এক মাস পর বাবা জানলেন, ছেলে হত্যার ঘটনায় মামলা হয়েছে
চৌদ্দ বছরের কিশোর মোবারক হোসেন। বাবার খামারের দুধ বিক্রি করতে বের হয় ১৯ জুলাই দুপুরে। দিনটি ছিল শুক্রবার। দুধ বিক্রির পর জুমার নামাজ আদায় করে বন্ধুদের সঙ্গে সে যায় ধানমণ্ডির বেপজা কমপ্লেক্সের সামনে। যোগ দেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে। সেখানে মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায় মোবারক।
মোবারকের পরিবারের দাবি, পুলিশের ছোঁড়া গুলি মাথায় লেগে মারা যায় মোবারক। তবে পুলিশ বলছে, বিএনপি-জামায়াত ও শিবিরের নেতাকর্মীদের এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণে গুরুতর আহত হয় মোবারক। পরে গ্রিন লাইফ হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাকে মৃত ঘোষণা করেন কর্তব্যরত চিকিৎসক।
১৯ জুলাই বিকেলে ঘটা এ ঘটনায় ধানমণ্ডি থানায় মামলা হয় ২৭ জুলাই। মামলাটি করেন ধানমণ্ডি থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মারুফ মেহেদী। তবে, মামলার বিষয়টি মোবারকের বাবা প্রথম জানতে পারেন ২৭ আগস্ট। ঘটনার পুরো এক মাস পর! সেদিন রমজান আলীর সঙ্গে পথে দেখা হয় কলাবাগান থানার উপরিদর্শক (এসআই) আরিফ হোসেনের। তখন আরিফ মামলার ঘটনাটি জানান রমজানকে।
রমজান আলী এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘আমার ছেলে মোবারক হোসেন ছাত্রদের সঙ্গে গ্রিন রোডে আন্দোলনে যায়। সেখানে গিয়ে মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়। এতে সে মারা যায়। অথচ, আমার ছেলের ঘটনায় মামলার কথা আমিই জানলাম এক মাস পর। আমাকে কেউ কিছু জানাল না।’
রমজান আলী আরও বলেন, ‘১৯ জুলাই ছেলের মাথায় গুলি লাগে। ২০ জুলাই ভোরে হাসপাতালে মারা যায়। মামলা হয় ২৭ জুলাই। এরপর ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতন হয়। তিনি ভারতে পালিয়ে যান। ২৭ আগস্ট আমি নিজের খামারের দুধ বিক্রি করে বাসায় ফিরছিলাম। এমন সময় রাস্তায় দেখা হয় কলাবাগান থানার এসআই আরিফ হোসেনের সঙ্গে। তখন তিনি আমাকে জানালেন, মোবারকের ঘটনায় মামলা হয়েছে। তখন প্রথমবার আমি এ ঘটনা শুনি। আরিফ সাব জানিয়েছেন, আমাদের চিন্তা করার দরকার নেই। এটি সরকার বাদী মামলা। শেখ হাসিনার পালিয়ে যাওয়ার ২১ দিন পর জানতে পারলাম, আমার ছেলে হত্যার ঘটনায় মামলা হয়েছে।’
রমজান আলী বলেন, ‘ঘটনা শোনার পর আমি ধানমণ্ডি থানার ডিউটি অফিসারের রুমে যাই। তিনি আমাকে সোজা সাবেক ওসি আনোয়ার হোসেনের রুমে পাঠালেন। আমি ওসিকে বললাম, আমি তো মামলা করিনি। মামলা কে করল? তিনি আমাকে জানালেন, এটা সরকার বাদী মামলা। আপনারা সরকারি অনুদান পাবেন। আপনাদের মামলা করার দরকার নেই।’
রমজান আলী বলেন, ‘আমি চিন্তা করলাম, সরকার বাদী মামলা হয়েছে; দেখি সরকার কী করে। এখন তো ইউনূস সরকার। রাষ্ট্রের দিকে আমি তাকিয়ে ছিলাম যে, তাদের থেকে খোঁজ নেয় কি না। কিন্তু, সরকারের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত যোগাযোগ করা হয়নি আমাদের সঙ্গে।’
মামলার বাদী মারুফ মেহেদীর কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রতিবেদককে তিনি বলেন, ‘স্যারদের নির্দেশে আমি মামলা করি। পরিবারকে কেন জানানো হয়নি, আমি জানি না। তা ছাড়া তখন আমরা তো পরিবারের খোঁজ জানতাম না।’
মোবারকের লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে নিয়ে যায় কলাবাগান থানার পুলিশ। মামলার নথিতেও ওই থানার এসআই আরিফ হোসেনের নাম উল্লেখ রয়েছে। তিনি লাশও হস্তান্তর করেছেন পরিবারের কাছে। আপনারা খোঁজ জানেন না কীভাবে? – এ কথার জবাবে মারুফ মেহেদী বলেন, ‘ঘটনাটা বড় স্যারেরা ডিল করেছিলেন। আমি এ পর্যন্তই জানি।’
কলাবাগান থানার এসআই আরিফ হোসেন বলেন, ‘মামলা হওয়ার সময় কেন পরিবারকে জানানো হয়নি, আমি জানি না। এ ঘটনা সম্পর্কে সব তথ্য আমি ধানমণ্ডি থানাকে দিই।’
এ ঘটনায় হওয়া মামলার এজাহারে মামলা বাদী মারুফ মেহেদী বলেছেন, অজ্ঞাতনামা প্রায় ১ হাজার থেকে ১ হাজার ৫০০ জন বিএনপি, জামায়াত ও ছাত্র শিবিরের নেতাকর্মী এবং অন্যান্য দুস্কৃতকারীরা ছাত্রদের কেটা বাতিলের আড়ালে ধানমণ্ডি মডেল থানাধীন বেপজা কমপ্লেক্স ভবনের সামনে সমবেত হয়। তারা সড়কের যান চলাচল বন্ধ করে বেপজা কমপ্লেক্স ভবনে অবস্থিত বিভিন্ন সরকারি, বেসরকারি, স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান, খাবারের দোকান, বেসরকারি ব্যাংক ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করে ক্ষতিগ্রস্থ করে। সেই ভবনের নিরাপত্তাকর্মীদের অস্ত্র ও গুলি ছিনতাই করে। এক পর্যায়ে পুলিশকে হত্যার উদ্দেশে ইট-পাটকেল ও পাথর নিক্ষেপ করে। সে সময় কোটা বিরোধী আন্দোলনের আড়ালে বিএনপি-জামায়াত ও শিবিরের নেতাকর্মীদের এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণে গুরুতর জখম হয় মোবারক। পরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায়।
মামলার এজাহারের তথ্যের বিষয়ে রমজান আলী বলেন, ‘পুরোপুরি মিথ্যা মামলা হয়েছে। এ মামলার দিকে তাকিয়ে থাকলে তো আমরা ছেলে হত্যার বিচার পাব না।’ এদিকে মোবারকের মা বলছেন, ‘একে তো আমার ছেলেকে মেরে ফেলছে। তার ওপর আবার মিথ্যা মামলা। আমরা দু-একদিনের মধ্যে আবার মামলা করব।’