চড়া সুদে চিকিৎসা ব্যয়ের বোঝা টানতে গিয়ে অসহায় ইসরাফিল
‘সাক্ষাত মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। জীবনটা হয়তো এখনই শেষ হয়ে যাবে। ভয়ে আতঙ্কে দ্রুত কালেমা পড়লাম। মরে যাবো- এমন প্রস্তুতি নিয়ে জড়তার মধ্যেই কালেমা পড়ছি, ঠিক সেই মুহূর্তেই আমার বুক বরাবর গুলি করলো। আমি ডান হাত উঁচিয়ে নিজেকে রক্ষায় ব্যর্থ চেষ্টা করলাম। গুলি হাতের গিরা ভেদ করে পেটে বিদ্ধ হলো। তারপরের জীবন এক কথায় বিভীষিকাময়। এত যন্ত্রণা সহ্য করার মতো নয়। মরে গেলেই মনে হয় ভালো হতো! পুলিশ আমার জীবনটাই এলোমেলো করে দিলো!’
আবেগরুদ্ধ কণ্ঠে এভাবেই মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে ফেরার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করছিলেন মুদি দোকানদার ইসরাফিল হোসেন (৫৭)। তবে এই অসহায় বেঁচে থাকাটাও যেন আরেক সংগ্রামের আত্মপ্রকাশ হিসেবে উঁকি দিয়েছে ইসরাফিলের জীবনে। প্রাণে বেঁচে গেলেও গুলিতে ঝাঁঝরা হওয়া ডান হাত অকেজো। চিকিৎসা করাতে চড়া সুদে ধারদেনা করেছেন। ব্যয় হয়েছে ১০ লক্ষাধিক টাকা। পরিবারের উপার্জনক্ষম এই মানুষটি টানা দুই মাস হাসপাতালের বিছানায়। একদিকে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন অন্যদিকে ব্যবসাটাও প্রায় নিভু নিভু।
এখন ধারদেনা শোধ করবেন কীভাবে? এত টাকার সংস্থানই বা হবে কীভাবে! এমন হাজারো চিন্তায় মুষড়ে পড়েছেন ক্ষুদ্র এই মুদি দোকানদার।
পাবনা জেলার ভাঙ্গুড়া থানার শাহপাড়া গ্রামের হাজী হারান উদ্দিন শাহের ছেলে ইসরাফিল হোসেন। দুই দশক আগে জীবন ও জীবিকার তাগিদে চলে আসেন সাভারে। ভাড়া করা মুদি দোকানের আয় দিয়েই চলতো স্ত্রী, তিন মেয়ে ও এক ছেলের সংসার।
জুলাই–আগস্ট বিপ্লবের সূচনাতেই সাভারে পুলিশের নির্মমতার শিকার হন মুদি দোকানদার ইসরাফিল হোসেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সূচনাতেই শিক্ষার্থীদের অহিংস আন্দোলনে নির্বিচারে গুলি চালায় স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকারের পুলিশ।
ডেডলাইন ১৮ জুলাই। পুলিশের গুলিতে ঝাঁঝরা আন্দোলনকারী এক শিক্ষার্থীকে সাঁজোয়া যানের ওপর থেকে টেনে হিঁচড়ে ফেলা হলো। পাশে সশস্ত্র মহড়ায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ক্যাডারা। ওই তরুণের দেহে তখনো ছিল প্রাণের স্পন্দন। কিছুক্ষণ পর কয়েকজন পুলিশ মিলে তাঁকে টেনে সড়ক বিভাজকের ওপর দিয়ে ঠেলে অপর পাশে ফেলে দিলো নির্দয়ভাবে।
কোটাবিরোধী আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী শাইখ আশহাবুল ইয়ামিনকে এভাবে গুলি করে হত্যাকাণ্ডের পরের এমন দৃশ্যের ভিডিওচিত্র দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়লে আন্দোলন দানা বাঁধে। বিপরীতে পুলিশও হয়ে উঠে আরো বেপরোয়া।
স্মৃতি হাতড়ে ইসরাফিল হোসেন বলেন, টান টান উত্তেজনা। ২০ জুলাই বেলা দেড়টার দিকে ঢাকা জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবদুল্লাহিল কাফীর নেতৃত্ব সাভার বাজার বাসস্ট্যান্ডে ছাত্র-জনতাকে লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়ে পুলিশ। এক পর্যায়ে ছাত্র জনতাকে ধাওয়া দিয়ে পুলিশ ছত্রভঙ্গ করে দিলে তাদের পিছু নেয় পুলিশ। সাভার বাজার বাসস্ট্যান্ডে তখনো নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ‘শিহাব স্টোরের’সামনে দাঁড়িয়ে এসব চিত্র দেখছিলাম।
