে।
‘আমার সব ছেলে-মেয়ের মধ্যে রমজান ছিলো সবচেয়ে দরদি। এমন সোনার ছেলে আর কোথায় পাই?’—বললেন অজুফা বেগম। শহীদ মায়ের আহাজারিতে চারপাশের বাতাস ভারি হয়ে ওঠে। তিনি বলেন, রমজান তো আর ফিরবে না, আর কোন মায়ের ছেলে যেন প্রাণ না হারায়, তারা যেন ঘরে ফেরে। তাদের জন্যে দেশ হোক বাসযোগ্য।
ছবির মতন সবুজ প্রকৃতি দিয়ে সাজানো শহীদ রমজানের বাড়ির পাশেই গদাই আর গুড়নই নদীর মিলিত মোহনা। এ নদী বয়ে যাবে নিরবধি। কিন্তু, নদীপাড়ের এক চিলতে টিনের বাড়িতে রমজান আর ফিরবেন না। পাশের গোরস্তানে চির নিদ্রায় শায়িত তিনি আজ। দেশ-দেশান্তরে কর্মের খোঁজে ছুটে চলা শ্রমজীবী মানুষটা মনে হয় বড্ড ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। তাই দেশের জন্যে জীবন দিয়ে ঘুমিয়ে গেছেন চিরতরে। কিন্তু জীবন দেয়া শত শহীদের রক্তেই নতুন করে জ্বলে উঠবে বাংলাদেশের প্রাণ।