নাটকের সেই বাকের ভাই এবার বাস্তবে কাঠগড়ায়
সকাল ৯টা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিরাপত্তার চাদরে ঢাকা পুরান ঢাকার আদালত চত্বর। পুলিশের পাশাপাশি সেনাবাহিনীর বিপুল সদস্য ঢাকা মহানগর ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে প্রবেশপথগুলো ঘিরে রেখেছে। আইনজীবীদের পরিচয় নিশ্চিত করে প্রবেশ করতে দেওয়া হলেও সর্বসাধরণের প্রবেশে ছিল বাধা। ভেতরে গণমাধ্যমকর্মীরাসহ উল্লেখযোগ্য সংখ্যক আইনজীবী জটলা করে কথা বলছেন।
আদালতে এত নিরাপত্তা কেনো—প্রশ্নে কালো গাউনে এক আইনজীবী বলেন, ‘কিছুক্ষণ পরেই খুনি নূরকে কারাগার থেকে আনা হবে। জনসাধারণের ডিম থেরাপি থেকে রক্ষা করতেই আজ অনেক সেনা সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে।’
সকাল সাড়ে ৯টার দিকে সিএমএম আদালত ভবনের ৪র্থ তলায় তিন নম্বর এজলাসে আইনজীবীদের তিল ধারণের ঠাঁই নেই। কিছুক্ষণের মধ্যেই আদালতে একে একে হাজির করা হলো বিভিন্ন মামলার আসামি। তার মধ্যে সালমান এফ রহমান, সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আলম মামুন এবং সাবেক মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগনেতা আসাদুজ্জামান নূরকে।
সকাল পৌনে ১০টার দিকে আদালতের সহকারীর উচ্চকণ্ঠের ঘোষণা ‘স্যার আ-স-ছে-ন’। ঢাকার অতিরিক্ত মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. মাহবুবুল হক এজলাসে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে কোর্ট ইন্সপেক্টর রাজধানীর মিরপুরে মামুন নামে এক ব্যক্তিকে হত্যার অভিযোগে সাবেক সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূরকে গ্রেপ্তার দেখানোর আবেদন করেন।
কোর্ট ইন্সপেক্টরের এ আবেদনের বিরোধিতা করে একজন আইনজীবী আসাদুজ্জামান নূরের ‘অসুস্থতা ও ভগ্ন স্বাস্থ্য’র বিষয়টি তুলে ধরে জামিনের আবেদন করেন। সঙ্গে সঙ্গে এজলাসে থাকা শতাধিক আইনজীবী তীব্রভাবে এর বিরোধিতা করেন। আদালতেই আইনজীবীরা আসাদুজ্জামান নূরকে ‘খুনি নূর’ হিসেবে উল্লেখ করে ফাঁসি দাবি করেন। আইনজীবীদের শান্ত করতে অ্যাডভোকেট ওমর ফারুক ফারুকীসহ কয়েকজন সিনিয়র আইনজীবী হস্তক্ষেপ করেন।
সিনিয়র আইনজীবীদের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি শান্ত হলে অ্যাডভোকেট ওমর ফারুক ফারুকী আদালতের কাছে আসাদুজ্জামান নূরকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলেন, মাননীয় আদালত, এ আসামিকে বেশ ভালোভাবেই আপনার চেনার কথা। দেশের জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ পরিচালিত নাটকগুলোতে নায়ক হিসেবে অভিনয়ের সুযোগ পেয়ে দেশের তরুণদের মনেও স্থান করে নিয়েছিলেন আসাদুজ্জামান নূর। ‘কোথাও কেউ নেই’ নাটকে তিনি বাকের ভাইয়ের চরিত্রে অভিনয় করে প্রশংসা কুড়িয়েছিলেন। নাটকে বাকের ভাইকে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে দেখে আমাদের মনেও ব্যথা লাগত। আমাদের সমাজে নাটক আর বাস্তবতা যে সম্পূর্ণ উল্টো ‘বাকের ভাই’ আর ‘আসাদুজ্জামান নূর’ তার নিকৃষ্টতর দৃষ্টান্ত।
আদালতে অ্যাডভোকেট ফারুকী আরও বলেন, একজন শিল্পীর মন অনেক কোমল হয়, জগৎবাসী এটিই জেনে আসছে। কিন্তু, এটাকে মিথ্যা প্রমাণ করেছেন আসামি আসাদুজ্জামান নূর। তিনি ফ্যাসিবাদ আওয়ামী লীগ সরকারের অন্যতম সহযোগী ছিলেন। তার গাড়ি বহরে ডিম মারার অভিযোগে তিনি কতজনকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছেন। এসব হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে তাঁকে আটক রাখা জরুরি।
আসাদুজ্জামান নূরের জামিনের বিরোধিতা করে একজন আইনজীবী পত্রিকার কয়েকটি কাটিং ও কয়েকটি ছবি আদালতে পেশ করে বলেন, মাননীয় আদালত, এই মৃতদেহটি আমার ছোট ভাইয়ের। আমরা এ আসামি আসাদুজ্জামান নূরের এলাকার অধিবাসী। শুধুমাত্র ভিন্ন দল করার কারণেই আমার এ নিরপরাধ ভাইটিকে গুম করে হত্যা করা হয়। অনেকদিন পর আমরা জানতে পারি, আমার ভাইয়ের মৃতদেহটি বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হয়েছে। অথচ, আমার খালাতো ভাইটি কোনো দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত নন। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বিষয়ে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অর্জন করেন। তাকেও আসাদুজ্জামান নূরের নির্দেশে গুম করা হয়। একটা মানুষ কতোটা ‘ঠান্ডা মাথার খুনি’ হতে পারেন, আসাদুজ্জামান নূরই হলেন তার উদাহরণ।
আসাদুজ্জামান নূরের মামলার শুনানির পর পুলিশের সাবেক আইজি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনের মামলার শুনানির সময় আদালতের সহকারীকে উদ্দেশ করে ভিড়ের ভেতর থেকে একজন পুলিশ সদস্য বলে ওঠেন, ‘আইজি স্যারের মামলাটি ধরেন।’ পুলিশ সদস্যের এ বক্তব্যটি শোনার পরপরই আইনজীবীরা হইচই শুরু করেন। তারা একযোগে ‘খুনি মামুন, খুনি মামুন’ বলে চিৎকার করতে থাকেন। এ মামলার শুনানি শেষে আদালত সাবেক এ আইজিপিকে চার দিনের রিমান্ডে পাঠায়।