স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আদেশের তোয়াক্কা করছেন না ডা. ইউসুফ হারুন
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আদেশের তোয়াক্কা করছেন না জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের (নিটোর) সাবেক সিনিয়র কনসালটেন্ট (অর্থোপেডিকস সার্জারি) ডা. মোহাম্মদ ইউসুফ হারুন। শৃঙ্খলাভঙ্গের কারণে তাঁকে নিটোর থেকে গত ২৭ অক্টোবর বরগুনা ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে বদলি করা হয়েছে। বদলির প্রজ্ঞাপনে তাঁকে অনতিবিলম্বে বর্তমান কর্মস্থলের দায়িত্বভার হস্তান্তরপূর্বক পদায়নকৃত কর্মস্থলে যোগদান করতে বলা হয়। অন্যথায় ২৮ অক্টোবর অপরাহ্ণে তাৎক্ষণিক অবমুক্ত বলে গণ্য হবেন।
কিন্তু বদলির আদেশের আজ (৫ নভেম্বর) ৯ দিন পার হলেও তিনি এখনও তাঁর নতুন কর্মস্থলে যোগদান করেননি। উল্টো তাঁর পূর্বতন কর্মস্থল নিটোরে এসে সহকর্মী চিকিৎসকসহ হাসপাতালের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে তিনি দুর্ব্যবহার করছেন। যাতে হাসপাতালটির চিকিৎসাসেবা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। নিটোরের বেশ কয়েকজন চিকিৎসক-নার্সসহ বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারিদের সঙ্গে কথা বলে এর সত্যতা পাওয়া গেছে।
২৭ অক্টোবর স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সিনিয়র সহকারী সচিব মোহাম্মদ ইকবাল হোসেন স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ‘যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদনক্রমে এ আদেশ জারি করা হল। তিনি অনতিবিলম্বে বর্তমান কর্মস্থল এর দায়িত্বভার হস্তান্তরপূর্বক পদায়নকৃত কর্মস্থলে যোগদান করবেন। অন্যথায় ২৮/১০/ ২০২৪ তারিখ অপরাহ্ণে তাৎক্ষণিক অবমুক্ত বলে গণ্য হবেন। অবমুক্তির সময় তিনি বর্তমান কর্মস্থল হতে আবশ্যিকভাবে ছাড়পত্র গ্রহণ করবেন এবং এইচআরএস ডাটাবেজ থেকে মুভ আউট হবেন এবং যোগদানের পর ন্যস্তকৃত বিভাগে/কর্মস্থলে মুভ ইন হবেন।’
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের এই নির্দেশ অমান্য করে তিনি চাকরির শৃঙ্খলা পরিপন্থি কাজ করছেন কিনা? এমন প্রশ্নের জবাবে ডা. মোহাম্মদ ইউসুফ হারুন এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘আমি নিটোরের অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে কথা বলায় আমাকে ষড়যন্ত্র করে বদলি করা হয়েছে। আমি বদলির আদেশ বাতিল করার জন্য মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছি। দেখি মন্ত্রণালয় কী করে।’
হাসপাতালে কোথায় কীভাবে দুর্নীতি হয়েছে জানতে চাইলে ডা. মোহাম্মদ ইউসুফ হারুন কোন তথ্য-প্রমাণতো দূরের কথা সদুত্তরও দিতে পারেননি। অথচ তাঁকে বদলি করা হয়েছে তাঁর অসদাচরণের কারণে।
হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যাঁরা আহত হয়ে নিটোরে (পঙ্গু হাসপাতাল) ভর্তি আছেন তাদের সবশেষ শারীরিক অবস্থা জানতে গত ১৫ অক্টোবর পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন সেখানে যান। সেসময় নিটোরের পরিচালকসহ হাসপাতালের দায়িত্বশীল চিকিৎসক ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত থেকে উপদেষ্টাকে আহতদের চিকিৎসার ব্যাপারে অবহিত করেন। এরপর উপদেষ্টা আহতদের সুচিকিৎসার বিষয়ে সরকারের দৃঢ় অবস্থানের বিষয়ে আশ্বস্ত করেন এবং হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা প্রদান করেন। এমন সময় সিনিয়র ডাক্তার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে ডা. ইউসুফ হারুন উপদেষ্টার কাছাকাছি আসার উদ্দেশে উচ্চস্বরে গালিগালাজ শুরু করেন, যাতে হাসপাতালের চিকিৎসা ব্যবস্থা মারাত্মক ব্যাহত হয়। বিষয়টি পররাষ্ট্র উপদেষ্টার নজরে এলে তিনি তাঁর পরিচয় সম্পর্কে জানতে চান। তখন উপস্থিত চিকিৎসকরা বিষয়টি উপদেষ্টাকে জানান যে, ডা. ইউসুফ হারুন আপনার নিজ জেলার বাসিন্দা এবং আপনার ‘ঘনিষ্ট’ এই পরিচয় দিয়ে গত ২০-২৫ দিন ধরে হাসপাতালের বিভিন্ন পর্যায়ের চিকিৎসক, নার্স ও কর্মচারিদের সঙ্গে ক্ষমতা প্রদর্শন, মারধরসহ নানাপ্রকার দুর্ব্যবহার করে আসছেন।
এই ঘটনার পর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে উপদেষ্টার একান্ত সচিব মো. সামিউল মাসুদ গত ১৭ অক্টোবর দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্যে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সিনিয়র সচিবকে চিঠি দেন।
চিঠিতে বলা হয়, ‘উক্ত চিকিৎসকের কারণে হাসপাতালটির প্রশাসন ব্যবস্থা বর্তমানে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং অন্যান্য চিকিৎসকবৃন্দ স্বাচ্ছন্দ্যে কাজ করতে পারছেন না। মাননীয় উপদেষ্টা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে আশ্বস্ত করেন উক্ত ব্যক্তির সাথে তাঁর ব্যক্তিগত কোন সম্পৃক্ততা নেই এবং কারো ব্যক্তিগত পরিচয়ের সুবাদেও এহেন আচরণের কোন সুযোগ নেই। তিনি কর্তৃপক্ষকেও আরও আশ্বস্ত করেন, তিনি বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখবেন যাতে উক্ত চিকিৎসকের কারণে হাসপাতালের চিকিৎসা সেবা কার্যক্রমে কোন ধরনের নেতিবাচক প্রভাব না পড়ে।’
চিঠিতে আরও বলা হয়, ‘উপদেষ্টার সদয় নির্দেশনার প্রেক্ষিতে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (NITOR) এর চিকিৎসা কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার স্বার্থে ডা. মোহাম্মদ ইউসুফ হারুন, সিনিয়র কনসালটেন্ট (অর্থোপেডিক সার্জারি), জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (NITOR)-এর বিষয়ে দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অনুরোধ করা হল।’
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এই চিঠির পর তাঁকে নিটোর থেকে গত ২৭ অক্টোবর বরগুনা ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে বদলি করা হয়। কিন্তু তিনি সেখানে যোগদান না করে তার পর থেকে বিভিন্ন সময়ে এসে পরিচালকের বিরুদ্ধে মিথ্যে, বানোয়াট ও অশোভন আচরণ ও কথা বলেন। সবশেষ গতকাল সোমবার হাসপাতালের দোতলায় ডাক্তার ক্যান্টিনে গিয়ে সিনিয়র প্রফেসর ডা. ফারুক কাশেম, সহকারী অধ্যাপক ডা. সামসুল আলমসহ অনেকের সঙ্গেই অশোভন আচরণ করেন। এমনকি বহিরাগতদের নিয়ে এসে পরিচালকের বিরুদ্ধে নানা হুমকি-ধমকি দিয়েছেন বলে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা একাধিক আনসার সদস্য এনটিভি অনলাইনকে জানিয়েছেন।
