থানা দাপিয়ে বেড়ালেও আসামি খুঁজে পায় না পুলিশ!

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতাকে গুলি করে হত্যা হামলা মামলার আসামি হয়েও তিনি ঘুরে বেড়াচ্ছেন প্রকাশ্যে। নির্বিঘ্নে যাচ্ছেন থানায়ও। আবার পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে কখনও চাচক্রে। তার পরও তিনি অধরা। তাকে খুঁজে পান না মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা! সরকারের চলমান ডেভিল হান্ট অপারেশনেও তিনি ‘ভিআইপি আসামি’।
মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের উত্তরা পূর্ব থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শামীম আহমেদ।
আলোচিত এই আসামির নাম লোকমান হোসেন খোকা ওরফে খোকা মুহাম্মদ চৌধুরী। মামলার এজাহারে নাম উল্লেখ করা হয়েছে লোকমান হোসেন খোকা ওরফে হকার খোকা (৪৯)। তাঁর বাড়ি আশুলিয়ার বাইপাইল বাগবাড়ি এলাকায়।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গুলি করে যাত্রাবাড়ী এলাকার দর্জির দোকানের কর্মচারী তারেক (১৮) হত্যা মামলার এজাহারভূক্ত আসামি তিনি।
পুলিশ জানায়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যোগ দিয়ে গত বছরের ৪ আগস্ট গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান মো. তারেক। তবে অজ্ঞাতপরিচয় হিসেবে দীর্ঘদিন এই শহীদের মরদেহ পড়েছিল মর্গের হিমঘরে। তিনি ভোলা জেলার চরফ্যাশন থানার পূর্ব খোদেজাবাগ গ্রামের মো রিয়াজের ছেলে। চাকরি করতেন রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থানার বিবিরবাগিচায় নিউ নবরূপা টেইলার্সে।
নিউ নবরূপা টেইলার্সের মালিক মমতাজ আক্তার পলি জানান, তারেক বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে যোগ দেওয়ার পর নিখোঁজ ছিলেন। দীর্ঘদিন বিভিন্ন স্থানে খোঁজাখুজি করে গত বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে সংরক্ষিত তারেকের মরদেহ শনাক্ত করে তাঁর পরিবার। পরে মৃত্যু সনদ গ্রহণ করে মরদেহ দাফনের উদ্দেশে নেওয়া হয় ভোলায়।
ওই ঘটনায় অন্য আরও অনেকের সঙ্গে লোকমান হোসেন খোকা ওরফে খোকা মুহাম্মদ চৌধুরী ওরফে হকার খোকাকে আসামি করে রাজধানীর উত্তরা পূর্ব থানায় একটি হত্যা মামলা করা হয়। পুলিশের ক্রাইম ডেটা ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমে (সিডিএমএস) লোকমান হোসেন খোকা ওরফে খোকা মুহাম্মদ চৌধুরী ওরফে হকার খোকার কোড নেম H3S1D।
উত্তরা পূর্ব থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আবু সাঈদ মিয়া জানান, ওই দিন নিহত তারেকের চাচাতো ভাই পরিচয়ে আল ইমরান মামলাটি করেন। তিনি মাগুরা জেলার শংকোচখালি গ্রামের আলতাব উদ্দীন মোল্লার ছেলে।
মামলার শীর্ষ আসামিদের তালিকায় রয়েছে ৫ আগস্ট ছাত্র জনতার অভ্যুত্থানে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তাঁর বোন শেখ রেহানা, ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালসহ ১৩২ জন। আলোচিত লোকমান হোসেন খোকা ওরফে খোকা মুহাম্মদ চৌধুরী ওরফে হকার খোকা ওই মামলার ৮২ নম্বর আসামি।
আশুলিয়া প্রেসক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক লাইজু আহমেদ চৌধুরী বলেন, বাইপাইলে হকারি করেই ক্ষমতাসীনদের ছত্র ছায়ায় প্রভাবশালীদের কাতারে নাম লেখান লোকমান হোসেন খোকা ওরফে খোকা মুহাম্মদ চৌধুরী। গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে হলেও গাজীরচটে আশুলিয়া থানা যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক মঈনুল ইসলামের ভাই সোলেমান ভুইয়ার মেয়েকে বিয়ের সুবাদে হয়ে ওঠেন একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী। সেই ধারাবাহিকতায় আশুলিয়া থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এবং সাবেক সংসদ সদস্য মুহাম্মদ সাইফুল ইসলামের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সুবাদে অল্প সময়ের ব্যবধানে হয়ে ওঠেন অর্থবিত্তের মালিক।
সর্বশেষ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে বেসরকারি জিটিভির আশুলিয়া প্রতিনিধি শামীম হাসান সীমান্তের (৩০) ওপর সন্ত্রাসী হামলার ঘটনার ছয়জনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয় আশুলিয়া থানায়। সেই মামলায় আসামি করা হয় খোকা মুহাম্মদ চৌধুরী ওরফে হকার খোকার ছয় ঘনিষ্ঠ সহযোগী সোহেল রানা (৪২), সিদ্দিক ওরফে চোরা সিদ্দিক (৪৫), আল মামুন খান (৪৮), ফয়জুল ইসলাম (৪০), ইমদাদুল হক (৪০) ও জাহাঙ্গীর হোসেন সাগরকে (৪২)।
সেই মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে গত ১২ ফেব্রুয়ারি আশুলিয়ার বাইপাইলের অদূরে নবীনগর-চন্দ্রা মহাসড়কে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিলে নেতৃত্ব দেন লোকমান হোসেন খোকা।
সূত্র মতে, হত্যা মামলার আসামি হয়েও সোমবার সকালে এক সহযোগীকে নিয়ে সাভার মডেল থানায় প্রবেশ করেন এই লোকমান হোসেন খোকা। সেখানে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গেও শলাপরামর্শ করতে দেখা যায় তাঁকে। তাঁর গতিবিধি থানার সিসি ক্যামেরায় রেকর্ড থাকার বিষয়টি প্রকাশিত হলে তোলপাড় সৃষ্টি হয় সর্বত্র।
হত্যা মামলার আসামি হয়েও অবাধে থানায় প্রবেশ এবং পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে খোশগল্পের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে বিব্রত হন একজন পুলিশ কর্মকর্তা। নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা থানায় নতুন এসেছি। কে হত্যা মামলার আসামি আর কে মুখোশধারী ডেভিল তা প্রাথমিকভাবে ঠাওর করা মুশকিল। এ ব্যাপারে পরবর্তী সময়ে নিজেরা সতর্ক থাকবেন বলেও জানান।
এ বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হলে লোকমান হোসেন খোকা বলেন, আমি থাকি আশুলিয়ায়। কিভাবে যাত্রাবাড়ী এলাকার দর্জির দোকানের কর্মচারী হত্যা মামলায় আমাকে আসামি করা হয়েছে তা জানি না। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে অংশ নিয়ে আমি গুলিবিদ্ধ হয়েছি।
লোকমান হোসেন খোকার দাবির সত্যতা নিশ্চিত হতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আহতদের যে তালিকা তৈরি করেছে তা খুঁজে তাঁর নাম পাওয়া যায়নি। জুলাই-আগস্টে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল ও জেলা পর্যায় থেকে তথ্য সংগ্রহ করে আহতদের তালিকা করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।