শেখ হাসিনা নিজেই রাষ্ট্র হয়ে উঠেছিলেন
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রেস সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন বিশিষ্ট সাংবাদিক শফিকুল আলম। প্রধান উপদেষ্টার দৈনন্দিন কর্মসূচিসহ নানা বিষয়ে গণমাধ্যমকে অবহিত করা ছাড়াও নানামুখী কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। অন্তর্বর্তী সরকারের কর্মকাণ্ড, ভাবনা, ভবিষ্যৎ কর্মসূচিসহ নানা বিষয়ে খোলামেলা কথা বলেছেন এনটিভি অনলাইন সম্পাদক ফকরউদ্দীন জুয়েলের সঙ্গে।
আপনি কয়েক দশক নিরবচ্ছিন্ন সাংবাদিকতা করেছেন। এখন সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে। আপনি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রেস সচিব, বলা যায় সরকারের একজন মুখপাত্র। নতুন দায়িত্ব কেমন লাগছে? কী ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছেন?
শফিকুল আলম : খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজে এসেছি। আমি বার্তা সংস্থা এএফপিতে ছিলাম ২০ বছর ছিলাম, এর আগে ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেসে ছিলাম, বন্ধ হওয়া বাংলাদেশ অবজার্ভারে আমি ক্যারিয়ার শুরু করি। খুবই আকর্ষণীয় চাকরি ছেড়ে আমি সরকারি চাকরিতে এসেছি। অনেকে ভাবেন, এখানে কাজ কম, কিন্তু বাস্তবে অনেক কাজ। প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে রাত ১০টা, ১১টা ১২টা পর্যন্ত কাজ করতে হয়। প্রতিটি কাজের ভিন্ন ভিন্ন চ্যালেঞ্জ।
আপনি জানেন, প্রফেসর ইউনূস বা অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা অনেক। এই আশা-আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়ন করতে সরকার কী করছে, সেটা মানুষকে জানানোও চ্যালেঞ্জের কাজ। আমরা যেটা করছি, প্রতি সপ্তাহে কমপক্ষে তিনটা সংবাদ সম্মেলন করছি। এবং, এই সংবাদ সম্মেলন প্রধান উপদেষ্টার অফিস থেকে বের করে নিয়ে এসেছি। এমন জায়গায় করছি, যেখানে যেকোনো সাংবাদিক প্রবেশ করতে পারেন। আমরা একটা হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ করেছি, যেখানে যারাই আমাদের নিউজ পেতে চান তাদের মেম্বার করে নিচ্ছি। গ্রুপে প্রায় ৫০০ সদস্য। এ ছাড়া ফেসবুক পেজ বা এক্স পেজে নিয়মিত আপডেট দিচ্ছি।
তার পরও দেখছি, অনেক ধরনের মিস ইনফরমেশন তৈরি হচ্ছে। সেজন্য আমরা নিজস্ব একটা ফ্যাক্টস পেজও করেছি। প্রচুর তো মিস ইনফরমেশন ছড়ানো হয়। সেখানে আমরা বড় বড় ঘটনার ফ্যাক্ট চেক করে জানাচ্ছি, আসলে সত্যটা কী। আমরা আরও দেখছি, অনেক কমেন্টেটর টিভিতে গিয়ে অনেক ধরনের ভুল ব্যাখ্যা দেন। ব্যাখ্যাগুলোকে ফেস করার জন্য আমি বা আমার টিমমেটরা টিভিগুলোতে যাচ্ছি, কথা বলছি।
আমরা সবাইকে বলেছি, আপনারা যারা আমাদের সমালোচনা করেন, তাদের স্বাগতম। আপনারা আমাদের ভুল-ত্রুটি ধরিয়ে দেন। আমরা আপনাদের সরকার, আপনাদের কথা শুনতে চাই। পাওয়ারের (ক্ষমতার) জায়গায় থাকলে এক ধরনের অন্ধত্ব কাজ করে, অনেক সময় অনেক কিছু দেখা যায় না। সেই জায়গা থেকে আমরা চাই মানুষের সঙ্গে যোগাযোগটা বাড়াতে। সেজন্য সমালোচকদের কথাও শোনা জরুরি।
আপনি জানেন, বাংলাদেশে বড় একটা বিপ্লব হলো। এই বিপ্লবীদের মূল আকাঙ্ক্ষা হচ্ছে রাষ্ট্র মেরামত। নতুন একটা সেটআপে রাষ্ট্রকে নিয়ে যাওয়া, যাতে রাষ্ট্র অনেক বড় হয়, রাষ্ট্র প্রসপারাস হয়। এমন একটা দেশ যেখানে সবার কথা শোনা হবে, যেখানে অবিচারটা থাকবে না, মানুষ জাস্টিস পাবে। আমরা চেষ্টা তো করতেই পারি।
আপনারা দেখেছেন, গত ১৫ বছরে কী ধরনের ইনজাস্টিস হয়েছে, বিরোধীদলের নেতাকর্মীদের ওপর কী ধরনের নির্যাতন করা হয়েছে। আমরা এমন একটা দেশ চাচ্ছি, যেখানে বিনা অপরাধে যেন কাউকে ধরা না হয়, এক্সট্রা জুডিশিয়াল কিলিংসহ কোনো কিলিংই না হয়, কেউ যেন হয়রানির শিকার না হয়। হয়তো আমাদের কিছু দুর্বলতা আছে, কিন্তু চেষ্টার কোনো অন্ত নেই। চেষ্টা করে যাচ্ছি, সেই কাজগুলো করার যা একটা ভালো সরকার মানুষের জন্য করে।
যত দূর জানি, ড. মুহাম্মদ ইউনূস আপনাকে প্রেস সচিব হওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। আপনি কি এই দায়িত্বের জন্য প্রস্তুত ছিলেন?
শফিকুল আলম : আমি ১০ আগস্ট সকালে প্রস্তাবটা পাই। আমাকে বলা হলো, আমার সঙ্গে কাজ কর। তারপর আমি আমার স্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করি। ইতিবাচক সাড়া পেলাম।
আমি এএফপিতে ২০ বছর ধরে কাজ করছি। দুটি কারণে আমি নতুন দায়িত্বে এলাম। প্রথমত, বিপ্লব, যদি বিপ্লবের জন্য কিছু করতে পারি। গণঅভ্যুত্থানে অনেকেই জীবন উৎসর্গ করেছেন। আমি না হয় আমার মূল্যবান সময়টুকু দিয়ে জনগণের একটু সেবা করি।
আরেকটি হলো, প্রফেসর ইউনূসকে আমরা দূর থেকে দেখেছি। উনি লিডার (নেতা) হিসেবে কেমন, সেটা জানা। আমি কাছ থেকে দেখেছি, তিনি দারুণ একজন লিডার। আমার কাজ বেড়েছে তিনগুণ। সপ্তাহে সাত দিনও কাজ করতে হয়। উনি (ড. ইউনূস) প্রচুর মিটিং করেন। উনি সকাল থেকে রাত পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট অনেকের সঙ্গে মিটিং করেন। বিশেষ করে সংকটকালে। যখন বন্যা হলো, গার্মেন্টসসহ বিভিন্ন সেক্টরে আন্দোলন হলো অথবা দ্রব্যমূল্যের ব্যাপার সামনে এলো, তখন তিনি প্রচুর মিটিং করে সবার কথা শুনতে চান। উনি কথা কম বলেন। কিন্তু জেনে নেন, ঘটনা কী, কোথায় কী হচ্ছে। সে অনুযায়ী তিনি খুব দ্রুত নির্দেশনা দেন।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার আগে তিন দিন কার্যত দেশে কোনো সরকার ছিল না। সরকারবিহীন ওই তিন দিন সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?
শফিকুল আলম : খুবই ভয়াবহ একটা সময় গেছে। দেখেন তিনটা দিন সরকার নেই, কোনো থানায় পুলিশ নেই।
আপনি জানেন, একটা বিপ্লব হয়েছে। বিপ্লবের অনেক আগেই আওয়ামী লীগের নেতারা, স্বৈরাচারের দোসররা, স্বৈরাচারের কী (প্রধান) প্লেয়াররা প্রায়ই বলতেন, ‘এই সরকার যদি কখনও উৎখাত হয়, তাহলে লাখ লাখ লোকের প্রাণ যাবে।‘ সে কারণে সবার মনে একটা ভয় ছিল, বাংলাদেশে লার্জেস স্কেলের কোনো কিলিং হয় কি না? কারণ মানুষের অনেক ক্ষোভ ছিল। গেল ১৫ বছরে স্বৈরাচার তাদের জীবন বিষিয়ে তুলেছিল, তাদের নামে শত শত মামলা দেওয়া হয়েছে। অনেকের ছেলেমেয়েরা সরকারি কোনো চাকরি পায়নি, অনেকে হামলা-মামলার ভয়ে ঘরেই থাকতে পারে নাই।
আমাদের ভয় ছিল, এই মানুষগুলো যদি আইন হাতে তুলে নেয়? তবে সেটা হয়নি, সে কারণে অনেককে ক্রেডিট দিতে হবে। এখানে আমাদের ব্যাসিক হিউম্যানিটি প্রকাশ পেয়েছে। আমাদের সমাজের অন্তর্নিহিত একটা শক্তি আছে, সেই শক্তিই সে সময় কাজ করেছে। আপনার ভাই হয়তো আওয়ামী লীগ করে, আপনি হয়তো বিএনপি করেন। সে সময় আপনি আপনার ভাইকে প্রটেক্ট (রক্ষা) করেছেন।
তবে কিছু রিভেঞ্জ কিলিং যে হয়নি তা তো না। সেখানেও রাজনৈতিক দলগুলো তাদের কর্মীদের নিবৃত করেছে। তারা রিভেঞ্জ বা প্রতিশোধ না নিতে নির্দেশনা দিয়েছে। সত্যিকার অর্থে আমি মনে করি, আমাদের স্যোসাইটি অনেক কিছুর ঊর্ধ্বে উঠে দেশকে স্থির করেছে। দেশের যে আলাদা একটা শক্তি আছে, আমাদের মানুষের, সোসাইটির, গ্রামের, পাড়ার, শহরের—সেটাই এখানে কাজে এসেছে।
আপনি দেখেছেন ট্রাফিক পুলিশ নেই, কিন্তু ১৪, ১৫, ১৬ বছরের ছেলেমেয়েরা ঢাকার রাস্তায় ট্রাফিকিং করছে। সরকার কাজ করছে কি না, সেটা প্রথমত ট্রাফিক দেখে বোঝা যায়। তারপর রাতে অনেকেই শহর পাহারা দিয়েছে। এগুলো আমাদের ব্যাসিক ইউম্যানিটি, সেটাই এখানে কাজ করেছে।
ছাত্রদের অনুরোধেই ড. ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হতে রাজি হন। তবে তিনি শর্ত দিয়েছিলেন, ‘আমার কথা যদি না শোনেন, তাহলে আমার প্রয়োজন এখানে নেই, আমাকে বিদায় দেন।‘ গত তিন মাসে অনেকে তাঁর কথা শুনেছেন, অনেকে শোনেনি। ড. ইউনূসের মাঝপথে চলে যাওয়ার কোনো আশঙ্কা আছে? নাকি তিনি যে সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছেন সেটা শেষ করেই যাবেন? কতটা সংকল্প দেখছেন তাঁর মধ্যে?
শফিকুল আলম : আমার মনে হয় উনি যেটা চাচ্ছেন, সেই কাজগুলো হচ্ছে। উনি মনে করেন, ওয়ান্স ইন আ লাইফটাইম দেশটাকে মেরামত করার সুযোগ এসেছে। যে রাষ্ট্র গেল ১৫ বছর একজনের হুকুমের ওপর চলেছে—সে রাষ্ট্র যেন সত্যিকার অর্থে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ হয়, মানুষের যে ডিজায়ার (প্রত্যাশা) আছে, সেটার রিফ্লেক্ট হয়। তাঁর যে অ্যাসপিরেশন, সেটার জন্য প্রফেসর ইউনূস কাজ করে যাচ্ছেন।
প্রথম তিন মাসে আমরা কী কী কাজ করেছি? আমরা ইকোনোমিকে (অর্থনীতি) একটা জায়গায় নিয়ে আসার চেষ্টা করেছি এবং অনেকটা সফল হয়েছি। আপনি রেমিট্যান্সের অবস্থা দেখেন। রেমিট্যান্স প্রচুর আসছে। আরেকটি বিষয়, রিজার্ভ কিছুটা হলেও বাড়ছে, কিন্তু কমছে না।
তারপর প্রফেসর ইউনূস রিফর্মের একটা রোডম্যাপ দিয়েছেন। নির্বাচনের শুধু তারিখ ঘোষণা ছাড়া সবই ঘোষণা দিয়েছেন। সার্চ কমিটি হয়েছে, এই কমিটি একটা নির্বাচন কমিশন করবে। সেখান থেকে নির্বাচনের সব প্রস্তুতি শুরু হবে, ভোটার তালিকা হালনাগাদ করা হবে।
শেষে দেখেন, প্রধান উপদেষ্টা রিফর্মের একটা রোডম্যাপ দিয়েছেন। ছয়টা মেজর রিফর্ম কমিশন করেছেন। এই ছয়টা রিফর্ম দেশ মেরামতের সঙ্গে জড়িত। সেটার জন্যও সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে। তারা ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে রিপোর্ট দেবে। রিপোর্ট পাওয়ার পর সরকার আবার পলিটিক্যাল পার্টি, স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে কথা বলবে। সবার সঙ্গে কথা বলার পর আমরা জানতে পারব, কী কী রিফর্ম হচ্ছে?
আমরা আশা করি, এই রিফর্মের মাধ্যমে দেশটাকে অনেক ক্ষেত্রে মেরামত করা যাবে। এই মেরামতের উদ্দেশ্য কী? যাতে আপনার ভোট কেউ চুরি করতে না পারে, আপনি যে রাজনৈতিক দলকে নির্বাচিত করতে চান, সেটা যেন করতে পারেন। আপনি যেন আদালতে ন্যায়বিচার পান, পুলিশ যেন জনবান্ধব হয়, আপনাকে যেন এক্সট্রা জুডিশিয়াল কিলিংয়ের শিকার হতে না হয়। আর পাঁচ বছর পরপর নির্বাচন নিয়ে যেন টেনশন না থাকে, ক্ষমতা হস্তান্তর যেন স্মুথলি হয়। আমরা এগুলো অ্যাড্রেস করার চেষ্টা করছি।
প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, দেশের সব প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়েছে। যেখানেই তিনি হাত দেন সেখানেই দুরবস্থা দেখেন। এত জঞ্জাল এত অল্প সময়ে তিনি কীভাবে পরিষ্কার করবেন?
শফিকুল আলম : চেষ্টা তো করছেন। এক, তিনি রিফর্ম করেছেন। আরেকটা হচ্ছে, উনি রাইট পরসনকে (সঠিক ব্যক্তিকে) আনছেন। যে লোকটা যে কাজ জানেন এমন লোককে আনা হচ্ছে। আগে তো প্রতিষ্ঠান বলতে কিছু ছিল না। যেমন সেন্ট্রাল ব্যাংকের কথাই ধরেন। আপনি যদি একজন চোরকে দায়িত্ব দেন, নিজেও চুরি করবে, আবার পুরো ইনস্টিটিউশন করবে। এবং তাদের অধীনে থাকা সব ব্যাংককে চুরি করতে বাধ্য করবে।
ড. ইউনূসের ক্ষুদ্রঋণ ও সামাজিক ব্যবসার ধারণা বিশ্বের অনেক দেশ গ্রহণ করেছে। কিন্তু আমাদের দেশের সাবেক সরকারপ্রধান থেকে শুরু করে কিছু মানুষ সব সময়ই তাঁকে অবজ্ঞা, অপমান করত। তাঁর সম্পর্কে আওয়ামী লীগের এই অবস্থান কেন—সে সম্পর্কে প্রধান উপদেষ্টা আপনাদের সঙ্গে কী কিছু শেয়ার করেছেন?
শফিকুল আলম : আমাদের সবার কাছে এটা একটা মিস্ট্রি (রহস্য)। কেন এটা উনি (শেখ হাসিনা) করলেন? আমরা অনেক কিছু শুনি। তবে প্রফেসর ইউনূস এসব সিলি বিষয় নিয়ে কোনো আলাপই করেন না। সাবেক প্রধানমন্ত্রী যেটা করেছেন, তা ন্যক্কারজনক কাজ, বড় রকমের ছোটলোকি।
প্রফেসর ইউনূস তাঁর কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ নোবেল পেয়েছেন। তাঁকে সবাই সম্মান করেন। পৃথিবীর এমন কোনো দেশ নেই, যেখানে উনি গেস্ট স্পিকার হিসেবে কথা বলেননি। পৃথিবীর সব লিডিং ইউনিভার্সিটিতে ইউনূস সেন্টার আছে। সেখানে তাঁর যে ফিলোসফি, তাঁর যে সোশ্যাল বিজনেসের ধারণা—সেটা নিয়ে কাজ হয়। তাঁর থ্রি-জিরো (তিন শূন্য) যে কনসেপ্ট, সেটার জন্য তিনি আমেরিকার সবচেয়ে বড় যে দুটি অ্যাওয়ার্ড সেটাও পেয়েছেন।
ড. ইউনূস অলিম্পিকে নতুন কনসেপ্ট এনেছেন। কীভাবে এই অলিম্পিক গেমসটাকে এনভায়রনমেন্ট ফ্রেন্ডলি করা যায়, যাতে জিরো ওয়েস্ট হয়। অলিম্পিকে তো লাখ লাখ মানুষ আসেন। সেখানে প্রচুর ওয়েস্ট হয়। তাঁর পরামর্শে প্যারিস অলিম্পিকে যে ভেন্যুগুলো করা হয়েছিল থাকার জন্য, সেগুলো এখন গরিব মানুষের মধ্যে দিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
অথচ দেখেন, দেশে তাঁকে পানিতে চুবাতে বলা হয়েছে? ২০০-এর মতো মামলা দিয়ে তাঁকে হেনস্থা করা হয়েছে। গ্রামীণ ব্যাংক উনি নিজের হাতে বড় করছেন, সেটা কেড়ে নেওয়া হয়েছে। তিনি গ্রামীণ ব্যাংকের মালিক না, গ্রামীণ ব্যাংকের তিনি ফাউন্ডার এবং চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি চাচ্ছিলেন গ্রামীণ ব্যাংক বাংলাদেশের টপ ইনস্টিটিউশন হোক। তাঁর অন্য প্রতিষ্ঠানেও থাবা দেওয়ার চেষ্টা চলছিল। ভাগ্য ভালো, স্টুডেন্টরা দাঁড়িয়েছে, বিপ্লব করেছে। আমরা দেশটাকে ফিরে পেয়েছি।
আমি তো দেখছি উনি (ড. ইউনূস) দারুণ একজন নেতা। দেশের প্রতি উনার যে মমত্ববোধ, সেটা অসাধারণ। এই বয়সে উনি যে পরিমাণ কাজের চাপ নেন, ভাবাই যায় না।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে পতন হয় স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের। এই আন্দোলনে ভ্যানগার্ড হিসেবে কাজ করেছিল শিক্ষার্থীরা, বিশেষ করে ‘জেন-জি’ প্রজন্ম। তারা নতুন এক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখিয়েছে মানুষকে। জুলাই বিপ্লবের চেতনা কতটুকু সফলতার পথে?
