প্রশ্ন ফাঁস ও কেন্দ্রে অনিয়মের অভিযোগে তুলকালাম, নিয়োগ পরীক্ষা স্থগিত
পঞ্চগড় চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী নিয়োগ পরীক্ষায় তুলকালাম কাণ্ড ঘটেছে। পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস, নানা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ তুলে পরীক্ষা শুরুর সময় থেকেই পরীক্ষার্থীরা ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেন। উত্তেজিত পরীক্ষার্থীদের তোপের মুখে পড়েন বিচারক, কলেজ কর্তৃপক্ষ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। আজ শুক্রবার (২০ ডিসেম্বর) সকালে এম আর সরকারি কলেজে এ ঘটনা ঘটে।
এম আর সরকারি কলেজ পরীক্ষা কেন্দ্রে প্রশাসনিক ভবনের একটি কক্ষে তাদের অবরুদ্ধ করে পরীক্ষার্থীরা নিয়োগ পরীক্ষা ও বিচারকদের বিরুদ্ধে ভুয়া ভুয়া, আবেদ আলীর সময়ের বিচারকের পদত্যাগ এবং বদলি চাইসহ নানা স্লোগান দেয়। একপর্যায়ে পরীক্ষা স্থগিত ঘোষণা এবং এ ঘটনায় দুঃখ প্রক্শা করে তদন্ত কমিটি গঠন, দোষীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিলে বিক্ষুব্ধ পরীক্ষার্থীরা শান্ত হন। প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা অবরুদ্ধ থাকার পর জুমার নামাজের আগে তারা আইনশৃংঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে বেরিয়ে যান।
পরীক্ষার্থীরা জানান, চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ১২ ক্যাটাগরিতে ৩০ জনকে নিয়োগ দিতে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। আবেদনের শেষ তারিখ ছিল গত ৪ ডিসেম্বর। পরীক্ষার তারিখ নির্ধারণ করা হয় ২০ ডিসেম্বর। পরীক্ষাকেন্দ্র করা হয় এম আর সরকারি কলেজকে। পরীক্ষা শুরুর পর পরীক্ষার্থীরা সিট খুঁজে পান না। সিট প্ল্যান দেয়া হয়নি। অনেক পরীক্ষার্থী পরীক্ষা শুরুর পরও বসার জায়গা পাননি। পরীক্ষার্থীদের কেউ কেউ ১৫ থেকে ২০ মিনিটে পরীক্ষা শেষ করলেও অনেক পরীক্ষার্থীকে আসন দেওয়া হয়নি। কিছু কক্ষে পরীক্ষার্থীদের মধ্যে প্রশ্ন ফাঁস করে দেওয়া হয়েছে এমন নানা অসংগতি, অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগ এনে পরীক্ষার্থীরা ক্ষুব্ধ হয়ে চিৎকার চেচামেচি শুরু করেন। অনেকে কক্ষ থেকে প্রশ্নপত্র ছিড়ে দিয়ে ধাক্কাধাক্কি শুরু করেন। পরে সব পরীক্ষার্থী ঐক্যবদ্ধ হয়ে চিফ জুড়িশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক মো. মেহেদী হাসান মণ্ডল, নিয়োগ কমিটির সদস্য সচিব ও সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. আশরাফুজ্জামানসহ অন্য বিচারক, কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর জাহাঙ্গীর আলম, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক এস এম ইমাম রাজী টুলুসহ কর্তৃপক্ষকে কলেজের প্রশাসনিক ভবনের একটি কক্ষে অবরুদ্ধ করে রাখে।
খবর পেয়ে সদর থানা পুলিশ ও পরে স্থানীয় ক্যাম্প কমান্ডারের নেতৃত্বে সেনাবাহিনীর সদস্যরা কলেজ ক্যাম্পাসে জড়ো হন এবং বিচারক ও কর্মকর্তাদের নিরাপত্তা দেন। এ সময় পরীক্ষার্থীরা পরীক্ষা বাতিল, তদন্ত কমিটি গঠন, নতুন করে নিয়োগ কমিটি গঠনসহ ১০ দফা দাবি উপস্থাপন করে। কলেজ কর্তৃপক্ষ, সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা, পুলিশ, পরীক্ষার্থী, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের সমন্বয়ে একপর্যায়ে পরিস্থিতি শান্ত হয়।
এ সময় চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক মো. মেহেদী হানসান মণ্ডল চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কার্যালয়ের সহায়ক কর্মচারী নিয়োগের ২০ ও ২১ ডিসেম্বরের সব পরীক্ষা স্থগিত করেন। এ সময় তিনি এ ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করেন এবং তদন্ত কমিটি গঠন, দোষীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা, খুব শিগগির নতুন করে পরীক্ষার তারিখ নির্ধারণ করার আশ্বাস দেন।