এ ব্যাপারে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আনসার কমান্ডার আব্দুর রউফ এনটিভি অনলাইনকে সোমবার (৪ নভেম্বর) রাতে বলেন, ইউসুফ হারুন স্যার বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জনের সঙ্গেই দুর্ব্যবহার করেন। কয়েকদিন আগে জরুরি বিভাগের সামনে পরিচালক স্যার ও সামসুল আলম স্যারকে গালাগালি করেছেন। এমনকি ভাঙচুর ও অফিসে তালা মারার জন্য বহিরাগতদের নিয়ে আসেন। আমরা বাধা দিলে আমাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন। উনিতো ওনার সিনিয়র ডাক্তারদের সঙ্গেই খারাপ আচরণ করেন, আমরা তো সামান্য নিরাপত্তাকর্মী। সত্যি কথা বলতে কী হারুন স্যারকে নিয়ে আমরা সবাই বিব্রত। তার জন্য চিকিৎসা সেবা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। আমরা নিরুপায়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে নিটোরের সহযোগী অধ্যাপক পদমর্যাদার এক চিকিৎসক এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘আমরা যে তাঁর আচার-আচরণ পছন্দ করছি না, সেটাও সে বুঝছে না। সে যে ধরনের কাজ করছে সেটা পাগলামির পর্যায়ে চলে গেছে। এটা কোনো সুস্থ মানুষ করতে পারে না। তাঁর আচরণের কারণে কিন্তু পররাষ্ট্র উপদেষ্টার দপ্তর থেকে চিঠি দেওয়া হয়েছে, সেটারও গুরুত্ব সে বুঝছে না।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে একাধিক মন্ত্রীর সঙ্গে তার সখ্যতা ছিল। একাধিক মন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর ছবিও আছে। দুই বার পদোন্নতিও পেয়েছেন। কিন্তু ৫ আগস্ট ক্ষমতার পালাবদলের পর তিনি আমূল পাল্টে যান।
নিটোরের একাধিক সূত্র জানায়, বর্তমান পরিচালকের মেয়াদ আছে আর ৪ মাস। এরপর যারা পরিচালক হওয়ার চেষ্টা করছেন তাদের কারো ইন্ধন ও প্ররোচনায় তিনি এমন কাজ করে থাকতে পারেন।
হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আহত বেশ কয়েকজন রোগী, কর্তব্যরত নার্স ও ডাক্তার এবং নিরাপত্তাকর্মীরা ডা. মোহাম্মদ ইউসুফ হারুনের বিরুদ্ধে ওঠা দুর্ব্যবহার ও অসদাচরণের অভিযোগের বিষয়টি এনটিভি অনলাইনকে নিশ্চিত করেছেন।
বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে নিটোরের যুগ্ম পরিচালক ডা. মোজাফফর হোসেন এনটিভি অনলাইনকে বলেন, আমার সঙ্গে সে কখনও খারাপ ব্যবহার করেনি। কিন্তু পরিচালক স্যারসহ অন্য অনেকের সঙ্গে কেন যে এমন দুর্ব্যবহার করছেন জানি না। স্টাফদের সঙ্গে তাঁর এই দুর্ব্যবহারের কারণে হাসপাতালের পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। পরিচালক স্যার কোন রাজনীতিতে জড়িত নেই। তিনি তার কাজের ক্ষেত্রে প্রচন্ড পাংচুয়াল ও সিনসিয়ার। আমরা দীর্ঘদিন ধরে তাঁকে চিনি। তাঁর বিরুদ্ধে সে কেন যে এমন করছে, বিষয়টি আমার বোধগম্য নয়।
এ ব্যাপারে নিটোরের পরিচালক অধ্যাপক ডা. কাজী শামীমউজ্জামান এনটিভি অনলাইনকে বলেন, বিষয়টি নিয়ে আমিও বিব্রত। সে যেন প্রশাসনের ভেতরে আরেকটি প্রশাসন। আমি বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। তাঁকেও নানাভাবে বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে। পরবর্তীতে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বিষয়টি নিজ চোখে দেখেছেন। তারপর উনার দপ্তর থেকে দেওয়া চিঠিটাই সবকিছু খুলে দিয়েছে।
পরিচালক আরও বলেন, বদলির আদেশ পালন না করে সে উলটো হাসপাতালে এসে চিকিৎসাসেবার পরিবেশ নষ্ট করছে। আমরা সবাই মিলে যেখানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আহত রোগীসহ অন্যান্য রোগীদের অধিকতর গুরুত্বের সঙ্গে সার্বক্ষণিক ও নিরলস সেবা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি, অথচ সে সবাইকে ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করতে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করছে।