শফিকুল আলম : আমার মনে হয় তাদের চাওয়া অনুযায়ী কাজ হচ্ছে। আপনি বলতে পারেন এটা কি স্লো হচ্ছে? আমি তো মনে করি স্লো হচ্ছে না। কারণ, আমরা দুটো কাজ একসঙ্গে করছি। প্রথমত, আমাদের ডে টু ডে কাজ করতে হচ্ছে। যেমন, বন্যার্তদের পাশে দাঁড়ানো, প্রতি মুহূর্তে যে সব ক্রাইসিস হয়, সেটা ওভারকাম করা, দ্রব্যমূল্য বাড়লে সেটার ব্যবস্থা নেওয়া। তারপর, বড় কাজ রাষ্ট্র মেরামত করা। কমিশনগুলো কাজ করছে। রাইট পার্সনকে রাইট জায়গায় দেওয়া হচ্ছে। আমরা যথেষ্ট সিনসিয়ারলি কাজ করছি। তবে একটা রাষ্ট্র একদিনে মেরামত হয় না, সময় লাগে।
জুলাই বিপ্লবের স্পিরিট ধরে রাখতে আপনাদের পরিকল্পনা কী?
শফিকুল আলম : পত্রিকাগুলো এখনও লিখছে। জুলাই বিপ্লব যারা সফল করেছেন, তাদের নিয়ে লিখছে। কী ধরনের বর্বরতা হয়েছে, পতিত সরকারের কী ভূমিকা ছিল, পুলিশ কী কী করেছে, সেগুলো নিয়ে প্রতিদিনই কিছু না কিছু লেখা হচ্ছে।
সরকারের তরফ থেকে জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন করা হচ্ছে। ওটার মাধ্যমেই আমরা ক্ষতিগ্রস্ত ফ্যামিলিগুলোর পাশে দাঁড়াচ্ছি। একই সঙ্গে আমরা চেষ্টা করছি, এই কাজগুলোকে কীভাবে ধরে রাখা যায়। সেজন্য গণভবনে একটা স্মৃতি জাদুঘর করা হচ্ছে। গণভবন মানুষকে ক্ষতি করার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সেই জায়গায় আমরা মিউজিয়াম করে গণভবনকে সবার কাছে ফেরত দেব। মানুষ দেখবে, গত ১৫ বছরে কী হয়েছে? যে আন্দোলন হয়েছে, সেই আন্দোলনের নানা স্মারকচিহ্ন সেখানে থাকবে।
গত জানুয়ারির নির্বাচনের পর আমরা হাল ছেড়ে দিয়েছিলাম, ভেবেছিলাম ৫০ বছরেও বুঝি স্বৈরাচার নড়বে না। সেখানে দেখেন তারা যে আত্মত্যাগ করল, সেজন্য তাদের সব সময় স্মরণ করা উচিত। এটা গণমাদ্যমে বলেন, প্রাইভেটলি বলেন, আর পাবলিকলিই বলেন—সবারই উচিত তাদের সাহসিকতাকে স্মরণ করা।
এই আন্দোলনে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ভূমিকা ছিল দুঃসাহসিক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের যখন গণপ্রেপ্তার করা হচ্ছিল, মারধর করে তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, তখন এগিয়ে এসেছিল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। কিন্তু পরবর্তী সময়ে দেখা গেল সরকারে তাদের কোনো প্রতিনিধিত্ব বা ভয়েস নেই। কেন এমন হলো?
শফিকুল আলম : আমার তা মনে হয় না। প্রফেসর ইউনূস নিউইয়র্কে গেলেন, তখন তো ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আয়েশা সিদ্দিকা তিথি আমাদের সঙ্গে গিয়েছিলেন। তিনি ফ্যান্ট্যাস্টিক লিডার। তারপর গুমের ওপর যে কমিশন হয়েছে, সেখানেও ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির একজন শিক্ষক আছেন। বিভিন্ন সরিসরে তাঁদের সংযুক্ত করা হচ্ছে। গঠন করা কমিশনগুলোতেও কাউকে কাউকে দেওয়া হচ্ছে বা হবে। তাদের কথা তো কেউ বলছে না।
যেহেতু নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ বা মাহফুজ আলম সরকারে আছেন, সেজন্য তাঁদের রিপ্রেজেন্টেশনটা বেশি দেখা যাচ্ছে। তবে এখন যে বৈষম্যবিরোধী কমিটি হয়েছে, সেখানে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যোলয়ের এক শিক্ষার্থী দায়িত্ব পালন করছেন। আস্তে আস্তে সবাইকে ইনক্লুড করা হচ্ছে। আমরা মনে করি না যে, তাদের প্রতি অবিচার হচ্ছে।
সমন্বয়কদের কেউ কেউ সরকারের সমালোচনা করছেন? তাদের মধ্যেও কি সমন্বয়হীনতা কাজ করছে?
শফিকুল আলম : রেভুলিউশন একটা ব্যাপার, পোস্ট রেভুলিউশন আরেকটা ব্যাপার। রেভুলিউশনে আমাদের শত্রু ছিলেন একজন, শেখ হাসিনা। ডিক্টেটর। এখন আপনি সরকারের কাছে যে গতিতে কাজ চাচ্ছেন, সেটা হয়তো সেভাবে হচ্ছে না। একটা কাজ তো অনেকে অনেকভাবে করে। আমরা একভাবে ভাবি, আর আপনি ভাবছেন কাজটা হয়তো অন্যভাবে হওয়া উচিত। সেটা নিয়ে সমালোচনা হতে পারে এবং যেকোনো সমালোচনাকে আমরা ওয়েলকাম করি। কিন্তু সমালোচনা মানে এই না যে বিভক্তি এসে গেছে।
স্যার (ড. ইউনূস) কিন্তু একটা কথা বলেন। আমরা বড় একটা ফ্যামিলি। এই ফ্যামিলির মধ্যে অনেক ভিন্নমত থাকবে। মাঝেমধ্যে ক্ষুদ্র ঝগড়া হবে, কথা কাটাকাটি হবে। কিন্তু, দিন শেষে আমরা জানি আমরা সবাই ফ্যামিলির পার্ট।
বিপ্লবের পরই প্রতিবিপ্লব আসে। আপনারা দায়িত্ব নেওয়ার পর এমন কোনো চেষ্টা হয়েছিল কিংবা এখনও কি সে চেষ্টা চলছে?
শফিকুল আলম : আমার তা মনে হয় না। মূল কথা হলো, আপনি কাজটা ঠিক করছেন কি না? আমরা মনে করি, কাজটা ঠিকমতোই করছি। সোসাইটি যথেষ্ট স্ট্যাবিলাইজড। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আমরা বলব এখন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে। রিফর্মগুলোর প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। মানুষের প্রত্যাশা অনেক বেশি। মানুষ দ্রব্যমূল্য নিয়ে চিন্তিত, কিন্তু এখন জিনিসপত্রের দাম কমছে। সবাই দেখছে, এই সরকার কাজ করছে, দেশকে এগিয়ে নিচ্ছে। এ কারণে প্রতিবিপ্লবের কোনো আশঙ্কাই আমরা করছি না।
আরেকটা বিষয়, জাতিসংঘের অধিবেশনে গিয়ে আমরা দেখেছি, প্রফেসর ইউনূসের প্রতি অসম্ভব সাপোর্ট। পুরো পৃথিবী তাঁকে সাপোর্ট দিচ্ছে। উনি তো ডেলিভার করছেন, প্রতিদিনই কিছু না কিছু কাজ হচ্ছে। আরেকটি বিষয়, আমরা কিন্তু ভীতির পরিবেশ তৈরি করছি না, নতুন সরকার এলে সাধারণত এমনটা করা হয়। আমরা কাউকে বলছি না, আমাদের বিরুদ্ধে লিখবেন না। আমরা গণমাধ্যমকে বলেছি, আপনারা লিখুন, আমাদের ফেয়ার সমালোচনা করুন, কোনো অসুবিধা নাই।
শেখ হাসিনা গত ১৫ বছরে সরকার এবং রাষ্ট্রকে একাকার করে ফেলেছিলেন। সরকারের বিরোধিতা বা সমালোচনাকে রাষ্ট্রের বিরোধিতা হিসেবে রূপ দিয়েছেন। প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করেছেন, ব্যাংক লুট করেছেন, হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করেছেন? ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, পরে সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট করে মানুষের কথা বলার অধিকার হরণ করেছেন। দেশটাকে আপাদমস্তক একটি দুর্নীতিতে ডুবিয়ে রেখে গেছেন। এই অবস্থা থেকে বের হওয়ার উপায় কী?
শফিকুল আলম : কুইক রাস্তা কী আছে আমি জানি না। তবে আমাদের তরফ থেকে বলতে পারি, রাস্তা একটাই। প্রত্যেকটা প্রতিষ্ঠানকে পুনরায় মেরামত করা এবং সেই লক্ষ্যে এই রিফর্মগুলো হচ্ছে। প্রথমে ছয়টা রিফর্ম কমিশন করা হলো। পরে আরও চারটা করা হলো। আগামীতে আরও হবে। আমরা আশাবাদী, প্রত্যেকটা কমিশন যখন রিপোর্ট দেবে, তখন যদি আমরা রিফর্মগুলো ক্যারিআউট করতে পারি, বাস্তবায়ন করতে পারি, তাহলে আমরা আশা করতে পারি, দেশটা ভালোর দিকে যাবে।
আর পতিত স্বৈরাচারের যদি বলি, শুধু রাষ্ট্র আর দেশ না, একজন ব্যক্তিই (শেখ হাসিনা) রাষ্ট্র হয়ে উঠেছিলেন। উনিই ডিসাইড করতেন, দেশে কী হবে, কোন নিউজটা যাবে, কোথায় ব্রিজ হবে। সবকিছুই হতো একজনের সিদ্ধান্তে।
আপনি যদি দেখেন, কর্ণফুলী ট্যানেল করা হলো, এটার ফিজিবিলিটি স্টাডিও ঠিকমতো করা হয়নি। সেখানে আয় হচ্ছে ১০ লাখ টাকা, আর ব্যয় হচ্ছে ৩৭ লাখ টাকা। এমন বহু প্রজেক্ট তিনি করেছেন, কোনো বাছ-বিচার ছাড়া। একটি পত্রিকাতে রিপোর্ট এসেছে, ৫৮ হাজার কোটি টাকার রেল প্রজেক্ট হয়েছে, সেখানে ট্রেন চলছে মাত্র ২১টি। এই প্রজেক্ট যদি ভবিষ্যতে কাজে না আসে তাহলে আমি কেন করব? এতে টাকার অপচয় হয়েছে, দুর্নীতি হয়েছে। উনারা প্রচুর নুতন নতুন প্রজেক্ট নিতেন। এর মূল কারণ ছিল খরচ বেশি দেখিয়ে টাকা চুরি করা।
প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা কেন রাষ্ট্রের আইন-কানুনের তোয়াক্কা করেননি? শেখ হাসিনার সব অন্যায় কাজের তাঁরা সমর্থন করেছেন?
শফিকুল আলম : ভয়ের রাজত্বে এটা হয়। সত্যিকার অর্থে কেউ কি তাঁর গুণমুগ্ধ হয়ে এই কাজগুলো করেছেন? তারা করেছেন সুবিধা পাওয়ার জন্য, প্রমোশনের জন্য। যিনি করেছেন তিনি জানতেন, তেলবাজি করলে লাভ হবে। একজন সেক্রেটারি কত টাকা বেতন পান? অথচ, আগের সেক্রেটারিরা কারো কারো নিউইয়ার্কেও কয়েকটা বাড়ি পাওয়া যাবে। তাদের ছেলে-মেয়েরা যে সব হোটেলে থেকেছেন, আমরা ছবি দেখেছি; তা চিন্তা করা যায় না। তাদের একদিনের খরচ অনেকের দুই মাসের বেতনের সমান।
শেখ হাসিনা কি দুর্নীতিবাজদের বেশি পছন্দ করতেন? তাদের নিয়েই রাষ্ট্র চালাতে পছন্দ করতেন?
শফিকুল আলম : আমার মনে হয় উনি নিজে বড় রকমের দুর্নীতিবাজ। আবার তিনি দুর্নীতিবাজদের দিয়ে সারাউন্ডেড ছিলেন। এই লোকগুলো তো তাঁর ব্লেসিংয়েই ব্যাংকগুলোকে লুটপাট করেছে। পুরো সময়টা ছিল লুটপাটতন্ত্র। এই লুটপাটতন্ত্রের একদম উপরে ছিলেন তিনি (শেখ হাসিনা)। তিনি নিজেই তো স্বীকার করেছেন, তাঁকে সামনে রেখে একটা পিয়ন ৪০০ কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। চিন্তা করা যায়? আমি এত বছর চাকরি করেও তো এক-দুই কোটি টাকা সঞ্চয় করতে পারিনি।
শেখ হাসিনা ভিন্নমত, সমালোচনা সহ্য করতে পারতেন না। এর কারণ কী মনে হয় আপনার?
শফিকুল আলম : কোনো ডিক্টেটর সমালোচনা সহ্য করতে পারেন না। মনে হতো যে, উনি এই দেশকে ওউন করেন না। উনি নিজেকেও দেশের অন্য কোনো নাগরিকের মতো মনে করেননি। উনার সময় যতগুলো প্রতিষ্ঠান হয়েছে, প্রায় সবই কোনোটা বাবার নামে, কোনোটা তিন ভাইয়ের নামে, নিজের নামে বা তাঁর বোনের নামে। তাঁর পরিবারের বাইরে কেউ নাই।
কিন্তু হঠাৎ করে তো বাংলাদেশের জন্ম হয়নি। তাজউদ্দিন আহমদের ভূমিকা ছিল, সৈয়দ নজরুল ইসলামের রোল ছিল, মাওলানা ভাসানি তো ছিলেন টাওয়ারিং ফিগার। তারও আগে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, যোগেন মণ্ডল বা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। তাঁদের ভূমিকা তো অস্বীকার করা যাবে না। বাংলাদেশ গ্র্যাজুয়ালি একটা প্রসেসের মাধ্যমে এসেছে। কিন্তু শেখ হাসিনার ইতিহাসে এদের কোনো কথা নেই। তাঁর সমস্ত কিছুই আমার আব্বা করেছেন, এর বাইরে আর কিছু নেই।
শেখ হাসিনা কি স্বজন হারানোর বেদনা বোঝেন? নাকি এ কথা বলে শুধু সহানুভূতি পেতে চাইতেন?
শফিকুল আলম : জন হারানোর বেদনা বুঝলে তো উনি এত ভয়ানক হত্যাকাণ্ড চালাতেন না। তিনি যদি সমব্যথী হতেন, তাহলে কি এত বড় ধরণের নারকীয় কর্মকাণ্ড চালাতে পারতেন? তাঁর (শেখ হাসিনা) ১৫ বছরের পুরোটাই ছিল একে মারো, তাকে ধরো, তাদের মিটিং করতে দিও না—এ জাতীয়। সমাবেশ করার কারণে একদিনেই ২৫ হাজার মানুষকে তিনি অ্যারেস্ট করেছেন, ভাবা যায়?
শেখ হাসিনা এমন সব প্রকল্প হাতে নিয়েছিলেন, যেগুলো এখন জনগণের জন্য বোঝা। এসব প্রকল্প থেকে বেরিয়ে আসার উপায় কী?
শফিকুল আলম : এটা থেকে বের হওয়ার তরিকা একটাই, সেটা হচ্ছে গুড গভর্নেন্স। আমাদের প্রত্যেকটা প্রজেক্ট নেওয়ার আগে ভাবতে হবে প্রজেক্টটা আমাদের দরকার আছে কি না। চুরি করার চিন্তা করলে হবে না। এখানে জনগণের ট্যাক্সের টাকা ব্যয় হচ্ছে। সেজন্য দেখতে হবে জনগণের কাজে লাগে কি না। অনেক প্রজেক্ট পর্যালোচনা করা হচ্ছে।
শেখ হাসিনা দেশের অর্থনীতিকে কেমন রেখে গেছেন?
শফিকুল আলম : খুবই ভঙ্গুর। এর চেয়ে খারাপ অবস্থা আর হয় না। লুটপাটে ব্যাংকগুলো থেকে দুই লাখ কোটি টাকা চলে গেছে। আপনি যে মানুষজনকে ঋণ দিবেন, একটা বড় ফ্যাক্টরি বানাবেন সেই টাকা তো তিনি ব্যাংকে রেখে যাননি। বাইরের দেশের সঙ্গে ট্রেড করবেন, সেটারও কোনো অবস্থা রেখে যাননি।
যিনি শেখ হাসিনার প্রতি লয়্যালিটি শো করেছেন, তাঁকে পদে বসিয়েছেন। উনি কে? আওয়ামী লীগের লোক? তাঁকে ওখানে দিতে হবে। উনি কে? ছাত্রলীগ করেন? তাঁকে পদে বসাতে হবে। সেই মানুষটা যোগ্য বা কমপিটেন্ট কি না, সেটা মুখ্য বিষয় ছিল না। মুখ্য বিষয় ছিল, তাঁর ব্লাডে ছাত্রলীগ বা আওয়ামী লীগ জিনিসটা আছে কি না। এ কারণেই প্রতিষ্ঠানগুলো মরে গেছে।
২০০৯ সালে বাংলাদেশের বিদেশি ঋণ ছিল দুই লাখ ৭৬ হাজার ৮৩০ কোটি টাকা। ২০২৪ সালে দাঁড়ায় ১৮ লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকার মতো। এই ঋণ শোধ করা কি সম্ভব?