বেঞ্চ সহকারী পদের পরীক্ষার্থী সাহাজাদ বলেন, আমার কক্ষে পরীক্ষার্থী ৭০ জন প্রশ্নপত্র এসেছে ৫০টা। পরীক্ষা শুরু হয়েছে কিন্তু অনেক পরীক্ষার্থী বসারই জায়গা পায়নি। উপরে প্রশ্ন দেওয়া হয়েছে তাদের পছন্দের পরীক্ষার্থীরা লিখতেছে আর আমরা নিচে দাঁড়িয়ে আছি কক্ষের দরজাই খোলেনি।
সিফাত হাসান নামে এক পরীক্ষার্থী বলেন, স্বাধীন দেশে পরীক্ষায় দুর্নীতি ও অনিয়ম হবে এজন্যই কি সাঈদ ও মুগ্ধসহ আমার ভাইয়েরা জীবন দিয়ে দেশটাকে স্বাধীন করেছেন। আমরা দুর্নীতিবাজ এই চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের শাস্তিসহ বদলি চাই।
শামিমা আখতার নামে এক পরীক্ষার্থী বলেন, সিট প্ল্যান করা হয়নি। কে কার পরীক্ষা দিচ্ছে তার কোনো দেখার ব্যবস্থা নেই। আদালতের পছন্দের পরীক্ষার্থীরা মোবাইল বের করে উত্তর লিখছেন। সেখানে ম্যাজিস্ট্রেটরা দায়িত্ব পালন করছেন। পরীক্ষাকেন্দ্রের দায়িত্ব পালন করছেন তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরা।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক ফজলে রাব্বী বলেন, পরীক্ষার্থীদের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা সবাই মিলে ১০ দফা দাবি পেশ করেছি। এগুলোর মধ্যে পরীক্ষা বাতিল, বর্তমান নিয়োগ কমিটি বাতিল করে নতুন করে নিয়োগ কমিটি গঠন, নিয়োগ কমিটিতে ডিসি, এসপি, সেনা কর্মকর্তা, শিক্ষক প্রতিনিধি, জজকোর্টের প্রতিনিধি রাখতে হবে, শুধুমাত্র পঞ্চগড় জেলার বাসিন্দাদের নিয়োগ করতে হবে, প্রশ্নফাঁসে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে, সব পরীক্ষার্থীকে নতুন করে প্রবেশপত্র পাঠাতে হবে। তাৎক্ষণিকভাবে কিছু দাবি মেনে নেওয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি।
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক এস এম ইমাম রাজী টুলু বলেন, পরীক্ষার্থী, সমন্বয়ক, পুলিশ, বিচারক ও কলেজ কর্তৃপক্ষের সমন্বয়ে এ ঘটনার সুষ্ঠু নিরসন এবং পরিস্থিতি শান্ত করা হয়েছে। পরীক্ষার্থীদের অভিযোগগুলো তদন্ত কমিটি করে প্রয়োজনীয় ব্যভস্থা নেওয়া হবে বলেও তিনি উপস্থিত সাংবাদিকদের জানিয়েছেন।
এম আর সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক মেহেদী হাসান মণ্ডল ও মো. আশরাফুজ্জামান নিয়োগ পরীক্ষার কেন্দ্র হিসেবে আমার কলেজ নির্ধারণ করেন। এজন্য প্রায় ১৫ দিন আগে আমাকে মৌখিকভাবে জানান। সাত দিন আগে আমাকে চিঠি দিয়েছেন। পরীক্ষার আগের দিন আমি তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছি কিন্তু তারা কোনো রেসপন্স করেননি। পরীক্ষার আগের দিন রাতে তারা কী করেছেন আমরা জানি না। পরীক্ষার জন্য কতটি কক্ষ লাগবে, কতজনের পরীক্ষা নিবেন, সিট প্ল্যান, পরীক্ষা কীভাবে নিবেন কেমন করে নিবেন কারা দায়িত্ব পালন করবে। কারা প্রশ্ন করবে কীভাবে প্রশ্ন আসবে আমাদের সঙ্গে এসব বিষয়ে কোনো আলোচনাই করেননি।
চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক মো. মেহেদী হাসান মন্ডল উপস্থিত পরীক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে সব পরীক্ষা বাতিল করা হয়েছে জানিয়ে অনাকাঙ্খিত এ ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন। পরীক্ষার্থীদের ১০ দফা দাবির মধ্যে কয়েকটি দাবি মেনে নেওয়া হয়েছে উল্লেখ করে তিনি প্রশ্নপত্র ফাঁসসহ অনিয়মের বিষয়ে তদন্ত করে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানান।