ভয়াবহ বন্যায় পাশে দাঁড়ায় পুরো বাংলাদেশ
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার কয়েক দিনের মধ্যেই মোকাবিলা করতে হয় প্রাকৃতিক দুযোর্গ। ২১ আগস্ট ভারী বর্ষণ এবং ভারত থেকে নেমে আসা ঢলে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। ভারতের ত্রিপুরা প্রদেশ থেকে নেমে আসা ঢল ও টানা কয়েকদিনের ভারী বর্ষণে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়ে ফেনী ও নোয়াখালীসহ দেশের এগারো জেলার ৭৭টি উপজেলা প্লাবিত হয়। শুরুতেই এমন ধাক্কায় সামলাতে অন্তর্বর্তী সরকারের পাশে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে দাঁড়ায় সর্বস্তরের জনতা ও প্রবাসীরা।
প্লাবিত হয় ৭৭ উপজেলার ৫৮৭ ইউনিয়ন
প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের বন্যা নিয়ে সর্বশেষ প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, উল্লিখিত জেলার ৭৭টি উপজেলার ৫৮৭টি ইউনিয়নের মানুষ সরাসরি বন্যার প্রভাবের শিকার হয়েছে। এই মানুষগুলো তাদের ঘরবাড়ি, জীবিকা এবং মৌলিক চাহিদা থেকে বঞ্চিত হয়ে চরম চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়। প্লাবিত এলাকাগুলো বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়ে এবং ক্ষতিগ্রস্তরা মৌলিক সেবাসমূহ থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
বেশি ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চল
ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলগুলোর মধ্যে রয়েছে ফেনী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেট, লক্ষ্মীপুর এবং কক্সবাজার। এই প্রাকৃতিক দুর্যোগ শুধু মানবজীবনকে অবরুদ্ধ করেনি, বরং অর্ধ কোটি মানুষের জীবন-জীবিকা ও কল্যাণকেও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
পানিবন্দিদের জন্য অশ্রয়কেন্দ্র
আক্রান্ত ১১ জেলার ৭৩ উপজেলায় ক্ষতিগ্রস্ত ইউনিয়ন/পৌরসভা ৫২৮টি। এরমধ্যে মোট ১২ লাখ ২৭ হাজার ৫৫৪টি পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়ে। ক্ষতিগ্রস্ত লোকসংখ্যা ৫৮ লাখ ২২ হাজার ৭৩৪ জন। পানিবন্দি ও ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য মোট চার হাজার তিনটি আশ্রয়কেন্দ্র খোলে অন্তর্বর্তী সরকার। অশ্রয়কেন্দ্রগুলোয় মোট পাঁচ লাখ ৪০ হাজার ৫১০ ব্যক্তি ও ৩৯ হাজার ৫৩১ গবাদি পশুকে আশ্রয় দেওয়া হয়।
প্রাণহানি ছিল ৩১
এই বন্যায় ৩১ জনের প্রাণহানি ঘটে, যার মধ্যে কুমিল্লায় ১২ জন, ফেনীতে ২, চট্টগ্রামে ৫, খাগড়াছড়িতে ১, নোয়াখালীতে ৬, ব্রাহ্মণবাড়ীয়ায় ১, লক্ষ্মীপুরে ১ ও কক্সবাজারে ৩ জন মারা গেছেন। মৌলভীবাজারে দুই ব্যক্তি এখনও নিখোঁজ রয়েছেন।
বন্যাপীড়িতদের জন্য দেওয়া হয় স্বাস্থ্যসেবা
সরকার বন্যাপীড়িতদের জরুরি স্বাস্থ্যসেবার জন্য ১১টি জেলায় ৭৭০টি মেডিক্যাল টিম মোতায়েন করে। এই টিমগুলো আহতদের চিকিৎসা, পানিবাহিত রোগের বিস্তার রোধ এবং অন্য প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করতে নিরলসভাবে কাজ করে।
ক্ষতিগ্রস্ত হয় কৃষি খাত
বন্যায় কৃষি খাত মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কারণ ফসল এবং গবাদিপশুর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। এই ক্ষয়ক্ষতির ফলে অনেক পরিবারের আয়ের প্রধান উৎস নষ্ট হয়ে যায়, যা খাদ্যনিরাপত্তার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এ ছাড়া, যোগাযোগ ব্যবস্থা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং অনেক এলাকায় মোবাইল টাওয়ার বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্তরা যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
ত্রাণ প্রচেষ্টায় সশস্ত্র বাহিনী
সশস্ত্র বাহিনী ত্রাণ প্রচেষ্টায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করে এবং খাদ্য ও অন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী বিতরণ করে।
ত্রাণ কর্মসূচি নিয়ে সরকারের পাশে দাঁড়ায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনসহ সর্বস্তরের মানুষ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীরা গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ হাতে নেয়। তারা ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের (টিএসসি) মাধ্যমে ত্রাণ সংগ্রহ কার্যক্রম পরিচালনা করে। এই ত্রাণ সংগ্রহ অভিযানটি বন্যার্তদের জন্য খাদ্য, পানি এবং অন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী সংগ্রহ করতে সহায়ক হয়। এই উদ্যোগের অংশ হিসেবে, ছাত্র আন্দোলনের নেতারা ক্যাম্পাসে বিভিন্ন ধরনের ত্রাণ সামগ্রী সংগ্রহের জন্য বুথ স্থাপন করে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের কাছ থেকে সহায়তা আহ্বান করে। তারা বিভিন্ন দাতা সংস্থা, প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তির মাধ্যমে প্রাপ্ত ত্রাণ সামগ্রী বন্যার্তদের কাছে পৌঁছানোর জন্য পরিকল্পনা নেয়। এই কার্যক্রমটি শুধু ত্রাণ সংগ্রহই নয়, বরং বন্যার্তদের জন্য একটি নৈতিক সমর্থন এবং সহযোগিতার বার্তা প্রদান করে। বন্যার্তদের সহায়তায় বিভিন্ন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা নিজেদের কাজের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান অর্থ, খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি, এবং চিকিৎসা সামগ্রী সরবরাহ করে। স্থানীয় ব্যবসায়ী ও সমাজকর্মীরা নিজেরা কিছু পরিমাণ ত্রাণ সামগ্রী সংগ্রহ করে তা বন্যার্তদের কাছে পৌঁছে দেন। অনেক ব্যক্তি ব্যক্তিগত উদ্যোগে আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে খাদ্য ও পানীয় সরবরাহ করেন, যাদের সহায়তার ফলে অনেক বন্যার্তের খাবারের অভাব মেটানো সম্ভব হয়। এ ছাড়া, অনেক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ত্রাণ কার্যক্রমে অংশ নিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করে। তারা বন্যার্তদের জন্য খাদ্য বিতরণ, স্বাস্থ্যসেবা প্রদান এবং আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে বিভিন্ন প্রকার সহায়তা করেন। কিছু সংস্থা স্থানীয় হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য মেডিক্যাল টিম পাঠায় এবং পানিবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব রোধে সচেতনতামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করে।
এই প্রচেষ্টা বন্যার্তদের জন্য অমূল্য সহায়তা প্রদান করে এবং তাদের সংকটের সময়ে সাহসিকতা ও সহানুভূতির পরিচয় দেয়।এই সংকটের সময়ে সহায়তার জন্য তাদের উদ্যোগ ও প্রচেষ্টা ছিল প্রশংসনীয়।