শফিকুল আলম : ঋণ করাটা খারাপ কিছু না। কিন্তু, দেখতে হবে আমি কি এটা পরিশোধ করতে পারব কি না। আপনার ক্রেডিট কার্ডে লিমিট আছে ৫০ হাজার, কিন্তু আপনার তা দেওয়ার সামর্থ্য নেই। তাহলে তো আর হলো না। আপনার যতটুকু পরিশোধের সামর্থ্য আছে ততটুকুই ঋণ করবেন।
শেখ হাসিনা লাগামহীনভাবে ঋণ করেছেন। তাঁর মনেই হয়নি এটা বাংলাদেশের পক্ষে আদৌ পরিশোধ করা সম্ভব কি না। উনি তো খুব দ্রুত একটা হেলিকপ্টারে করে ভারতে চলে গেলেন। কিন্তু এই পুরো ঋণ বাংলাদেশের মানুষের ঘাড়ে রেখে গেছেন। আপনি যদি ঋণ পরিশোধ না করেন তাহলে দেশে কোনো ফরেন ইনভেস্ট আসবে না, কেউ বাংলাদেশের সঙ্গে ট্রেড করবে না। সেই জায়গাটাই আমাদের বড় চিন্তার বিষয়।
অন্তর্বর্তী সরকারও বিশ্বব্যাংক থেকে তিন বিলিয়ন, এডিবি থেকে দুই বিলিয়ন ডলার ঋণ পাওয়ার আশ্বাস পেয়েছে। যদিও আপনারা আট বিলিয়ন ডলার চেয়েছিলেন। এতে ঋণের বোঝা কি আরও বাড়বে না?
শফিকুল আলম : যাদের কাছ থেকে আমরা ঋণ চাচ্ছি, তাদের সুদ হার খুবই স্বল্প। কোনও ক্ষেত্রে ধরেন ০.১%, দক্ষিণ কোরিয়া এই সুদে আমাদের ঋণ দিতে চাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে পে-ব্যাক করা খুব ইজি। ঋণের সুদ হার ১০%-১৫% হয়, তখন তো এটা পরিশোধ করা খুব কষ্টের হবে। আপনাকে যদি কোনো প্রতিষ্ঠান ১% সুদে ১০ লাখ টাকা ঋণ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়, তাহলে তো আপনি নেবেন। কারণ আপনি জানেন এই টাকা দিয়ে অনেক কাজ করতে পারবেন।
অনেক ব্যাংকে টাকা নেই। কীভাবে এই ব্যাংকগুলো চলবে? এই খাতের দুর্নীতিতে সংশ্লিষ্টদের বিচার কীভাবে হবে?
অর্থ পাচারে জড়িত কয়েকটি পরিবার। তাদের কীভাবে শাস্তির আওতায় আনা যায়?
শফিকুল আলম : এটার জন্য এখন সময় দিতে হবে। খেয়াল করলে দেখবেন, এস আলম গ্রুপ অনেক ব্যাংক খালি করে টাকা নিয়ে গেছে। তখন ব্যাংকগুলোর যাঁরা হেফাজতকারী ছিলেন, তাঁরা ভালো রোল প্লে করেননি। তাঁরা জনগণের আমানত নিয়ে গেছেন। যাঁদের আমানত সুরক্ষা দেওয়ার কথা ছিল, তাঁরা দায়িত্ব পালন করেননি। আমরা এই সেক্টরে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছি। তবে এটা খুব ধীরগতির একটি প্রক্রিয়া। ধরুন, কেউ ক্যানসারে আক্রান্ত হলে, অনেক চিকিৎসা, ক্যামোথেরাপি নিয়ে তিনি ভালো হন। একই অবস্থা হয়েছে এই ব্যাংকগুলোর। তবে আমাদের চেষ্টার কমতি নেই।
বিগত সরকারের লুটপাটসহ নানা বিষয়ে বিক্ষিপ্তভাবে জানতে পারছি। অন্তর্বর্তী সরকার কেন একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করছে না?
শফিকুল আলম : ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য এ বিষয়ে কাজ করছেন। তিনি একজন সম্মানিত নাগরিক। বাংলাদেশের বড় একজন অর্থনীতিবিদ। তিনি সিপিডির প্রধান ছিলেন। এখন সিপিডির ডিস্টিংগুইসড ফেলো। তাঁর নেতৃত্বে একটি শক্তিশালী কমিটি হয়েছে। সেখানে অনেক অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞ আছেন। তাঁরা প্রত্যেকটি জায়গায় যাচ্ছেন এবং কথা বলছেন। মনে রাখতে হবে বাংলাদেশটা ছোট দেশ না, ১৮ কোটি মানুষের দেশ। এই কমিটি পুরো হোয়াইট পেপার তৈরি করবে। তাদের কাজ শেষ হলে পুরো বাংলাদেশের মানুষ দেখবে, গত ১৫ বছরে কী কী হয়েছিল?
সম্প্রতি শেয়ারবাজারে বড় পতন আমরা লক্ষ করেছি? এখানে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে সরকার কী পদক্ষেপ নিচ্ছে?
শফিকুল আলম : আগে শেয়ারবাজার চলত খেয়ালখুশি মতো। পতিত সরকারে অলিগার্গরা যেটা চাইতেন সে অনুযায়ী রেগুলেশন করা হতো এবং সিদ্ধান্ত নেওয়া হতো। এখন আমরা বাজারের ওপর ছেড়ে দিচ্ছি এবং বাজারই সিদ্ধান্ত নেবে। বিদেশে একটা শেয়ারবাজার যেভাবে অপারেট করা হয়, এখানেও সেভাবেই অপারেট করা হবে। আমরা বাজারের শৃঙ্খলা আনতে চাচ্ছি। এতে সাময়িক কিছু সমস্যা হয়েছে, এটা অস্বীকার করছি না। দেশের অর্থনীতি ভালো জায়গায় ফিরলে শেয়ারবাজারও ভালো হবে।
বিগত সরকারের পররাষ্ট্রনীতি কেমন ছিল?
শফিকুল আলম : সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে শত্রুতা নয়—এটা শেখ হাসিনা বলতেন, কিন্তু আসলে তার সঙ্গে ভারতের বন্ধুত্ব বেশি ছিল। বাকি দেশগুলোর মধ্যে চীনকে কিছুটা কেয়ার করতেন। শেখ হাসিনার পররাষ্ট্রনীতি এটা আসলে একটা ভেলকিভাজি। তিনি সব সময়ই ভারতের তোষণ করেছেন। খেয়াল করলে দেখবেন, ভারতকে আমরা এত কিছু দিয়েছি, ট্রানজিট সুবিধা দিয়েছি, অনেক ধরনের শুল্ক সুবিধা দিয়েছি। কিন্তু সে অনুযায়ী আমরা কী পেয়েছি?
শেখ হাসিনা ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক অনেকটা পার্সোনাল (ব্যক্তিগত) পর্যায়ে নিয়ে গেছেন। ভারত বাংলাদেশকে চিনত না, শেখ হাসিনাকে চিনত। ফলে একটি সরকার যখন স্বৈরাচারে রূপ নিল, এতগুলো খুন, গুম করল, এত মানুষকে পঙ্গু করল, এত মানুষ চোখ হারালো। সেই পতিত সরকারপ্রধানকেই ভারত আবার আশ্রয় দিল।
ভারত সারাজীবন আমাদের প্রতিবেশী থাকবে। প্রতিবেশী তো পরিবর্তন করা যাবে না। কাজেই আমরা তাদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক চাই। এই সম্পর্ক হবে অংশীদারি ও স্বচ্ছতার ভিত্তিতে। অন্যান্য দেশের সঙ্গেও আমরা ভালো সম্পর্ক চাই। যুক্তরাষ্ট্র, চীনের সঙ্গেও সম্পর্ক ভালো চাই।
বর্তমানে জিও পলিটিক্সে অনেক পরিবর্তন আসছে। চীন শক্তিশালী হচ্ছে। ব্রিকস নেশনগুলো শক্তিশালী হচ্ছে। এজন্য আমরা সবার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক চাই। যার সঙ্গে বাণিজ্য বেশি করা যাবে, তার সঙ্গে সম্পর্ক আরও উন্নত করতে চাই। আমাদের ফোকাস হচ্ছে– বাংলাদেশের ইন্টারেস্টটা যেন আগে আসে। আমার ইন্টারেস্ট যেন অগ্রাধিকার পায়—সে অনুযায়ী আমাদের ফরেন পলিসি সাজিয়েছেন প্রফেসর ইউনূস।
যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাইকে ‘দুই আনার মন্ত্রী’ বলেছিলেন বর্ষীয়ান আওয়ামী লীগনেতা সৈয়দ আশরাফ। তিনি তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনাকে কাজের বেটি মর্জিনা বলেছিলেন। ২০১৮ সালে আরেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাটের গাড়িবহরে হামলা হয়। সর্বশেষ ‘মায়ের ডাকের’ একটি অনুষ্ঠানে ‘মায়ের কান্না’ নামে একটি সংগঠনের ঘেরাওয়ের শিকার হন। মার্কিন সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের সঙ্গে বিগত সরকারের এই আচরণের কূটনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
শফিকুল আলম : যুক্তরাষ্ট্র আমাদের বড় ট্রেড পার্টনার (বাণিজ্য সহযোগী)। আমাদের বিগেস্ট এক্সপোর্ট ডেস্টিনেশন। এখন তাদের সঙ্গে এ ধরনের আচরণ করাটা কি খুব ভালো দেখায়? বিশ্বব্যাপী কি আমার বীরত্ব প্রকাশ পায়? এখানে তো বীরত্বের কিছু নেই। আসলে বড় একটি রাষ্ট্রের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কে সস্তা পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল পতিত সরকার।
গুম, খুন, বিরোধীদলের ওপর দমন-পীড়ন, ভোটারবিহীন নির্বাচন, দুর্নীতি, মানবাধিকার লঙ্ঘন ইত্যাদি ইস্যুতে ইউরোপসহ পশ্চিমা বিশ্ব এক প্রকার নিশ্চুপই ছিল গত ১৫ বছর। কেন তারা সরব ছিল না বলে মনে করেন?
শফিকুল আলম : তারা তো সারা বিশ্বে গণতন্ত্রের কথা বলে, রুল অব ল’য়ের কথা বলে। কিন্তু শেখ হাসিনা পরপর তিনটা নির্বাচন যেভাবে করে দেখালেন, সেই অনুযায়ী প্রতিক্রিয়াগুলো খুব নিঃশব্দ ছিল। বাংলাদেশের জনগণ তাদের দিকে তাকিয়ে ছিল। ভেবেছিল তাদের পাশে পাবে। কিন্তু তারা মনে করেছে, এই সরকারকে কেউ সরাতে পারবে না। অনেকে ভেবেছে, এই সরকার ভারতের ভালো বন্ধু। ভারতকে রাগানো যাবে না। এ কারণে তারা ওই সময় বাংলাদেশের জনগণের কাছ থেকে সম্মান হারিয়েছিল।
প্রধান উপদেষ্টা দায়িত্ব নেওয়ার আগেই ভারতকে একটি বার্তা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশ অস্থিতিশীল করা হলে, সেভেন সিস্টার্সসহ আশপাশের দেশ বিশেষ করে মিয়ানমার ও অন্যান্য দেশ অস্থিতিশীল হবে? এর মাধ্যমে তিনি কি ভারতের প্রতি আমাদের নতজানু নীতি থেকে বেরিয়ে আসার ইঙ্গিত দিয়েছেন? অন্তর্বর্তী সরকার কি তা করতে পেরেছে?
শফিকুল আলম : আমাদের কোনো নতজানু নীতি নেই। ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক হবে অংশীদারি ও সমতার ভিত্তিতে। পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ থাকবে। আপনি আমাকে শ্রদ্ধা করবেন, আমি আপনাকে শ্রদ্ধা করব।
ভারতের সঙ্গে আমাদের আমদানি-রপ্তানির সম্পর্ক রয়েছে। উভয় দেশের স্বার্থেই ভালো একটি বাণিজ্য সম্পর্ক রাখা দরকার। আমাদের দেশের অনেকের আত্মীয় ওপারে আছে, আবার তাদেরও আত্মীয়-স্বজন আমাদের দেশে আছে। আমরা চাই উভয়ের সঙ্গে একটি পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ থাকুক।
সারা-জীবন মনে রাখার মতো ভারতকে কী দিয়েছেন শেখ হাসিনা?
শফিকুল আলম : আমরা এত বছর ধরে তিস্তা নদীর পানি বণ্টনের জন্য চুক্তির চেষ্টা করছি। আমরা পেয়েছি? ফেনী নদীর পানি পেয়েছি? আমরা যেগুলো চাই, এগুলো কয়টা আমরা পেয়েছি? অন্যদিকে, আমরা শুনেছি ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন করে উত্তর-পূর্ব ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন উলফা নেতা অনুপ চেটিয়াসহ বিদ্রোহী নেতাদের তাদের দেশে ফিরিয়ে নিয়ে গেছে। ভারত সেভেন সিস্টার্সকে স্ট্যাবিলাইজ বা স্থিতিশীল করার জন্য যা যা করার দরকার শেখ হাসিনা করেছেন। কিন্তু, বিনিময়ে আমরা কি তিস্তার পানি পেয়েছি? এই পানির কারণে উত্তরবঙ্গ বিশেষ করে রংপুর কষ্টের মধ্যে থাকে।
ভারতের সঙ্গে অভিন্ন অনেক নদী রয়েছে। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ নদীর ওপর বাঁধ দিয়ে পানি প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করছে ভারত। কীভাবে এর সমাধান হতে পারে?
শফিকুল আলম : আন্তর্জাতিকভাবে এই পানিগুলো পাওয়া আসলে কঠিন। আমরা চিঠিপত্র দ্বারা কীভাবে সমাধান করা যায়, চেষ্টা করছি। অংশীদারি ও সমতার ভিত্তিতে চুক্তি করে সমাধান করতে পারলেই সবচেয়ে ভালো। তার পরও যদি কাজ না হয়, তাহলে অন্তর্বর্তী সরকার দেখবে পরবর্তী সময়ে কী করা যায়।
ভারতের গণমাধ্যম বাংলাদেশ এবং এ দেশের জনগণ নিয়ে নেতিবাচক প্রচারণা চালাচ্ছে? এই অপপ্রচার রোধে আপনারা কী করছেন?
শফিকুল আলম : তাদের গণমাধ্যমে প্রচুর ভুল ও বিকৃত তথ্য ছিল। এটাকে মোকাবিলা করার একমাত্র উপায় হলো, আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে আপনার নিউজ ফ্লাডেড করা। আমাদের প্রথম থেকেই পরিকল্পনা ছিল, যেসব বিদেশি সাংবাদিক বাংলাদেশ নিয়ে কাজ করতে চান, তাদের খুব দ্রুত ভিসা দেওয়া। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এক থেকে দুই ঘণ্টার মধ্যে আমরা ভিসা দিয়েছি। উনাদের বলেছি আপনারা এসে দেশে প্রতিবেদন করে যান। অনেকে সাড়া দিয়েছেন। তারা এসে দেখেছেন বাস্তবতা কতটুকু।
নেত্র নিউজ নয়জনের মৃত্যু নিয়ে একটি প্রতিবেদন করেছে। বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ বলেছিল নয়জন মারা গেছেন। কিন্তু নেত্র নিউজের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তাদের মৃত্যুর সঙ্গে ধর্মীয় কোনো ইস্যু ছিল না। নেত্র নিউজ প্রত্যেকটি লোকের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেছে। ঘটনা যেখানে ঘটেছে, সেখানকার প্রত্যক্ষদর্শীর সঙ্গে কথা বলে তারা জেনেছে, হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের প্রতিবেদনটি মিথ্যায় ভরপুর।
বর্ডার কিলিংয়ে সবচেয়ে নিকৃষ্ট উদাহরণ হয়তো বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত—এর সমাধান কীভাবে করছে অন্তর্বর্তী সরকার?
শফিকুল আলম : সীমান্ত হত্যা শূন্যের কোটায় নামিয়ে ফেলা সম্ভব হয়নি। গেল মাসেও সীমান্ত হত্যা হয়েছে। তার আগেও কিছু কিছু সীমান্ত হত্যা হয়েছে। এটা দুর্ভাগ্যজনক। কেউ সীমান্ত অতিক্রম করলে তাকে আটক করা যায়, তার বিচার করা যায়। মৃত্যু তো কারো কাম্য নয়। আমরা এই হত্যার ক্ষেত্রে দৃঢ়ভাবে প্রতিবাদ করেছি। আমরা বলেছি, এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার সমাপ্তি হওয়া উচিত।
অন্যান্য সব প্রতিষ্ঠানের মতোই শেখ হাসিনা আইনশৃঙ্খলাবাহিনী বিশেষ করে পুলিশ বাহিনীকে প্রায় ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে ঠেলে দিয়েছেন। তারা নির্বিকারভাবে মানুষ হত্যা করেছে? লাশ পুড়িয়েছে, গুম করেছে? এই বাহিনীকে কীভাবে ঢেলে সাজানো যেতে পারে?
শফিকুল আলম : এটার জন্যই তো পুলিশ কশিমন করে দেওয়া হয়েছে। কমিশন কাজ করছে। কমিশনের মধ্যে আমরা অনেক এক্সপার্ট রেখেছি। সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা রেখেছি, যারা বাংলাদেশের ক্রাইমের প্যাটার্নটা জানেন। আর পুলিশ মানেই তো ক্রাইম না। সেখানে আইনের ব্যাপার আছে। যারা আইন বোঝেন, ক্রিমিনাল জাস্টিস সিস্টেম সম্পর্কে জানেন, তাদেরও রাখা হয়েছে। আমরা চাচ্ছি, পুলিশ জনগণের বন্ধু হোক। পুলিশ যেন আর অত্যাচারের টুল হতে না পারে। আমাদের পক্ষ থেকে পুলিশকে দিয়ে কোনো পলিটিক্যাল কাজ করাচ্ছি না।
আন্দোলনে পুলিশ বাড়াবাড়ি করেছে, ক্ষমতার অপব্যবহার করেছে—এটা সত্য, কিন্তু পুলিশের সদস্যরাও তো নিহত হয়েছেন। এই সংখ্যাটা আসলে কত?