ইসরাফিল হোসেন জানান, এক পর্যায়ে হুড়োহুড়ি করে আন্দোলনকারীরা তাদের দোকানের সামনে দিয়ে অতিক্রম করলে পুলিশ তাদের পিছু ধাওয়া করে। দোকানের ঝাঁপি বন্ধ করে অন্যদের মতো ইসরাফিল হোসেন নিজেও দৌঁড়ে আশ্রয় নেন পাশের বরফ কলে। দূর থেকেই দেখতে পান নিরপরাধ মানুষদের বুক ঠেকিয়ে গুলি করছে পুলিশ। একে একে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন মুরগি বিক্রেতা কোরবান আলী ও মুরগির দোকানের কর্মচারী ফারুক হোসেনসহ অনেকেই। সেদিনের নির্বিচার গুলিতে এই দুজনও শহীদ হন।
ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে ইসরাফিল হোসেন বলেন, চোখের সামনে যখন এমন নির্মম দৃশ্য দেখছি তখন মনে হলো, মৃত্যু যেন আমার খুব সন্নিকটে। কালেমা পড়ছি। সেই মূহূর্তে পুলিশের এক সদস্য হঠাৎ আমাকে দেখে ফেলে। কাছে এসে ঠিক আমার পেট লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়ে।
“ভাই আমি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ি। আমাকে মারবেন না”- এমন আকুতি জানানোর পরেও তাদের মন গলেনি। এক পর্যায়ে প্রচন্ড শব্দে হাত ভেদ করে গুলি বিদ্ধ হয় পেটে। ততদিনে পুলিশের গুলিতে আহতদের চিকিৎসা নিয়ে রীতিমতো ভীতিকর অবস্থা সাভারের হাসপাতালগুলোতে।
“কেউ পুলিশের গুলিতে আহত মানে তারাও সন্ত্রাসী। তাদের গ্রেপ্তার করা হবে- এমন গুঞ্জনে কেউ চিকিৎসা দিতেও সাহস পায়নি। গুরুতর অবস্থায় প্রথমে ল্যাবজোন নামে স্থানীয় একটি হাসপাতালে নেওয়া হলেও আমি সেখানে কোন চিকিৎসা পাইনি। পরে রক্তাক্ত অবস্থায় নেওয়া হয় পঙ্গু হাসপাতালে। সেখান থেকে স্থানান্তর করা হয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানেও এক ভীতিকর অবস্থা। চিকিৎসা নিয়ে নানা ধরনের অব্যবস্থাপনা। শেষমেষ সুচিকিৎসার জন্যে আমার পরিবার চড়া সুদে ধারদেনা করে আমাকে নিয়ে যায় পপুলার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। এই বেঁচে ফেরার জন্যে আমার পরিবারের ব্যয় হয় ১০ লক্ষাধিক টাকা।”
পরে সরকার যখন বিনামূল্যে চিকিৎসা করার নির্দেশ দেন তখন প্রায় সর্বস্বান্ত হয়ে ইসরাফিল হোসেন অবশিষ্ট চিকিৎসা গ্রহণ করেন সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে। হাতের কনুই ও গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়ায় ডান হাতটি অকেজো। পেটে এখনো অসংখ্য গুলির স্প্লিন্টার। একদিকে শরীরের যখন এই অবস্থা তখন দুঃস্বপ্ন এখনো তাড়া করে সেই বিভীষিকাময় দিনের স্মৃতি।
ইসরাফিল হোসেনের স্ত্রী সাবিনা ইয়াসমিন জানান, প্রচন্ড ব্যথায় আমার সন্তানের বাবা ঘুমাতে পারেন না। সেই দিনের ভয়াল স্মৃতি এখনো তাড়া করে ফেরে তাকে। জামায়াতে ইসলামির নেতারা একদিন ডেকে ১০ হাজার টাকা দিয়েছে। এটুকুই। কিন্তু এতদিন হয়ে গেলো সরকারের তরফে কেউ কোন খোঁজ খবর নেয়নি। এতদিন হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে চড়া সুদে যে ধার দেনা করেছিলেন এখন বিপাকে পড়েছেন পাওনাদের তাগাদায়। কোত্থেকে দেবেন এত টাকা! এসব ভাবনাতেই ক্রমশ ঝাপসা হয়ে আছে ইসরাফিল হোসেনের দুটি চোখ।