শফিকুল আলম : আমরা এটা নিয়ে স্টেটমেন্ট দিয়েছি। পুলিশের মোট ৪৪ জন মারা গেছেন। আপনাদের যদি যদি মনে হয়, এই সংখ্যাটা আরও বেশি, তাহলে আমাদের সঙ্গে কনট্রাক্ট করতে পারেন, আমাদের তালিকা দিতে পারেন।
আরেকটি বিষয়, পুলিশ জনরোষে পড়েছিল। আপনারা যদি জুলাই-আগস্টের ভিডিওগুলো দেখেন, দেখবেন মানুষ হেঁটে যাচ্ছে, উনারা কাছ থেকে গুলি করেছে, নির্বাচারে হত্যা করেছে। এই জনরোষ অনেক জায়গায় হয়েছে।
আন্তর্জাতিক একটি প্রতিষ্ঠানের তৈরি করা ১৫ মিনিটের একটি ভিডিও আমি দেখেছি। শুধু যাত্রাবাড়ী থানার সামনে যে কিলিংটা হয়েছে, তাদের মধ্যে ১৮ জনের নাম তারা খুঁজে বের করেছে। তারা কয়েক শ ভিডিও সংগ্রহ করে ১৫ মিনিটের ভিডিওটি বানিয়েছে। এ ভিডিওতে আপনি দেখবেন, পুলিশ কী নির্মমভাবে সাধারণ মানুষকে গুলি করে মেরেছে। এবং কখন মেরেছে? ৫ আগস্ট, ততক্ষণে হয়তো শেখ হাসিনা পালিয়েও গেছেন। উনারা জনরোষে পড়ে হত্যার শিকার হয়েছেন। তার পরও আমরা বলি, এ ধরনের হত্যাকাণ্ড ঠিক না।
আন্দোলনে নিহত অনেকের শরীরে ৭.৬২ গুলি পাওয়া গেছে, যা আমাদের পুলিশ বাহিনী ব্যবহার করে না। এই বুলেট কোথা থেকে এলো? আপনারা কি অনুসন্ধান করেছেন এবং কিছু পেয়েছেন?
শফিকুল আলম : এটাও পুলিশ এবং সিকিউরিটি ফোর্স দেখছে।
পুলিশের অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী এখনও কর্মস্থলে যোগ দেননি। এই সংখ্যাটা কত? তাঁরা কোথায়?
শফিকুল আলম : আমরা একটি ফিগার দিয়েছি, মোট ১৮৭ জনের মতো। উনারা যে ধরনের অ্যাট্রোসিটি করেছেন, তাঁরা জানেন ডিউটিতে গেলে উনারা প্রসিকিউটেড (বিচারের মুখোমুখি) হতে পারেন। যে পরিমাণ হত্যা হয়েছে, তা তো করেছে মূলত পুলিশ। পলিটিক্যাল অর্ডারে তারা এটা করেছে। আর অর্ডারটা এসেছে সিনিয়র পুলিশ অফিসারদের কাছ থেকে। সে সময় উনারা পলিটিক্যাল লিডারদের মতো কথা বলতেন। তাঁরা তাঁদের পলিটিক্যাল মাস্টারকে খুশি করতে চেয়েছেন। এখন হয়তো বিচারের ভয়ে কাজে যোগ দিচ্ছেন না।
অন্তর্বর্তী সরকার অনেক সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে। তারা কি সংস্কারগুলো বাস্তবায়ন করতে পারবে? পরবর্তী সরকার যেন এসব সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়ন করে—সেজন্য আপনাদের কী আহ্বান থাকবে?
শফিকুল আলম : এটা নিয়ে পলিটিক্যাল পার্টিগুলোর সঙ্গে কনসালটেশন হবে। তখন উনারাই বলবে, কোন সংস্কারগুলো এখন করা যাবে, আর কোন সংস্কারগুলো পলিটিক্যাল পার্টি ক্ষমতায় এসে করবে। সেটা নিয়ে আলোচনা হবে। তবে মনে রাখতে হবে, এই আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য ছিল রাষ্ট্র মেরামত। উনারা যদি মেরামত না করতে চান, তাহলে আমার ধারণা, মানুষ আবার পথে নামবে।
আপনারা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে একাধিকবার বসেছেন? এসব বৈঠক কি ফলপ্রসূ হচ্ছে?
শফিকুল আলম : আমরা আশাবাদী, তারা আমাদের সংস্কার পার্টনার। মানুষের যেটা ডিজায়ার বা প্রত্যাশা সেটা তারা ক্ষমতায় গেলেও রিফ্লেকটেড হবে।
কয়েকটি রাজনৈতিক দল, বিরাজনীতিকীকরণের আশঙ্কা করছে? সত্যিই এমন কোনো আশঙ্কা আছে কি?
শফিকুল আলম : এমন কোনো আশঙ্কা নেই। অন্তর্বর্তী সরকারের বিভিন্ন দায়িত্বে এখন যাঁরা আছেন তাঁদের কারোই রাজনীতি করার মিনিমাম ইচ্ছে নেই। তারা তাদের নিজ নিজ এরিয়াতে খুবই ভালো। তাঁরা ওখানেই ভালো ছিলেন, আনন্দের সঙ্গে কাজ করতেন। ছাত্র-জনতার ডাকে তাঁরা এসেছেন রাষ্ট্র মেরামতের কাজ করতে। তাঁরা মহৎ একটি দায়িত্ব থেকে এসেছেন।
বিএনপি দ্রুত নির্বাচন দেওয়ার দাবি জানিয়েছে। নির্বাচনের তারিখ কবে ঘোষণা হতে পারে বলে আশা করা যায়?
শফিকুল আলম : নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট তারিখের ব্যাপারে আমরা এখনও সিদ্ধান্ত নেইনি। আমরা রিফর্মের রোডম্যাপ দিয়েছি। কমিশনগুলো কাজ করছে। তারা ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে রিপোর্ট দেবে। ওই রিপোর্টগুলো নিয়ে আমরা পলিটিক্যাল পার্টির সঙ্গে বসব, কনসালটেশন করব। এরপর বুঝব, তারা কতটুকু রিফর্ম চান। তারপর সেগুলো বাস্তবায়ন হবে। রিফর্মগুলো ডিটারমাইন করে দেবে নির্বাচন কখন হবে।
অনেকে অভিযোগ করছে, সরকার জামায়াতে ইসলামীকে একটু বেশি সুবিধা দিচ্ছে। এটা কতটা সত্য?
শফিকুল আলম : জামায়াতে ইসলামীকে ফেবার করে আমরা কোনো ডিসিশন কি নিয়েছি? মানুষের পারসেপশন থাকতেই পারে। কিন্তু আপনি আমাকে দেখান, যে আমরা জামায়াতকে প্লিসড (খুশি) করে কোন ডিসিশনটা নিয়েছি।
প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, বাংলাদেশের রাজনীতিতে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের কোনো অস্তিত্ব নেই। আওয়ামী লীগের জোট জাতীয় পার্টির ব্যাপারেও আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে আপত্তি এসেছে। এ দুটো দল ছাড়াই কি নির্বাচন হবে?
শফিকুল আলম : দুটো পার্টির কাউকে তো আমরা ব্যান (নিষিদ্ধ) করিনি। তবে আওয়ামী লীগ নিয়ে সমস্যাটা দেখেন, এই যে এত বড় একটা হত্যাকাণ্ড তারা করল, সেটার জন্য মিনিমাম অনুশোচনাও তাদের মধ্যে নেই। এক হাজার বা আরও বেশি মানুষকে তারা হত্যা করল, তাদের ভেতরে কোনো ধরনের রিগ্রেড আছে? মনের মধ্যে একটু কষ্ট আছে? তাজউদ্দিন আহমদের মেয়ে শারমিন আহমদও একই কথা বলেছেন। আওয়ামী লীগকে ক্ষমা চাইতে বলেছেন।
আওয়ামী লীগ উল্টো মিথ্যা তথ্য ছড়াচ্ছে যে তিন হাজার পুলিশ মারা গেছে। এটা দিয়ে কি উনারা জাস্টিফাই করতে চান যে, এই মানুষগুলোকে মারা ঠিক ছিল? তিন হাজার পুলিশ মারা হয়েছে, এটা তো ডাহা একটা মিথ্যা কথা। এখন আপনার যদি মনে হয়, এতগুলো পুলিশ মারা হয়েছে, আপনি প্রমাণ দেন, আমরা দেখি। এগুলো করে তারা মানুষের মনকে আরও বিষিয়ে তুলছে।
আমরা আওয়ামী লীগের কার সঙ্গে কথা বলব? মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে দমন করতে গিয়ে আপনি (শেখ হাসিনা) গণহত্যা করেছেন। এরপর আপনি পালিয়ে গেছেন। পালিয়ে যাওয়ার পরও কোনো অনুশোচনা নেই। তাদের কোনো মাঝারি মানের নেতাও তো ক্ষমা চায়নি। একটা-দুইটা লোক হয়তো বলেছেন, এটা ঠিক হয়নি। এমনকি ছাত্রলীগ, যুবলীগ বা তাদের অন্য সংগঠনগুলোর কোনো নেতাকর্মীর কাউকে অনুশোচনা করতে দেখেছেন?
শেখ হাসিনার পলায়নের পর ভারত এ দেশের সংখ্যালঘু বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিয়ে একের পর এক উদ্বেগ জানিয়ে আসছে। আপনাদের হিসাবে কতজন সংখ্যালঘু আক্রান্ত হয়েছে?
শফিকুল আলম : আমরা বলেছি, আইসোলেটেড কিছু ইনডিসেন্ট হয়েছে। কিন্তু ভারতীয় মিডিয়া যেভাবে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখাচ্ছে, সেটা অতিরঞ্জন। আন্তর্জাতিক মিডিয়ার অনেক সাংবাদিক এখানে এসেছেন, ট্রু পিকচারটা কী, সেটা দেখেছেন। এখনও আসছেন। বিবিসি ও ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের সাংবাদিকরা এসে প্রকৃত ঘটনা দেখেছেন।
বাংলাদেশের বড় রপ্তানি খাত পোশাক। আমাদের অর্থনীতির অন্যতম বড় চালিকাশক্তি এই খাত। বর্তমানে শ্রমিক অসন্তোষের নামে অনেক কারখানায় উৎপাদন ব্যহত হচ্ছে। এর সমাধান কীভাবে করছে সরকার?
শফিকুল আলম : আমরা প্রথম থেকেই এটা নিয়ে কনসালটেশনে গিয়েছি। তাদের সঙ্গে কথা বলে, ডায়ালগ করে, ১৮ পয়েন্টের একটি অ্যাগ্রিমেন্টও হয়েছে। সে অনুযায়ী কাজ হচ্ছে। এখন কিন্তু গার্মেন্টসে খুব বেশি প্রোটেস্ট নেই, দুই-তিনটা গার্মেন্টসে সামান্য বিক্ষোভ হচ্ছে। এর কারণ হলো, তাদের অনেকের মালিক পলিটিক্যালি কানেকটেড ছিলেন এবং পালিয়ে গেছেন। তাদের ফ্যাক্টরির লোকজন বেতন ঠিকমতো পাওয়ার জন্য আন্দোলন করছে। অনেক ক্ষেত্রে তারা সরকারকে জোর করছে। কিন্তু কোনো একটি প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানে ইনসেনটিভ দিলে হাজার হাজার ফ্যাক্টরিতেও দেওয়ার প্রশ্নটা উঠবে। আমরা এটাকে সুন্দরভাবে সেটেল করার চেষ্টা করছি।
গার্মেন্টসসহ শিল্প কারখানারগুলো দীর্ঘদিন ধরে গ্যাস সংকটে ভুগছে? এর সমাধান কীভাবে করা যায়?
শফিকুল আলম : গ্যাস সংকটের সমাধান হবে আশা করা যায়। আমরা কাজ করছি।
গার্মেন্টস মালিকরা দেশি ইয়ার্ন কিনলে আগে সরকারের কাছ থেকে ৫ শতাংশ ইনসেনটিভ পেত। এই সরকার সেটা অর্ধেকেরও কম করে দিয়েছে। এখন দেশি সুতার সঙ্গে ভারতীয় সুতার দামের একটি পার্থক্য হয়ে যাচ্ছে এবং তারা দামের কারণে ভারতীয় সুতা কিনতে বাধ্য হচ্ছেন? এ বিষয়ে সরকার কি কোনো পদক্ষেপ নেবে?
শফিকুল আলম : এটাও একটা টেকনিক্যাল বিষয়। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এটা দেখছে।
প্রবাসীরা দেশের জন্য গায়ের রক্ত পানি করে কাজ করে রেমিট্যান্স পাঠায়। দুই কোটির বেশি বাংলাদেশি এখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। তাদের জন্য সরকারের বিশেষ কোনো ভাবনা রয়েছে কি?
শফিকুল আলম : প্রবাসীদের আমরা সব সময় সম্মান জানাই। কারণ তারাই আসলে ইকোনোমির ত্রাণকর্তা। তাঁরা প্রচুর অর্থ পাঠাচ্ছেন। প্রফেসর ইউনূস প্রথমেই যে কাজটি করেছেন, আরব আমিরাতে ৫৭ বাংলাদেশির দণ্ড মাফ করিয়েছেন। সেই দেশের ইতিহাসে এমন নজির কমই আছে। সেই জায়গায় উনি পারসোনালি ফোন করে কাজটি করেছেন। প্রবাসীরা আমাদের হৃদয়ের একেবারে মাঝখানে। তাদের জন্য যতটুকু করার আমরা চেষ্টা করছি। স্বৈরাচারের সময় ১৮ হাজার লোক মালয়েশিয়া যাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু তারা যেতে পারেনি। স্যার এসে পারসোনালি মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীকে বলেছেন। এটা নিয়ে কাজ শুরু হয়ে গেছে।
শেখ হাসিনা সরকারের পতনে বিরাট ভূমিকা রেখেছেন প্রবাসী বাংলাদেশি অ্যাক্টিভিস্টরা। তাঁরা বিগত সরকারের বিভিন্ন দুর্নীতি, কুকর্ম ফাঁস করে বিশাল একটি ভূমিকা রেখেছেন। রাষ্ট্র পুনর্গঠনে তাদের সংযুক্ত করার কোনো পরিকল্পনা আছে কি?
শফিকুল আলম : তাঁরা আমাদের ভালো পরামর্শ দিচ্ছেন। তাঁদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ভালো। তাঁরা যেখানে থাকেন, সেখানে কীভাবে গর্ভনেন্স হয়, তাদের কীভাবে রিফর্মগুলো হয়, সেগুলো নিয়ে তাঁরা আমাদের আরও ভালো দিকনির্দেশনা দিবেন বলে আশা করছি।
স্বাধীন সাংবাদিকতার বিকাশে বিগত সরকার যেসব নিবর্তনমূলক পদক্ষেপ নিয়েছিল, বর্তমান সরকার কি সেই ধারা থেকে বেরিয়ে আসার চিন্তা করছে? ভবিষ্যতেও সাংবাদিকদের সুরক্ষার ব্যাপারে সরকার কী ভাবছে?
শফিকুল আলম : আমরা প্রত্যেকটি কালা-কানুন নিয়ে যাচাই-বাছাই করছি। আইনগুলো থেকে জনগণ বা গণমাধ্যমগুলোকে মুক্ত করার জন্য একটি কমিশন গঠন করা হয়েছে। তারা এটা দেখবে, কোন আইনগুলো থাকবে বা থাকবে না। ইতোমধ্যে আমরা বলেছি, সাইবার সিকিউটিরি অ্যাক্ট থাকছে না। এটা এতই কনট্রোভার্সিয়াল, এতই রিপ্রেসিভ ছিল, যেটাকে আমরা স্ক্র্যাপ করছি।
বিগত সরকারের আমলে বিরোধীদল ও মতের অনেক ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান হাতছাড়া হয়েছে। কাউকে আয়নাঘরে বন্দি করে বা কারাগারে পাঠিয়ে জোর করে তাদের কাছ থেকে প্রতিষ্ঠানগুলো কেড়ে নেওয়া হয়েছে। বঞ্চিত এসব মালিক কীভাবে নিজ নিজ প্রতিষ্ঠান ফেরত পেতে পারেন?
শফিকুল আলম : আমরা চাই সবকিছুতে রুল অব ল বা আইনের শাসন থাকুক। বেআইনিভাবে কেউ যেন কিছু করতে না পারে। আদালতে যেন তাঁরা সুবিচার পান। আমরা আদালতে কোনো ইনফ্লুয়েন্স করছি না। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা অবশ্যই আদালতে সুবিচার পাবেন।
আপনার মতে, গত তিন মাসে অন্তর্বর্তী সরকারের বড় সাফল্য কী?
শফিকুল আলম : আমরা চারটি সাফল্য দেখছি। একটা হচ্ছে, শেখ হাসিনা পালানোর পর স্মুথ একটা ট্রানজেকশন হয়েছে। আমাদের যে ভয় বা আশঙ্কা ছিল যে, হাজার-হাজার, লাখ-লাখ মানুষ মারা যাবে, তার কিছুই হয়নি। আমরা চেষ্টা করেছি, ল অ্যান্ড অর্ডার সিচ্যুয়েশনটাকে দ্রুত কন্ট্রোলে আনতে। এ সময় যতগুলো ক্রাইসিস হয়েছে, আমরা চেষ্টা করেছি দ্রুত ওভারকাম করতে।
দ্বিতীয়ত হচ্ছে, আমরা ম্যাসিভ গ্লোবাল সাপোর্ট পেয়েছি। সবাই আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। আপনি দেখেছেন, জাতিসংঘে লিডার প্রফেসর ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সাপোর্ট দিয়েছেন।
তৃতীয়টা হচ্ছে, আমরা ইকোনোমিকে রিকভার করতে পেরেছি। একটা ভঙ্গুর অর্থনীতি থেকে দেশকে টেনে তোলা খুবই কষ্টসাধ্য ছিল। সেখান থেকে টেনে তুলে আবার গ্রোথের পথে নিয়ে আসছি।
আর চতুর্থ হচ্ছে, রিফর্ম এবং ইলেকশনের একটা রোডম্যাপ আমরা দিয়েছি। দুটোই প্যারালালি চলছে। গত তিন মাসে এই সরকার যা করেছে, আমি তো মনে করি, মানুষের আশার থেকেও বেশি করেছে।
একই সময়ে অন্তর্বর্তী সরকারের সবচেয়ে অতৃপ্তি কী? মানে, তারা করতে চান, কিন্তু পারছেন না?
শফিকুল আলম : আমি তো কোনো অতৃপ্তি দেখি না। হয়তো বা কাজগুলো আরও দ্রুত করলে অনেকে আরও খুশি হতেন। কিছু কিছু ক্রাইসিস না এলে ভালো হতো, কাজটা সহজ হতো। হঠাৎ বন্যাটা যদি না আসত, দ্রব্যমূল্য যদি না বাড়ত, তাহলে হয়তো জনজীবন আরও বেটার হতো।
এনটিভি অনলাইনকে সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
শফিকুল আলম : এনটিভি অনলাইনকেও ধন্যবাদ।